সাহিত্যে নোবেল ও কথাসাহিত্যিক আনি এরনো

অনুপ দাশ গুপ্ত | মঙ্গলবার , ১১ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

এবারের (২০২২) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ফ্রান্সের লেখক ও কথাসাহিত্যিক আনি এরনো’র কোনো গ্রন্থ আমার পড়া নেই। আমার মতোই বাংলাদেশের কেউ পড়েছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি ফ্রান্সের মানুষের কাছে অতীব জনপ্রিয় লেখক। অন্তর্জাল ঘুরে যেটা দেখতে পেলাম তাঁর বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে প্রচুর এবং তিনি জার্মানি ও হাঙ্গেরীতেও বেশ পঠিত। এবার যেহেতু তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাই তাঁর লেখা উপন্যাসগুলো সারা বিশ্বে পঠিত হবে এবং আলোচনা হবে তা বলা যায়। সাহিত্যে নোবেল ও বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার নিয়ে পৃথিবীর বেশির মানুষের আগ্রহ থাকে। ওঠাই স্বাভাবিক। যেহেতু এটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আমারও নোবেল পুরস্কার কে কে পেলেন, কেন পেলেন, বা কী কাজের জন্য পেলেন সেই নিয়ে প্রতি বছর অক্টোবর আসলেই আগ্রহ ও কৌতূহলের সীমা থাকে না। তাই এসব নতুন নতুন নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে পড়াশোনায় নিমগ্ন থাকি। তথ্য উপাত্ত পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি। পত্র-পত্রিকা ও অন্তর্জাল ঘেঁটে এবারের সাহিত্যে নোবেল পাওয়া লেখক ‘আনি এরনোর’ সম্পর্কে বেশ চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেলো। ফরাসি এই কথাসাহিত্যিক (আনি এরনো) ১৯৯১ সালে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর উপন্যাস ‘সহজ কামনা’বা ইংরেজিতে ‘প্যাশন সিম্পল’। ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল-‘ কেবল ফ্রান্সেই এরকম একটি ক্ষুদ্রাবয়ব আত্নজৈবনিক উপন্যাস পাঠকের কাছে সমাদৃত হতে পারে’।
এই উপন্যাসটি ফ্রান্সের পাঠকের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কি ইংরেজী ভাষী বিশ্বে তেমন কোনো কদর লাভ করতে পারেনি। আলোচনায় আরও উল্লেখ করা হয়েছিল: তাঁর অপরাপর দু’টি উপন্যাস যথা ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘একজন পুরুষের জগৎ’ এবং ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ‘এক নারীর কাহিনি’ ফ্রান্সে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোনো সাড়া জাগায়নি।
আনি এরনোর আগে ফরাসি কোনো নারী লেখক বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার পাননি। আনি এরনোর জন্ম ১৯৪০ সালে, ফ্রান্সের নরমান্দিতে এক সাধারণ পরিবারে। তাঁর বাবা-মা একটি ক্যাফে আর মুদি দোকান চালাতেন। আনি এরনোর উপন্যাসগুলো পুষ্টি পেয়েছে ওই মধ্যবিত্ত আটপৌরে জীবন থেকেই। নিজের আত্নজীবনীতে আনি এরনো বলেছেন- ‘শরীর ও যৌনতা, নিবিড় সম্পর্ক, সামাজিক বৈষম্য আর শিক্ষার ভেতর দিয়ে শ্রেণি বদলের অভিজ্ঞতা, সময় ও স্মৃতি এবং এই যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁর লেখালেখির উপকরণ’। আনি এরনো ছিলেন সাহিত্যের ছাত্রী। পড়াতেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তাঁর লেখা আত্নজীবনীমূলক উপন্যাস -‘দ্য ইয়ারস’ ইন্টারন্যাশনাল ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ফ্রান্স, অন্যান্য ফরাসি ভাষী দেশে এবং ইউরোপে পরিচিত নাম হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আনি এরনো এখনও পর্যন্ত পরিচিত হয়ে ওঠেনি। আশা করা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এখন তাঁর গ্রন্থাবলীর আরো অনুবাদ হবে এবং সারা পৃথিবীতে দ্রুত পরিচিতি লাভ করবে।
আনি এরনোর জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি খুব ছোট বেলা থেকে নিয়মিত দিনলিপি লিখতেন। ১৯৭২ সালে একদিন তিনি উপন্যাস লিখতে বসে যান। উপন্যাস লিখবেন শুনে তাঁর স্বামী ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিলেন। তাই স্বামীকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে লুকিয়ে প্রথম উপন্যাসটি লিখেন আনি এরনো। যখন একটি নামকরা প্রকাশক উপন্যাসটি প্রকাশে সম্মত হলেন, তখন তাঁর স্বামী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। নিজের পক্ষে কিছু লেখা সম্ভব নয় বলে ক্রুদ্ধও হয়েছিলেন।
১৯৭৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘ক্লিনিড্‌আউট’ নামে। জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং অনিবার্য গর্ভপাতের কাহিনি, অপমান ও লোকলজ্জার ঘটনাকে অবলম্বন করেছেন তিনি এ উপন্যাসে। পরবর্তী প্রায় ৫০ টি বছর একে একে তিনি ২৪টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। কিছুদিন আগে প্রকাশ করেছেন নতুন উপন্যাস ‘একজন যুবকের কাহিনি’ আজ তাঁর অন্যতম পরিচয় এই যে, তিনি একজন আত্নজৈবনিক ঔপন্যাসিক। প্রতিটি উপন্যাসের উপজীব্য স্বীয় জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং গভীর পর্যবেক্ষণ। তিনি নিজের জীবনের গোপন এবং প্রকাশ্য খুঁটিনাটি নানা বিষয়কে একেকটি উপন্যাসের জন্য উপজীব্য করেছেন নি:সংকোচ সাহসিকতায়।
ষাটের দশকে, যখন আনি এরনোর বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ, তখন ভার্জিনিয়া উলফ পড়ে পড়ে তাঁর মধ্যে লেখালেখির তীব্র বাসনা তৈরী হয়। কাছাকাছি সময়ে আঁদ্রে ব্রেটনের ‘ফার্স্ট মেনিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম’ পড়ে লেখালেখির ও জীবনযাপনের একটি পথ রেখার সন্ধান পান। জর্জ পেরাকের রচনা কৌশলও তাঁকে বেশ ভাবিয়ে ছিল। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘আমি সর্বভূক পাঠক। আমার জীবনে একটি পর্যায়ে জার্মেইন গ্রিয়ারের ‘দ্য ফিমেইল ইউনাক’আমি পড়ি, যা আমার জন্য তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আমাকে তা প্রভাবিত করেছে, আমি যেভাবে লিখি, সেই লেখাকে। জ্যঁ পল সার্ত্রের-‘লা নমিয়ে’ সিমস দ্য বুভয়রের ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’;। চমৎকার লেখক ভার্জিনিয়া উলফ, তাঁকে আমি আবিষ্কার করি যখন আমার বয়স কুড়ির ঘরে। আরও আছেন জর্জ পেরি। কিছু বই আছে যা পড়ার পর মনে হয়েছে আমিও এমন করে লিখতে চাই’।
এই সব কিছু পড়ে তাঁকে চেনা-পরিচিত জগৎকে নতুন করে উপলব্ধির দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। ভার্জিনিয়া উলফের মতো তাঁরও মনে হয়েছিল, লিখতে হলে প্রথমে বর্ণনাতীত বাস্তবকে তীব্রভাবে অনুভব করে নিতে হবে। লেখালেখির লক্ষ্য হবে হৃদয়ের গভীরে অনুভূত বাস্তবকে সাহিত্যের নতুন কোনো ভাষায় উত্থাপন করা। বিশেষ কোনো কাহিনি কল্পনা ফাঁদার প্রয়োজন নেই; উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বিশেষ কতগুলো চরিত্রচিত্রণের প্রয়োজন নেই; বরং নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা ও অনুভবের মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে যা কিছু দরকার। এভাবেই তিনি আত্নজৈবনিক কাহিনি রচনার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর রচনা আত্নজৈবনিকতা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন উপন্যাস। কৈশোর থেকে নিয়মিত দিনপঞ্জি লিখেছেন আনি এরনো। দিনপঞ্জিতে উদৃত ঘটনাবলীর অনুপুঙ্খ বর্ণনা তাঁকে নিজ অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করেছে। ফ্রান্সের পাঠকমহল উপন্যাসের অবয়বে একজন নারীর অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণের অপরিশোধিত পরিবেশনা সাদরে গ্রহণ করেছে। তিনি অক্লেশে জীবনের গোপনতম ঘটনাকে উপন্যাসের কাঠামোতে উপজীব্য করেছেন। তাঁর কাছে উপন্যাস যাপিত জীবনের সাহিত্যিক রূপ।
১৯৮৮ সালে আনি এরনো সোভিয়েত রাশিয়ায় গেলে লেনিনগ্রাদে একজন তরুণ রুশ কূটনিতিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তখন ওই তরুণ রুশ কূটনৈতিকের কর্মস্থল প্যারিস। এরনোর বয়স ৪৮, তখন প্রেমিকের বয়স ৩৫। তাদের ১৮ মাস স্থায়ী প্রেমের কাহিনি নিয়ে ২০০১ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘হারিয়ে যাওয়া’ ইংরেজিতে যার নাম দেন-‘। Getting lost. যা গত মাসে মানে সেপ্টেম্বর’২২ এ ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ঘনিষ্ঠ মিলনের বর্ণনায় তিনি অকপট: ‘তিন ঘণ্টায় চারবার করেছি আমরা’; ‘বাৎসায়নের কামসূত্রে আছে, এমন কিছুই করতে বাকী রাখিনি’, ‘ওর বীর্যমাখা একটি জি-স্ট্রিং আমি আমার বালিশের নিচে রেখে দেব’। একস্থানে আমরা পড়ি; ‘হঠাৎ খেয়াল করে দেখি আমি আমার একটি কনট্যাক্ট লেন্স হারিয়ে ফেলেছি। ওর পুরুষাঙ্গের মাথায় খুঁজে পেলাম অবশেষে’। অকপটভাবে এরনো লিখেছেন:- ‘ও আসে সঙ্গম করে, ভদকা খায় আর স্তালিনকে নিয়ে বকবক করে’। -দিনলিপিতে লিখে রাখা এই কাহিনিই তিনি উপজীব্য করেছিলেন উপরোল্লিখিত ‘সহজ কামনা’(প্যাশন সিম্পল)উপন্যাসে।
সাহস ও তীক্ষ্ণ লেখনীর মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্মৃতির শেকড়, বিচ্ছিন্নতা ও সম্মিলিত অবদমন উম্মোচন করায় এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন ফরাসি লেখক আনি এরনো। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১৯ তম লেখক হলেন তিনি। যাঁর এখন বয়স ৮২ বছর।
নোবেল কমিটি তাদের ঘোষণায় বলেছেন, ‘ফরাসি এই লেখককে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তার ৫০ বছরের ‘আপসহীন’লেখার জন্য, যেখানে জেন্ডার, ভাষা ও শ্রেণিগত কারণে বিপুল বৈষম্যের শিকার হওয়া জীবনকে তিনি তুলে ধরেছেন। এই সাহিত্যিককে এ জন্য এক দীর্ঘ ও কঠিন পথে হাঁটতে হয়েছে’।
নোবেল জয়ের পরপরই এই লেখক বলেছেন- “লেখালেখি একটি রাজনৈতিক কাজ; যা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের চোখ খুলে দেয়। যে কারণে আমি ভাষাকে ‘ছুরি’ হিসেবে ব্যবহার করি। তাঁর মতে এই ‘ছুরি’ কল্পনার আবরণ ছিঁড়ে ফেলে”।
ফ্রান্সের নরম্যান্ডি নামক একটি গ্রামে নিম্ন বিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এরনো ফ্রান্সেই খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর আত্নজৈবনীমূলক ঘরনার ‘আ উইমেনস স্টোরি’ ‘আ ম্যানস প্লেস’ ও ‘স্পিম্পল প্যাশন’ বা ‘সহজ কামনা’ বিশ্বজুড়ে খ্যাতি এনে দেয়। ‘দ্য ইয়ারস’-এর জন্য ২০১৯ সালে তিনি বুকার পুরস্কারও পান। ফরাসি এই লেখকের অধিকাংশ লেখার সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের ঘনিষ্ট সম্পর্কের বিষয়টি অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটে ওঠে। তাঁর অনেক বই কয়েক দশক ধরে ফ্রান্সের স্কুলের পাঠ্যবইয়ের তালিকায় রয়েছে। এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে ‘আনি এরনোর’ লেখা বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করবে সেটা নিশ্চিত বলা যায়। তথ্য ঋণ : অন্তর্জাল, বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর সাথে সাক্ষাৎ ও স্মৃতিকথা
পরবর্তী নিবন্ধ৮০ বছর বয়সেও অমিতাভ শাহেনশাহ