আজ ২৬ অক্টোবর, ২০২২। আজকের এদিনে ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের স্থানীয় ইতিহাস গবেষক আবদুল হক চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ২৮ তম মৃত্যুদিবসে আমরা তার স্মৃতিচারণ করছি। স্মৃতিচারণে মৃত ব্যক্তির কোন লাভ নেই। লাভ হলো জীবিতদের। আমরা এ স্মৃতিকথা থেকে যদি দুই/একটা তথ্য পেয়ে যাই অথবা কোন প্রকার শিক্ষা লাভ করতে পারি তাহলে লেখক-পাঠক উভয়ে উপকৃত হতে পারি।
প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি অথবা উচ্চতর গবেষণার প্রশিক্ষণ ছাড়া কেবল মাত্র অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, অনুসন্ধিৎসু মন ও অন্তরচক্ষুর মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তিই একজন খ্যাতিমান গবেষক হতে পারে- আবদুল হক চৌধুরী হলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র হলো স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ইতোমধ্যে তিনি চট্টগ্রাম ও সিলেটের স্থানীয় ইতিহাসের ওপর বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছেন যা সুধী সমাজের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণবিহীন, অদক্ষ, অসাধারণ এ ব্যক্তিটির রয়েছে নিজস্ব গবেষণা পদ্ধতি । ইতিহাস গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যে উপনীত হওয়া অথবা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা। মৌলিক গবেষণার মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আবদুল হক চৌধুরী প্রকল্প গ্রহণ করে আপন গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে সত্যে উপনীত হবার অক্লান্ত প্রচেষ্টা করেছেন ।
ইতিহাসবিদ আবদুল করিম যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্ভবতঃ তখনই আবদুল হক চৌধুরীর চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। আবদুল হক চৌধুরীর এক ছেলে তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার মাধ্যমে আবদুল হক চৌধুরীর সাথে ড. আবদুল করিমের যোগাযোগ এবং পরিচয় হয়। সে পরিচয় আমরণ অটুট ছিল। আবদুল হক চৌধুরীর সাথে আমারও ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি তাঁকে চাচা বলে ডাকতাম এবং চট্টগ্রামের রেওয়াজ মতে তিনি আমাকে বাবা (বাজী) ডাকতেন । তাঁর প্রণীত সকল বই নিজ হাতে নাম লিখে আমাকে দিয়েছেন। সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ বইটি ড. মুজিরউদ্দিন মিয়ার মাধ্যমে আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন । যতবার আমি তাঁর বাড়ী গিয়েছি ততবার আমাকে ভাত খেয়ে আসতে হয়েছে। আবদুল হক চৌধুরী বড় লোকের সন্তান, চাকুরী করতেন না; ব্যবসাও করতেন বলে মনে হয় না, আমার জানা মতে পৈতিৃক সম্পদের উপর ভিত্তি করে তিনি সচ্ছল ভাবে চলতেন এবং চট্টগ্রাম শহরে দেওয়ান বাজার এলাকার পূর্বদিকে একটি বহুতল বাড়ী করেছেন। সে বাড়ীতে আমি বহুবার গিয়েছি।
একবার সকাল ১০টায় তার বাড়ীতে গেলাম, অনেক নাস্তা খাওয়ালেন । আমি চলে আসতে চাইলে আসতে দিলেন না, মুরুব্বী মানুষ বলে কথা অমান্য করে আসতে পারলাম না। দুপুরে খাওয়ার জন্য চাচীও বললেন। তাই থেকে গেলাম। দুপুরে খাওয়ার সময় ইলিশ মাছের ভাজা ও রকমারী রান্না। তিনি উঠায়ে দিচ্ছেন আর আমি খাচ্ছি। অনেক খেলাম কিন্তু তাঁর তৃপ্তি হচ্ছে না। তারপর রাজশাহী চলে এসে ড. মুজিরউদ্দিন মিয়াকে (প্রফেসর, বাংলা বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমানে মরহুম) এ গল্প করলাম । তিনিও চৌধুরীর এরকম বহু আতিথিয়তা গ্রহণ করেছেন। তাঁর ১৫/২০ দিন পর ড. মুজিরউদ্দিন মিয়া আমাকে রাত ১১ টার দিকে ফোন করে জানালেন চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক আবদুল হক চৌধুরী আর দুনিয়াতে নেই। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) ।
পরিচয় হওয়ার পর থেকে আবদুল হক চৌধুরীর সাথে ড. আবদুল করিমের যোগাযোগ নিয়মিত ছিল। ইতিহাসের যে কোন সমস্যা নিয়ে চৌধুরী ড. করিমের সাথে অকপটে আলোচনা করতেন এবং এটা ছিল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া । চট্টগ্রামের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে আবদুল হক চৌধুরীর জুড়ি নেই । নিবেদিত প্রাণ এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে গবেষণা কাজ করতেন বলে আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রফেসর তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতো। ড. আবদুল করিমও তাঁর কাজে মুগ্ধ ছিলেন । একদিন ১০/১১ টার দিকে আবদুল হক চৌধুরী ড. আবদুল করিমের বাসায় আসেন। তথ্য সংগ্রহ, সংগৃহীত তথ্যের সত্যতা, উপস্থাপন, বিশ্লেষণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সকাল ১০টা থেকে বিকাল প্রায় ৩ টা পর্যন্ত আলোচনা চলে। যাওয়ার সময় আবদুল হক চৌধুরী ড. আবদুল করিমের কাছে একটি আবেদন করলেন- “যদি আমি আগে মারা যাই তবে আপনি আমার উপর একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করবেন; আর যদি আপনি আগে মারা যান তবে আমি আপনার উপর একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করবো।” এ কথা গুলো ড. করিম আমাকে বহুবার বলেছেন। উল্লেখিত কথা শেষে চৌধুরী সাহেব ড. করিম থেকে বিদায় নিয়ে যান। চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে যত সিরিয়াস ছিলেন; ড. করিম তাঁর প্রতিশ্রুতিতে তখন তত সিরিয়াস ছিলেন না। কিন্তু সে দিন রাত ১০ টার দিকে আবদুল হক চৌধুরীর বড় ছেলে এডভোকেট মোহাম্মদ আমীন চৌধুরী, ড. আবদুল করিমকে ফোন করে বললো-“চাচাজান, বাবা আর দুনিয়াতে নাই ।” ড. আবদুল করিম অত্যন্ত মর্মাহত হলেন । সারা দুপুর যে লোকটি তাঁর বাসায় ছিলেন এবং তাঁকে একটি চুক্তির মধ্যে আবদ্ধ করে বিকাল ৩ টার দিকে বাসায় গেলেন সেই লোকটি রাত ১০ টায় দুনিয়াতে নেই । জীবন এবং মৃত্যুর মালিক স্রষ্টা স্বয়ং । এটাই শিক্ষা যা বেশীর ভাগ মানুষ গ্রহণ করেন না । ড. করিম আমাকে বললেন “এ রকম একটি অতি মর্মান্তিক ঘটনার পর প্রায় ১০/১২ দিন আমি কলম ধরিনি। শুধু ভাবতাম আবদুল হক চৌধুরী কিভাবে মৃত্যু সম্পর্কে আঁচ করতে পারলেন এবং আমাকে এমন একটি প্রতিশ্রতিবদ্ধ অবস্থায় রেখে গেলেন।” আবদুল হক চৌধুরীর প্রায় লেখা, প্রকাশিত গ্রন্থ অথবা প্রবন্ধ ড. আবদুল করিমের সংগ্রহশালায় ছিল। তাই তাঁর সম্পর্কে গ্রন্থ প্রণয়ন করতে খুব বেশী অসুবিধা হলো না। ইতোমধ্যে আবদুল হক চৌধুরীর উপর ২/৩ টা স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ড. মুজিরউদ্দিন মিয়া সম্পাদিত বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত আবদুল হক চৌধুরী স্মারকগ্রন্থটি যথেষ্ট মান সম্পন্ন বলে আমি মনে করি। তাছাড়া আমি এও মনে করি যে উক্ত স্মারক গ্রন্থে আমার প্রণীত “স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণা পদ্ধতি” প্রবন্ধটি চৌধুরী সম্পর্কে এ পর্যন্ত প্রণীত প্রবন্ধের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ এ অভিমত আমার নয়; ইতিহাসবিদদের। অতঃপর ড. আবদুল করিম তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুতি মোতাবেক “আবদুল হক চৌধুরী ও তাঁর গবেষণা কর্ম” শীর্ষক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ১৯৯৭ সনে ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমী হতে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। যার ফলে বন্ধুত্ব ও প্রতিশ্রুতি উভয়ই উদ্ভাসিত হয়েছে। বাংলার স্থানীয় ইতিহাস গবেষণাকারীরা গভীরভাবে উপকৃত ও উৎসাহিত হয়েছে। মৃত্যুর মাধ্যমে আবদুল হক চৌধুরী মুক্তি পেয়ে গেছেন। পক্ষান্তরে কর্মী আবদুল করিম নতুন কর্ম সৃষ্টি করে গেছেন। এটাই মহান স্রষ্টার বিধান। লঙ্ঘনের ক্ষমতা কারো নেই।
লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়