‘সম্পূর্ণ নবতরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলনকে গল্প কাহিনী আর বাস্তবতার সাথে এর নতুন সম্পর্কের দিক নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আংশিক সংজ্ঞায়িত করা যায়। সুন্দর আর সত্যের দুটো পৃথক মানদন্ড রয়েছে, ডকুমেন্টরি আর গল্পকাহিনী। আপনি এর যে কোনো একটি নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। আমার সূচনাপর্ব ছিল ডকুমেন্টরি যাতে আমি গল্পকাহিনীর সত্যতার দিকটা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। চলচ্চিত্র নিছক একটা শিল্প নয় যা জীবনকে চিত্রায়িত করে, ক্যামেরা সামান্যমাত্র চিত্রলিপির একটা যন্ত্রবিশেষ নয়। চলচ্চিত্র জীবন এবং শিল্পের মধ্যবর্তী অধিকতর কিছু। আমি আমার ছবিগুলোতে এই ধারণাটাই বারবার দিয়ে যেতে চেষ্টা করেছি।
সত্যি বলতে কী, গল্প বলাটা আমি মোটেই পছন্দ করি না। গল্পকে আমি একটা চাদর হিসেবেই ব্যবহার করতে ভালোবাসি যার উপর আমি আমার নিজস্ব চিন্তাধারাগুলির সূচীকর্ম সম্পাদন করতে পারি। আর এজন্যেই কেবল প্রাথমিকভাবে আমি একটা গল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকি।
সব ছেড়ে নিজেকে আমি একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেই বিবেচনা করি। আমি প্রবন্ধ লিখি উপন্যাসের আঙ্গিকে অথবা প্রবন্ধের আঙ্গিকে লিখি উপন্যাস।’
‘আমার চলচ্চিত্র ভাবনা’ শীর্ষক এক লেখায় (অনুবাদ-নিবন্ধকার) জাঁ লুক গদার এভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন।
জাঁ লুক গদার যিনি ছিলেন ফরাসি নবতরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলনের একজন পুরোধা রূপকার। কিন্তু তিনি ছিলেন তাঁর অন্যান্য সহকর্মী (যেমন ত্রুফো, রেনে, ব্রেসোঁ, দেমি, ভার্দা, শ্যাব্রল, ক্লুজো)দের চেয়ে একেবারেই আলাদা। দর্শন, আঙ্গিক প্রয়োগ কোনো ক্ষেত্রেই যাঁর সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক নির্মাতা বন্ধুদের কাজের সঙ্গে কোনোই মিল ছিল না। সিনেমার প্রচলিত ধ্যানধারণাকে ভেঙে তিনি স্বতন্ত্র এক শৈলীর নির্মাণে সফল হতে পেরেছিলেন। কেবল ফরাসি চলচ্চিত্রের নয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গ আন্দোলনের এই প্রবাদ পুরুষ সিনেমার ভাষাকে বদলে দিয়েছিলেন রীতিমতো সাহসিকতার সঙ্গে। সমঝোতার কোনো পথ ধরে হাঁটেননি। নির্মাণ ব্যয় কমানোর জন্য এমন আখ্যান নির্বাচন করতেন যেখানে চরিত্র কম। সুটিং এর পৌনপুনিকতা হ্রাসের লক্ষ্যে সবসময় পেশাদার এবং নির্দিষ্ট অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতেন (জাঁ পল বেলমন্দো, আনা কারিনা, জাঁ লুই এ্যাঁতিনিউ, মিরিয়াম রাসেল, আনা ভিয়েজামস্কি, জাঁন সেবার্গ)।
সম্পাদনায় কাট-এর প্রয়োগ করতেন বেশি, ডিজলভ ও মিক্স এর পরিবর্তে। এর ফলে অবশ্য ছবির গতিও বেড়ে যেত। সর্বোপরি ছবির দৈর্ঘ্যও বেশি করতেন না। নির্মাণে (প্রি ও পোস্ট প্রোডাকশন এবং সুটিং) সময় ব্যয় করতেন কম। ফলে খরচ কমে আসতো অনেক। তাঁর দর্শক ছিলেন অত্যন্ত প্রাগ্রসর শ্রেণির এবং সংখ্যায় সীমিত। তাই নির্মাণ ব্যয় এবং সময়ের দিকে মনোযোগী থাকতেন বেশি। পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রতি অবারিত আগ্রহ শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থেকে গেছে তাঁর নির্মাণচর্যায়। ফলে গদারের একটি ছবির সঙ্গে অন্য আরেকটি ছবির কোনো সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
জাঁ লুক গদার বিশ্ব চলচ্চিত্রকে চরম একটা ধাক্কা দিয়েছিলেন বলা যায় তাঁর চিন্তাধারা, নির্মাণ কৌশল এবং প্রয়োগের নতুনত্বে ও আধুনিকতায়। এ কারণে তাঁকে ‘সিনেমার মর্ডানিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গল্প বলার প্রচলিত আঙ্গিককে বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এবং স্বতন্ত্র রীতি প্রবর্তনের কারণে ‘চলচ্চিত্রের প্রাবন্ধিক’ আখ্যাও পেয়েছেন তিনি। ‘চলচ্চিত্র দার্শনিক’ হিসেবেও অভিহিত হয়েছেন রাজনীতি, শিল্প সমাজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিদগ্ধ প্রসূত বীক্ষনের কারণে। অন্যভাবে সিনেমা দেখতে, অন্যভাবে সিনেমা নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছিলেন দর্শকদের। ফরাসি সিনেমাকে ভিন্ন এক উন্নত মাত্রায় সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে সিনেমা দুনিয়া। এসব যে নিরবচ্ছিন্নভাবে হয়েছে তা নয়। বারবার বিতর্কের শিকার হয়েছেন। সম্ভবত বিশ্ব চলচ্চিত্রে সবচাইতে বিতর্কিত পরিচালক ছিলেন গদার। কিন্তু ক্রমশ তাঁর গ্রহণযোগ্যতার পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বজুড়ে তাঁর বিশাল এক দর্শকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা তিনি অনুসৃত হয়েছেন সিনেমার দুনিয়ায়। তাঁর শৈলীর অনুসরণে বিভিন্ন মহাদেশে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে অনেক প্রতিভাবান পরিচালকের যাঁরা পরবর্তী সময়ে নিজেদের প্রকাশভঙ্গি গড়ে তুলতে সচেষ্ট ও সমর্থ হলেও বৃহত্তর অর্থে তা আদি ও অন্তে গদার ঘরানার আবর্তন।
তেমনি, চলচ্চিত্র সাহিত্যেও গদার নতুন ও আধুনিক ধারার প্রবর্তক। চলচ্চিত্র সমালোচনার প্রচলিত রীতিকে ভেঙে নতুন যে রীতির প্রবর্তন ঘটেছিল তাঁর হাতে ১৯৫০ এর শেষ দিকে সেই ধারা চলচ্চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রকে কেবল পরিবর্তন নয় আধুনিক, উন্নত এবং বিশেষভাবে বললে চলচ্চিত্রিক করে তুলেছে যা বিশ্বজুড়ে আজ সমাদৃত ও সুপ্রতিষ্ঠত। গদারের ছবির সংলাপগুলোও এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, সমসাময়িক সামাজিকতা তাঁর ছবির সংলাপের মধ্য দিয়ে এক অসাধারণ চলচ্চিত্র সাহিত্য বিনির্মাণ করেছে। বিশেষ করে পিয়েরে লে ফু, আলফাভিল, উইক এন্ড, ম্যাসকুঁলা ফেমিলা, লা পেতি সোলদাত, লা শিনোয়াজ, গুডবাই টু ল্যাংগুয়েজ এসব ছবির সংলাপ চলচ্চিত্র সাহিত্যের অনন্য সব উদাহরণ। গদার তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন বিশ্বনন্দিত ফরাসি চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘কাইয়ে দু সিনেমার’ চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে ১৯৫০ এর দশকের শেষ দিকে। সহ সমালোচক হিসেবে পেয়েছিলেন বাঁ রিভেত, রেনে, ক্রফো, শ্যাব্রল, রোমার এঁদের। যাঁরা পরবর্তীকালে একেকজন জাঁদরেল চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ‘আমার চলচ্চিত্র ভাবনা’ প্রবন্ধটির শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এখনও মূলত একজন সমালোচক ঠিক যেমনটি আমি ছিলাম আমার ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’র সময়গুলোতে। একমাত্র পার্থক্যটি হচ্ছে এই, সমালোচনা লেখার পবিরর্তে এখন আমি সমালোচনা চিত্রায়িত করি।’ (অনুবাদ-নিবন্ধকার)। জাঁ লুক গদারের জন্ম ১৯৩০ সালের ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে বাবা পল গদার ও মা ওডিল গদারের সংসারে। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। জাঁর জন্মের অল্পদিন পর পল সুইজারল্যান্ডের নিও শহরে স্থিত হন। লেক জেনেভার তীরবর্তী শহরটির চমৎকার একটি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ছিল। পল ও ওডিল ছিলেন সাংস্কৃতনুরাগী। তাঁরাও সে শহরের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সংযুক্ত হয়ে পড়েন। ফলে জাঁ লুক শৈশব থেকেই চমৎকার একটি সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠেন। তাছাড়া সুইজারল্যান্ডের এ-অঞ্চলে ফরাসি শিল্প সংস্কৃতির প্রাধান্য ছিল। যৌবনে প্যারিসে ফিরে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব চলচ্চিত্রেও পড়েছিল। যার ফলে সৃষ্ট নবতরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলন। ইতালিতে শুরু হয়ে তা ছড়িয়ে বিশ্বজুড়ে। গদার সংযুক্ত হন কাইয়ে দ্যু সিনেমা পত্রিকা ও গোষ্ঠীর সঙ্গে। তাঁদের ক্ষুরধার লেখনী চলচ্চিত্রকে নতুন দিগন্তের নিশানা দেয়। গদার চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে অর্থ সংগ্রহের কারণে প্যারিসের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সঞ্চিত অর্থে এবং বাঁধ নির্মাণের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম প্রামান্যচিত্র ‘অপারেশন বিটন’ বা ‘অপারেশন কনক্রিট’ নির্মাণ করেন ১৯৫৪ সালে। পর পর পাঁচটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পর ১৯৬০ সালে নির্মাণ করেন প্রথম কাহিনীচিত্র ‘ব্রেথলেস’। প্রথম ছবিতেই তিনি তাঁর জাত চিনিয়ে দেন। এরপর থেকে ২০১৮ সালে শেষ ছবি ‘দি ইমেজ বুক’ পর্যন্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও কাহিনীচিত্র মিলিয়ে মোট ১৩১টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন যা একটি রেকর্ড। বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবকটি গৌরবজনক সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। তম্মধ্যে কান, বার্লিন, ভেনিসের সর্বোচ্চ সম্মান এবং সিজার ও সামানিক অস্কার উল্লেখযোগ্য। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডের রোলে শহরে তাঁর প্রয়াণ সর্বাথেই চলচ্চিত্রের ‘গদার যুগ’ এর অবসান ঘটালো।
শেষ করি গদারের কথায়, ‘আইএম ট্রাইয়িং টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড।’ সত্যিই তাই। সিনেমার জগতটাকে তিনি বদলে দিয়েছিলেন। যে বদলের প্রভাব পড়েছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়।