কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী বনাঞ্চলের ভেতর আরও একটি বন্য হাতির মরদেহের সন্ধান মিলেছে। বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী এই হাতিটির বয়স আনুমানিক ৬ বছর। দাঁতাল এই পুরুষ হাতিটি দুর্বৃত্তদের দ্বারা মারা হয়েছে এমন কোনো আলামত পায়নি বনবিভাগ। হাতিটির শরীরের কোথাও কোনো ধরনের জখমের চিহ্নও নেই। তাই হাতিটি শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণেই মারা পড়েছে বলে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের (ভেটেরিনারি সার্জন) ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে দাঁতসহ প্রয়োজনীয় অঙ্গ সংগ্রহের পর হাতিটিকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। বনবিভাগ জানায়, গত রোববার সকালের দিকে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের অধীনস্থ চকরিয়ার খুটাখালী বনবিটের গহীণ অরণ্য মধুরশিয়া বাগানের পাশে ইদ্রিসের ঘোনার ভেতর একটি বন্য হাতিকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায় বনকর্মীরা। এরপর ফুলছড়ি রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে আরও দুইজন ভেটেরিনারি সার্জন উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা মো. মুনতাকিম বিল্লাহ ও ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী চিকিৎসক হাতেম সাজ্জাদ জুলকার নাইম দুপুরের দিকে সেখানে ছুটে যান।
ফুলছড়ি রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাস বলেন, বন্যপ্রাণী চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আনুমানিক ৬ বছর বয়সের পুরুষ হাতিটি শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণেই মারা পড়েছে। ময়নাতদন্তের পর হাতিটির দাঁতসহ প্রয়োজনীয় অঙ্গ সংগ্রহের পর গর্ত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, অন্তত দুইদিন আগে অর্থাৎ গত শুক্রবার ওই হাতিটি সেখানে মারা যায়।
ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী চিকিৎসক হাতেম সাজ্জাদ জুলকার নাইম জানান, মারা যাওয়া বন্য হাতিটি মূলত ব্যাকটেরিয়াল সেফটি সেনিয়া ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছিল। ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় হাতিটির পেট কেটে যকৃতে (লিভার) সেটির আলামত মিলেছে।
বনবিভাগ এবং স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে, খুটাখালী বনবিটের মধুরশিয়াসহ আশপাশের এলাকাটি গহীণ অরণ্য। সেখানে বন্য হাতির আবাসস্থল। প্রতিনিয়ত সেখানে বন্য হাতির দেখা মিলে। গত শুক্রবার রাতে সেখানে দলবদ্ধ হয়ে হাতির পাল আসে। সেই হাতির পালের সঙ্গে মারা যাওয়া হাতিটিও এসেছিল এবং সেখানে শারীরিক অসুস্থ হয়ে সেখানে মারা পড়ে।
এদিকে কঙবাজারের বিভিন্ন বনাঞ্চলে গত দুইবছরে একে একে ১৯টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। তদ্মধ্যে বেশিরভাগ হাতির করুণ মৃত্যু হয়েছে মানুষের তৈরি করা ফাঁদে। বনের ভেতর অবৈধ বসতি, ফসল রক্ষায় পাঁতা বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়ে অসংখ্য হাতি মারা পড়েছে। আবার সরাসরি গুলি করেও হাতিকে হত্যা করা হয়েছে এখানে। শুধুমাত্র কঙবাজারের খুটাখালী বনাঞ্চলের ভেতর হাইথারা ঘোনা এলাকায় গতবছরের নভেম্বর মাসে দুটি বন্য হাতিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের একদল লোক বন্য শুকর শিকার করতে গেলে সামনে একটি বন্য হাতি পড়ে যায়। এ সময় প্রায় ১২ বছরের মাদি হাতিটির মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় বনবিভাগ মামলা করেন এবং একজনকে গ্রেপ্তারও করেন। একই এলাকায় আরো একটি বন্য হাতিকে বৈদ্যুতিক ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়। অপরদিকে ওইমাসে ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের গজালিয়া সাতঘরিয়া পাড়াসংলগ্ন ক্লিব্বা নামক এলাকায় মরদেহ মিলে বন্য হাতির। এটিকেও বৈদ্যুতিক ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়। অপরদিকে চকরিয়ার হারবাংয়ের উত্তর হারবাং এলাকায় বারবাকিয়া রেঞ্জের অধীনস্থ গহীণ বনের ভেতর বৈদ্যুতিক ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয় একটি পুরুষ হাতিকে। দলবদ্ধ হয়ে খাবারের সন্ধানে ধানক্ষেতে নামলে পরিকল্পিত বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়ে মারা পড়ে একটি বন্য হাতি। পরে সেটিকে মাটিচাপা দেওয়ার অন্তত চারদিন পর বনবিভাগ খবর পায়। এভাবেই একের পর এক বন্য হাতির হত্যার শিকার হয়ে আসছে কঙবাজার বনাঞ্চলে।
কঙবাজারে একের পর এক বন্যহাতি মারা যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। কঙবাজার এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ, কঙবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু দৈনিক আজাদীকে বলেন, গত দুইবছরে কঙবাজারের বিভিন্ন বনাঞ্চলে ১৯টি হাতির করুণ মৃত্যু হয়েছে। দুয়েকটি হাতির স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও পরিকল্পিতভাবে বৈদ্যুতিক ফাঁদের পাশাপাশি গুলি করেও হত্যা করা হয় বাকিগুলোকে। তারা বলেন, বনাঞ্চল দখলে নিয়ে সেখানে আবাদ করা ফলস রক্ষা এবং হাতির দাঁত বিক্রির জন্য ধারাবাহিকভাবে এই হত্যা চালানো হয়েছিল। তাই এশিয়ান হাতিগুলোর প্রাণ রক্ষায় বনবিভাগকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।












