রাসেল মায়ের পাশেই আছেন

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

২০১১ সালের কথা। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। নবনির্বাচিত পর্ষদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের একটি আনুষ্ঠানিকতা অনেকদিনের। এরই ধারাবাহিকতায় একই বছরের ২৯ মে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যাই। মনে পড়ে সাক্ষাৎকালে তাঁকে সম্বোধন করতে বার বার যখন প্রধানমন্ত্রী-জননেত্রী শব্দসমূহ ব্যবহার করছিলাম, তখন স্বভাব-সুলভ ভঙ্গিতে তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন “এতো প্রধানমন্ত্রী-জননেত্রী বলার দরকার নেই। তোমরা আমার রাসেলের মতো, আমাকে আপা বলে ডাকো। আমার রাসেল বেঁচে থাকলে তোমাদের মতোই হতো।” মুহূর্তেই আমাদের মধ্যকার উপলক্ষিক দূরত্ব ঘুচে গেলো! আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই অকৃত্রিম আন্তরিকতায় পরবর্তী আলাপ করে গেলাম।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার আবেগ ও অনুভবে শেখ রাসেলের অধিষ্ঠান। বাংলাদেশ নামের পরিবারের তারুণ্যদীপ্ত প্রাণে তিনি দেখেন সম্ভাবনা, দেখেন আদরের রাসেলকে। বেঁচে থাকলে আজ যাঁর বয়স হতো ৫৯ বছর। কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট স্তব্ধ করে দিল একটি সজীব প্রাণ। ঝরে গেলো ফুটন্ত ফুল। যে ফুল সৌরভ ছড়ানোর আগেই চিরতরে বিদায় নিলো। ঘাতকের প্রতিহিংসা একটি অমিত সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটালো।
আজ শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন, তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। ১৯৬৪ সালের ১৮ আগস্ট রাসেলের জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম শেখ রিসাল উদ্দীন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক ও মানবতাবাদী, যুদ্ধবিরোধী রাসেলর চিন্তন ও মতাদর্শের নিবিড় অনুরাগী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাবাসকালে নিবিষ্ঠ অনুধ্যানে বার্ট্রান্ড রাসেলের গ্রন্থ তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়ির দোতলায় ব্যক্তিগত পাঠাগারে সংরক্ষিত ছিলো বার্ট্রান্ড রাসেলের রচনাবলী। ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনী তাঁর বাড়ি লুটপাট কওে, সেসময় বঙ্গবন্ধুর সমুদয় সংগ্রহ বেহাত হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাঁর একজন অনুরাগী পুরোনো বইয়ের দোকানে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর সম্বলিত বইটি পেয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দেন। দার্শনিক রাসেলের চিন্তন মানস-বাসনা বঙ্গবন্ধু বেগম ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গেও আলোচনা করতেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রতি সেই অনুরাগের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখেন- রাসেল।
রাসেল ছিলো বঙ্গবন্ধু পরিবারের নয়নের মণি। সবার অত্যন্ত আদরের। তাঁকে নিয়ে তাই সকলের স্বপ্নের চুড়ো ছিল তুঙ্গে। অঢেল মেধা ও প্রাণশক্তির অধকারী ছিলেন রাসেল। তাঁর শিক্ষক রাজিয়া মতিন চৌধুরীর মন্তব্য: “সরল, সহজ, সপ্রতিভ চাল-চলন। প্রধানমন্ত্রী ও পরে প্রেসিডেন্টের ছেলে বলে কোনোদিন কোনোরকম বাহুল্য বা আড়ম্বর দেখিনি। দেখেছি চটপটে একটি তরুণ, তুখর সৌম্য তলোয়ারের মতো তীক্ষ্ণতা ছিলো তাঁর গড়নে।”
দানবের প্রতিহিংসা শেষ পর্যন্ত অবোধ শিশুটিকেও রেহাই দিলো না। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্র-প্রধান শিশুসহ পরিবারের সকল সদস্যকে বর্বোরোচিত হত্যার নজির নেই। কারবালার প্রান্তরেও শিশুহত্যা হয়নি। কিন্তু ১৫ আগেস্টেও ওই অভিশপ্ত রাতে কেবল রাসেল নয়, আরো ৩ শিশুকে পৈশাচিক হত্যার শিকার হতে হয়। হত্যা করা হয় রাসেলের খেলার সাথি বেবি সেরনিয়াবাতকে (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে)। এছাড়া হাসনাত আবদুল্লাহ রাজু এবং ওই দিনই বেড়াতে আসা রিন্টু নামের আরো এক শিশুকেও হত্যা করা হয়।
পৃথিবীর কোনো দেশে, কোনো কালে, কোনো জাতির মধ্যে শিশুহত্যা স্বীকৃত নয়। কিন্তু ৭৫’র ঘাতকচক্র মানবহত্যার এই নিঃকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল কোমল প্রাণের তাজা রক্তের হোলি খেলায়। কবির বেদনার্থ উচ্চারণ- “শিশুহত্যার রক্তরঞ্জিত ওই কালো হাত যেন সময়ের বহতা ধারা স্তব্ধ করে দেয়”। আরো একজন কবি’র উচ্চারণ- “মানবতা আজ কোথায় গেলো হচ্ছে শিশু বলী, কেউবা তাদের হত্যা করে কেউবা করে গুলি।”
এক অমিত সম্ভাবনা ছিল রাসেলের মধ্যে। তাঁর মানবতাবোধ ছিল প্রগাঢ়। বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে পিঁড়িতে বসে রান্নাঘরে খেতেও তার দ্বিধা ছিল না। বাড়ির গৃহকর্মী রমার সঙ্গে ছিলো তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। নিজের সুখ-দুঃখের অনুভূতি শেয়ার করতো রমার সঙ্গে। এমনকি পশু-পাখির প্রতি রাসেলের মমত্ব ছিল গভীর। বাড়ির পালিত কবুতর যখন অসুস্থ রোগীর পথ্য হিসেবে রান্না করা হতো, তা কিছতেই মুখে তুলতো না রাসেল। কেননা প্রতিদিন খুব ভোরে তার মায়ের সঙ্গে ওই কবুতরগুলোকে খাবার দানাদানি দিত সে। পোষা কুকুরের সঙ্গে নিজের খাবার ভাগ করে খেতো সে।
পিতার মতো শেখ রাসেলের নেতৃত্বের গুণও ছিল অসাধারণ। আদরের ছোটভাই রাসেলকে নিয়ে লেখা আমাদের ছোট রাসেল সোনা গ্রন্থে শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন, “টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়িতে গেলে তার খেলাধুলার অনেক সাথী ছিল। গ্রামের অনেক ছোট ছোট বাচ্চাদের জড়ো করত। তাদের জন্য ডামি বন্দুক দিয়েছিল। সে বন্দুক হাতে তাদের প্যারেড করাত। প্রত্যেকের জন্য খাবার কিনে দিত। রাসেলের খুদে বাহিনীর জন্য জামা-কাপড় ঢাকা থেকেই কিনে দিতে হতো। মা কাপড়-চোপড় কিনে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যেতেন। সবসময় মা কাপড়-চোপড় কিনে আলমারিতে রেখে দিতেন। নাসের কাকা রাসেলকে এক টাকা নোটের বান্ডেল দিতেন। খুদে বাহিনীকে সে বিস্কুট লজেন্স কিনে খেতে দিত। প্যারেড শেষ হলেও তাদের টাকা দিত। এই খুদে বাহিনীকে নিয়ে বাড়ির উঠানেই খেলা করত। রাসেলকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করত বড় হলে তুমি কী হবে? তাহলে বলত আমি আর্মি অফিসার হব।…”
১৯৬৬ সালে রাসেলের বয়স সবে বছর পেরিয়েছে, ৬ দফার কারণে বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। প্রতি পনের দিন পর পর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতে রাসেলের অনুভূতি শেখ হাসিনার বয়ানে জানা যায়। রাসেল জেলকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আর ৩২ নম্বর বাড়িকে পরিবারের বা মায়ের বাড়ি মনে করতো। তাঁকে জেল থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন ছিল।
রাসেল যেদিন নিহত হন, তাঁর বয়স ১১ ছুই ছুই। হত্যার পূর্বে ঘাতকরা এই ছোট্ট শিশুটিকে টানা হেঁচড়া করেছে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। রাসেল চেয়েছেন মায়ের কাছে যেতে। মায়ের লাশ দেখে, যেতে চাইলেন হাসু আপার কাছে। কী মিনতি ছিল তাঁর!
রাসেল হত্যার সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যপট! ভীত হতচকিত রাসেল জড়িয়ে ধরে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত স্টাফ মোহিতুল আলমকে। ঘাতকদের বলে আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও। কিন্তু পিশাচ নরপশু রাইফেলের বাট দিয়ে মোহিতুলকে আঘাত করে। তারপর রাসেলকে মা-বাবা- বড় ভাই-ভাবিদের রক্তস্নাত লাশের পাশ দিয়ে নিয়ে যায় দোতলায়। রাসেল তাদের বলে আমাকে মেরো না, আমাকে হাসু’পার কাছে পাঠিয়ে দাও। কিন্তু বর্বর বুলেটের ঝাঁক গুড়িয়ে দেয় রাসেলের মস্তিষ্ক!
শেখ রাসেল নিহত হলেন, শহিদ হলেন জাতির পিতাও। একটি জাতির অমিত সম্ভাবনারও মৃত্যু ঘটলো। কী অপরাধ ছিল রাসেলের? শিশুগুলোর? কী অপরাধ ছিল আরো যাঁরা নিহত হয়েছিলেন? বিসর্জন-আত্মত্যাগে যে বাঙালিকে মুক্তি এনে দিলেন, তারাই হত্যা করলো বঙ্গবন্ধুকে, সপরিবারে! শেখ রেহেনার উচ্চারণ- “বাংলাদেশের মানুষ আমার বাবাকে হত্যা করবে এ কথা ভাবতে পারিনি।” [Docudrama, Hasina: A Daughter’s Tale] এরকম হত্যাকাণ্ড এদেশে-কোনো দেশে ঘটা উচিত নয়। এটি অন্যায়, মহা-অন্যায়।
শিশু রাসেলসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে যে খুনিচক্র হত্যা করেছে, পরবর্তীতে (৩রা নভেম্বর) জাতীয় চার নেতাকে তারা হত্যা করলো। তারাই ক্যু-এর মাধ্যমে অসংখ্য সামরিক সেনাদের হত্যা করলো। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটালো। এরা অনবরত হত্যা, ষড়যন্ত্র ক্যু-এর রাজনীতিতে লিপ্ত। এরা লক্ষ-প্রাণ-সম্ভ্রমে পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের পতাকা যুদ্ধাপরাধীর হাতে তুলে দিয়েছে সানন্দে! ২০০১ সালসহ বহুবার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটিয়ে এরা অপরাজনীতি করছে। এরা আধুনিকতা বিবর্জিত, মৌলবাদের দোসর। এদের কাছে বাংলাদেশ কখনো নিরাপদ নয়। এরা যদি কোনো সুযোগে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তাহলে শুধু রাসেলের মতো শিশু নয়, সমগ্র জাতিরই ভূলণ্ঠন হবে।
অতএব, রাসেলের জন্মদিনে পৃথিবীর সকল শিশুর নিরাপদ জীবন, সকল মানবের নিরাপদ জীবনই আমাদের প্রার্থনা। অন্তত তাতে রাসেলের কোমল আত্মা একটু হলেও শান্তি পাবে।
যে শিশুটির বুকে ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন, যার অন্তরাত্মা জুড়ে ছিল নিখাঁদ ভালোবাসা, তাঁর প্রাণ অবিনাশী। সে শিশু এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর বুকের ভেতরে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো দীপ্তিমান।
রাসেল মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিল। ১১ বছরের তাজা প্রাণ আজ বনানী গোরস্থানে মায়ের কবরের পাশে। রাসেল মায়ের কাছেই থাকুক। বাংলা মায়ের বুকজুড়েই রাসেলের বাসস্থান।
লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; প্রাবন্ধিক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেদনার অশ্রুবিন্দু
পরবর্তী নিবন্ধপ্রস্তুতি ম্যাচে হেরেছে পাকিস্তান