চিকনগুনিয়ার ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম ৬ দফা সুপারিশ

এডিস এলবোপিক্টাস মশার প্রজনন বেশি আইইডিসিআরের জরিপ প্রতিবেদনে তথ্য

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২০ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকনগুনিয়া রোগের ঝুঁকিতেও রয়েছে চট্টগ্রাম। এক প্রতিবেদনে ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এ তথ্য জানিয়েছে। লার্ভা পাওয়া শতভাগ নমুনায় এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিক্টাস মশার অস্তিত্ব ধরা পড়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এডিস ইজিপ্টির তুলনায় এডিস এলবোপিক্টাস মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। তাই চট্টগ্রামে চিকনগুনিয়ার প্রকোপের ঝুঁকি রয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এডিস মশার দুটি প্রজাতির মধ্যে এডিস এলবোপিক্টাস মশার কামড়ে চিকনগুনিয়া বেশি ছড়ায়। প্রসঙ্গত, আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি অবহিত করে সিভিল সার্জন কার্যালয়।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর স্বাক্ষরে গত ১২ সেপ্টেম্বর এ চিঠি দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে আইইডিসিআর’র চার সদস্যের একটি টিম ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে আসে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধানেই মূলত এ টিম চট্টগ্রামে আসে। টানা ৫ দিন (১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর) দলটি চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন এলাকা ও বাসা-বাড়ি গিয়ে লার্ভার পাশাপাশি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। লার্ভার উৎস শনাক্তে কাজ করেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের রক্তের নমুনাও সংগ্রহ করেন তারা। ২৩ সেপ্টেম্বর দলটি ঢাকায় ফিরে যান। চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বরে করা ওই জরিপের ভিত্তিতে সমপ্রতি একটি প্রতিবেদন (রিপোর্ট) দিয়েছে আইইডিসিআর। আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিনের স্বাক্ষরে গত ১৬ অক্টোবর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।

বিষয়টি অতি গুরুত্বের সাথে নিয়ে বুধবারই (গতকাল) এ প্রতিবেদন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, জেলাপ্রশাসক ও সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন। আর ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকনগুনিয়ার ঝুঁকির বিষয়ে সিভিল সার্জন বলেন, সবকিছুর মূলে এডিস মশার বংশ বিস্তার। এডিসের দুটি প্রজাতির মধ্যে চট্টগ্রামে এডিস এলবোপিক্টাস মশার উপস্থিতি বেশি বলে আইইডিসিআর জানিয়েছে। এ প্রজাতির মশা চিকনগুনিয়া বেশি ছড়ায়।

তাই চিকনগুনিয়ার প্রকোপও দেখা দিতে পারে। এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার ঝুঁকি কমে যাবে। তবে মশা নিধন বা মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের নয়। এটি সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। আমরা সিটি কর্পোরেশনকে বিষয়টি অবহিত করেছি। অবশ্য, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদেরও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী- জরিপকালীন সময় পর্যন্ত মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় মোট ৪৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ওই সময়ে ডবলমুরিং (৩২ শতাংশ), হালিশহর (২০ শতাংশ), আগ্রাবাদ (১৮ শতাংশ), বন্দর এলাকা এবং সাতকানিয়া উপজেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১২, ৩৮, ৩৭, ২৯, ৪০, ৪১, ২৭, ২৮ ও ৩৬ নং ওয়ার্ডের স্থানীয়রা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ১১ ডেঙ্গু রোগীর নমুনা পরীক্ষায় ডিইএন-থ্রি ৪ জন এবং ডিইএন-ফোর ধরনের ২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ডেঙ্গুর ডিইএন-থ্রি এবং ডিইএন-ফোর ধরনে আক্রান্ত হচ্ছে চট্টগ্রামের বাসিন্দারা।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জরিপকালীন মোট ৮০টি স্পট পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এর মধ্যে ২৫টি স্পটে লার্ভা পাওয়া গেছে। এসব স্পটের মধ্যে খালি প্লট, মার্কেট এলাকা, বাস টার্মিনাল, বন্দর এলাকা রয়েছে। আর ২৬ শতাংশ বহুতল ভবন, ১৪ শতাংশ সেমি পাকা ঘর এবং ২০ শতাংশ নির্মানাধীন ভবনে লার্ভার অস্তিত্ব মিলেছে। এছাড়া মশার প্রজনন স্থান হিসেবে যানবাহনের অব্যবহৃত টায়ার, প্লাস্টিক ড্রাম, ফুলের টব, খালি কনটেইনার, অব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতলের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

জরিপে শতভাগ নমুনায় এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিক্টাস মশার অস্তিত্ব ধরা পড়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এডিস ইজিপ্টির তুলনায় এডিস এলবোপিক্টাস মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। যার কারণে চট্টগ্রামে চিকনগুনিয়ার প্রকোপের ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মশারির বাইরে ২৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন এমন বেশ কয়টি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন আইইডিসিআর’র টিম। তবে মাত্র তিনটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ডেঙ্গু কর্ণার স্থাপন করা আছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আর ৭৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী মশারি ব্যবহার করলেও মশারির বাইরে থাকছে ২৫ শতাংশ রোগী।

৯০ শতাংশ ভবনে লার্ভার সম্ভাব্য উৎস : ৯০ শতাংশ ভবনে লার্ভার সম্ভাব্য উৎস উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শতভাগ মানুষ ডেঙ্গু সম্পর্কে জানে। তবে মাত্র ৩০ শতাংশ মানুশ এডিস মশার প্রজনন স্থল সম্পর্কে জানে। ৫০ শতাংশ মানুষ মশারি ব্যবহার করে। আর জানালায় নেট ব্যবহার পাওয়া গেছে মাত্র ১০ শতাংশ ভবনে।

৬ দফা সুপারিশ : প্রতিবেদনে ৬ দফা সুপারিশ করেছে আইইডিসিআর। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- কমিউনিটির মধ্যে ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা কার্যক্রমে জোর দেয়া, এডিস মশার প্রজনন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সকল পক্ষকে সম্পৃত্ত করা, প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে আরো সচেতন করা, মশার বংশ বিস্তার প্রতিরোধে হাউসহোল্ড জরিপ নিশ্চিত করা এবং আলাদা ডেঙ্গু কর্ণার স্থাপন করে চিকিৎসার পাশাপাশি হাসপাতালে রোগীর মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করা।

উল্লেখ্য, আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৬৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৪২ জনে। আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এদিকে, হাসপাতালের ৫টি ওয়ার্ডে বুধবার রাত পর্যন্ত শতাধিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুলিশের ছিনতাই হওয়া মোবাইল, মানিব্যাগ উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড় কাটায় নারীসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা