আলাদা ফিতে আপত্তি

পৌরকর পরিশোধের পরও বর্জ্য নিতে ফি কেন, প্রশ্ন এলাকাবাসীর ।। দুই ওয়ার্ডে চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ

নগরের দুটি ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। ওয়ার্ড দুটি হচ্ছে ২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ এবং ৭ নং পশ্চিম ষোলশহর। বেসরকারিভাবে পরিচালিত হওয়ায় ওয়ার্ড দুটির বাসিন্দাদের তাদের বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য অপসারণের জন্য নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি আছে স্থানীয়দের। তারা বলছেন, চসিককে যে পৌরকর পরিশোধ করা হয় তার মধ্যে বর্জ্য অপসারণ রেইটও অন্তর্ভুক্ত আছে। তাই আলাদা ফি ধার্য করা নিয়ে প্রশ্ন তাদের।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে বর্তমান পর্ষদের ১১তম সাধারণ সভায়। এরপর আইন শাখা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির খসড়া তৈরি করে। পরবর্তীতে ‘চট্টগ্রাম ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড এবং ‘পাওয়ার সোর্স’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের বর্জ্য অপসারণ নিয়ে চুক্তি করে চসিক। গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে আগ্রাবাদে ধীরে ধীরে কার্যক্রম শুরু করে পাওয়ার সোর্স। কিন্তু ৮-১০টি আবাসিক এলাকার সমিতির আপিত্ততে সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকায় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ দিকে ২নং জালালাবাদ, ৪নং চান্দগাঁও, ৫নং মোহরা ও ৬নং পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডেও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
ফি’র পরিমাণ : চুক্তি অনুযায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তিনটি পৃথক রঙের বিন সরবরাহ করবে বাসা-বাড়িতে। এ জন্য এককালীন বিন গ্রহীতাকে পরিশোধ করতে হবে এক হাজার টাকা। অথচ চসিকের ডোর টু ডোর বর্জ্য অপসারণ প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালে বিনামূল্যে বিন সরবরাহ করা হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে এ সব বিন ক্রয় করে। অনেক প্রতিষ্ঠানও বিন দিয়ে সহযোগিতা করেছিল চসিককে।
এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসিক ভবন থেকে বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রতি ফ্ল্যাট থেকে মাসে ১০০ টাকা এবং সেমিপাকা ঘর থেকে ৫০ টাকা করে আদায় করবে। এ ছাড়া দোকান থেকে আকার ভেদে মাসে ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, শিল্প কারখানা থেকে মাসে তিন হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা, হোটেল ও রেস্তোরাঁ থেকে মাসে দেড় হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করতে পারবে। কনভেনশন হল, কমিউনিটি সেন্টার বা কোথাও মেজবান হলে প্রতি ১০০ জন অতিথির সৃষ্ট বর্জ্য থেকে ২০০ টাকা এবং সরকারি-বেসরকারি হাটবাজার, মার্কেটের উৎপন্ন বর্জ্যের অনুপাতে মাসে দুই হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা টাকা আদায় করবে। এ ছাড়া পুরাতন ভবন সংস্কার ও নতুন ভবন নির্মাণের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য অপসারণে টন প্রতি এক হাজার টাকা এবং ভ্রাম্যমাণ দোকানের উচ্ছিষ্ট খাদ্য, পরিত্যাজ্য ভোগ্য প্লেট, কাপ, ক্যান, মোড়ক, নারকেলের খোসা, শাকসবজি, ফলমূল ও যাবতীয় বর্জ্যের জন্য দৈনিক ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা আদায় করতে পারবে।
আপত্তির কারণ : উত্তর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা সোহেল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা যেহেতু পৌরকরের সঙ্গে পরিচ্ছন্ন রেইট পরিশোধ করি তাই সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব বর্জ্য অপসারণ করা। এখন আমরা পরিচ্ছন্ন রেইটও দিব আবার ফিও কেন দেব? একই বক্তব্য ষোলশহর ওয়ার্ডের বাসিন্দা করিমের।
জানা গেছে, বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের যে পৌরকর আদায় করে তার মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে উত্তর আগ্রাবাদে ৭ শতাংশ এবং পশ্চিম ষোলশহরে ৪ শতাংশ পরিচ্ছন্ন রেইটও আদায় করা হয়। তাছাড়া তৎকালীন মেয়রের উদ্যোগে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত ধাপে ধাপে বাসা-বাড়ি থেকে বিনামূল্যে ময়লা অপসারণে ‘ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চসিক। যা বর্তমানে গতি হারিয়েছে। সাধারণ লোকজন ডোর টু ডোর প্রকল্প আবারও পুরোপুরি কার্যকর করার দাবি করেন।
তাছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে আইনি বাধ্যবাধ্যকতা আছে মেয়রের ওপর। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিল এর ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে আবর্জনা অপসারণ, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া আছে। এতে উল্লেখ আছে, ‘কর্পোরেশন তার নিয়ন্ত্রণাধীন সকল জনপথ, সাধারণ পায়খানা, প্রস্রাবখানা, নর্দমা, ইমারত ও জায়গা থেকে আর্বজনা সংগ্রহ ও অপসারণ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কর্পোরেশন নগরবাসীর জন্য নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করবে এবং সাধারণ নোটিশের মাধ্যমে ওখানে ময়লা ফেলার জন্য নির্দেশ দিতে পারবে’। এছাড়া আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
চসিকের বক্তব্য : চসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম দৈনিক আজাদীকে বলেন, উত্তর আগ্রাবাদের পুরো ওয়ার্ডে আউটসোর্সিয়ের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ করবো। পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডে আংশিক হচ্ছে। উত্তর আগ্রাবাদে ৮-১০টি আবাসিক এলাকা আপত্তি জানিয়েছে। তাদের সবাইকে নিয়ে মেয়র মহোদয় বসবেন।
আপত্তির কারণ জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, আবাসিক এলাকাগুলোতে সমিতির মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। তারাও ফি আদায় করে। এখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে তাদের আয় হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আপত্তি জানাচ্ছে। তবে আইন অনুযায়ী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সোসাইটির কাজ না।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোবারক আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আইন অনুযায়ী নগরবাসীকে তাদের ব্যবহৃত বর্জ্য সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থানে রেখে আসতে হবে। সেখান থেকে কর্পোরেশন ময়লাগুলো নিয়ে যাবে। এ জন্যই তারা পরিচ্ছন্ন রেইট পরিশোধ করে। কিন্তু এখন তো বাসা-বাড়ি থেকেই সংগ্রহ করা হবে। এটার জন্য নামমাত্র ফি না দিলে তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংগ্রহ করবে না।
পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের এ কাউন্সিলর বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরো লোকবলের চাহিদা জানানো হলে মন্ত্রণালয় আউটসোর্সিংয়ের পরামর্শ দেয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে এলাকাভিত্তিক বর্জ্য সংগ্রহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হচ্ছে। শতভাগ বর্জ্য উৎসস্থল থেকে সংগ্রহের উদ্দেশে পর্যায়ক্রমে ৪১ টি ওয়ার্ডে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহের ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন আগ্রহী।
এ দিকে গত সপ্তাহে সিটি মেয়রের সঙ্গে উত্তর আগ্রাবাদের উত্তরা আবাসিক এলাকার নেতৃবৃন্দ সাক্ষাতে এলে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী তাদের বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আমরা আধুনিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে আনার চেষ্টা করছি। আপনারা ডাস্টবিন, রাস্তা ও ড্রেনে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না। বাসা-বাড়ি থেকে ডোর টু ডোর কর্মীগণ ময়লা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখবে। পরিবেশ সুন্দর, দুর্গন্ধ ও জীবাণুমুক্ত রাখতে বর্জ্য আবদ্ধ অবস্থায় সংগ্রহ করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরক্ষণাবেক্ষণের কারণে বন্ধ কাফকো ও সিইউএফএল
পরবর্তী নিবন্ধ১০ বছরের জন্য নিজেকে বিক্রির ঘোষণা