এই শহরে নিজেকে এখন অচেনা মনে হয়

ছন্দা দাশ | শুক্রবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

যখন এই এলাকায় এসেছিলাম প্রায় ফাঁকা ছিলো। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির দুরত্বও নেহায়েত কম ছিলো না। দিন দুপুরেও লোকজনের যাতায়াত ছিলো সীমিত। বলা হতো এ এলাকায় ছিনতাইকারী, নেশাখোর আর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। তবু্‌ও এলাকাটা আমার ভালো লেগেছিল পাহাড় আর সবুজের মনোরম পরিবেশের জন্য। কিছুদিন থাকার পর দেখলাম এই ছিনতাইকারীর দলও একটা নীতি মেনে চলে। সেটা কী? সেটা ছিলো এ এলাকার বাসিন্দা যারা তাদের ওরা কিছু করতো না। রাত দুপুরেও না। এলাকাটা অনেকেরই জানা। এর নাম লালখান বাজার। চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু এলাকা। জানি না সত্যি কিনা। তবে শুনেছি বন্যার কারণে চট্টগ্রাম শহর ডুবলেও লালখান বাজার চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকবে। কারণ এ এলাকা পুরোটাই পাহাড়। পাহাড় কেটে এখানে বসতি গড়ে উঠেছে। তাই রাস্তাগুলোও সাপের মতো এঁকেবেঁকে কখনো উঁচু কখনো বা নিচু হয়ে এলাকার শোভা বর্ধন করে আছে। টাইগার পাস এলাকা দিয়ে যখন আসবেন রাস্তার দুই পাশেই পাহাড়ের সম্মোহন উপেক্ষা করে এমন সাধ্য কার? ইচ্ছে হলে জিলিপি পাহাড়েও ঘুরে আসতে পারেন। ফিরতি পথে হাতের মুঠো পূর্ণ হবেই। জিলিপী নাম কেন ভাবছেন তো! এর শেষ গন্তব্যে পৌঁছুতে আড়াইটা প্যাঁচ দিয়ে উঠতে হয়।

আর চুড়োয় উঠে দেখতে পাবেন পুরো চট্টগ্রামের ছবি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে দেখবেন বাঁকানো রাস্তা। আপনাকে টানবেই যদি সুরের মানুষ হন। ওই এলাকার নাম বাঘঘোনা। একসময় বাঘদের আধিপত্য ছিলো। ওখানেই শাল, পিয়াল, সেগুন, পাইনের মেলা।

অবশ্য আলাদা করে সেগুন বাগান এলাকায় যেতে পারেন। পাহাড়ি রাস্তাগুলো শুধু চোখই টানে না। মনও ভোলায়। ওখানে সেগুনের নীচে বসে বাঁশি বাজাতো পথের মানুষ। এখন ওদের আর দেখি না। আর একপাশে রেলওয়ে কলোনীর লাল বাসাগুলো সবুজের আঁচলে লাল টিপ যেন।

ঐ রাস্ত ধরে যেতে যেতে আপনি পৌঁছে যাবেন সাত রাস্তার মোড়ে। আহা কী তার শোভা! যেন শিল্পীর তুলিতে আকাঁ সেই বিখ্যাত সিআরবি পাহাড়। চোখ, মন, প্রাণ সবই মন্ত্রপূত ধ্যানী যোগীর মতো এখানে আসন নেবেই।

লালখান বাজার এসেছিলাম সেই কতবছর আগে আজ কষ্ট করেই মনে করতে হয়। তখন জীবন ছিলো কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত। অন্যভাবে বলা যায়, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। চোখ মেলে তাকানোর সময় হয়নি তখন পাহাড়ের কিংবদন্তী রূপ, যেখানে মেঘেরা এসে আলাপ জমাতো মেঘমল্লার রাগে। হু হু করে কখন সময় চলে গেছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার প্রয়োজনে।

তারপরেও কি দাঁড়াতাম না কোনো বিকেলের অলস বারান্দায়! কিংবা খুব ভোরে শিউলী ফোটা গন্ধকে বুকে নিয়ে! বা জ্যোৎস্না রাতের একাকী বিরহী হয়ে?
জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা।

দিন পরিক্রমায় এখন জীবন শ্লথ। কিন্তু মন এখনও যে সুদূর পিয়াসী। অথচ এখন প্রজন্মের ব্যবধান এতই বিশাল তার দিশা পাওয়া ভার। তাই নিজেকে এখন অদ্ভুত, অচেনা এক আগন্তুক মনে হয়।

আগের মতই বারান্দায় এসে দাঁড়াই যখন মনে হয় জীবন্ত কবরে আছি বেঁচে। চারপাশের কোথায় গেল খোলা মাঠ। পিচঢালা সেই কালো রাস্তাটা এখন আর দেখা যায় না নতুন নির্মিত বিশ, ত্রিশ তলা ভবন যেন আকাশটাকেও ঢেকে দেবে। চারপাশের দেওয়াল ঘেরা বদ্ধ আধুনিক ফ্ল্যাট থেকে মনে হয় মৃত্যুর আগেই কবরের মধ্যে বাসস্থানের আয়োজন। এক ভবন থেকে আরেক ভবন গা ঘেঁষে আছে। মনে মনে ভাবি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের প্রায় সবারই তো গাড়ি আছে। পথ দিয়ে চলা দায়। দিনের পর দিন যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। মনে হয় গা ছোঁয়া ভবনের ছাদ দিয়েই বুঝি একদিন চলাচল করা অধিকতর সুবিধেজনক হবে।

আগে ছিলো পথের দুরত্ব, এখন মনের দুরত্ব। পাশাপাশি বাসিন্দা অথচ কেউ কাউকে চেনে না। একসময় এই গলির সব বাড়ির মানুষ সবাই সবাইকে চিনতো, দেখা হলে কুশল বিনিময় হতো। উৎসবের আনন্দে পরস্পর শামিল হতো। কতো দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেলো মানুষের জীবন।

তবে কী সেই সত্য আসার দিন সমাগত! যেদিন পথের ওপর পড়ে থাকবে বহু মূল্যবান টাকা? মানুষ দেখেও ছোঁবে না। কারণ যার জন্য তারা হারিয়ে ফেলছে হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন ভালোবাসার কাঙাল মানুষ। প্রতিটি মানুষ এখন হয়ে যাচ্ছে মানবতা হীন এক একটি রোবট। টাকা দিয়ে তা কেনা যায় না। লেখক : কবি, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনের শেষ বয়সে ক্ষণিকের স্বপ্ন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা