ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ডলার সংকট এবং ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় মন্দার কবলে পড়েছে স্ক্র্যাপ জাহাজ ব্যবসা। সীতাকুণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠা শিপ ব্রেকিং শিল্পে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বাড়লেও পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। অনেক ব্যবসায়ী গা ঢাকা দেয়ায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে ধস নামায় দেশের ইস্পাত সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের লোহার খনি হিসেবে খ্যাত সীতাকুণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলের শিপ ব্রেকিং শিল্পে মারাত্মক সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে পুরানো জাহাজ আমদানি করে এখানে ভেঙে স্ক্র্যাপ করা হয়। এসব স্ক্র্যাপ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা ইস্পাত কারখানাগুলোতে ব্যবহার করে উৎপাদন করা হয় রড। কিন্তু পুরানো জাহাজের সংখ্যা ক্রমে কমছে। বিশ্বে শত শত জাহাজের আয়ুস্কাল ফুরিয়ে গেলেও ভাড়া বেশি হওয়ায় জাহাজ মালিকরা স্ক্র্যাপ করছেন না। তারা পুরানো জাহাজগুলো আরো কিছুদিন চালানোর পর স্ক্র্যাপ করবেন। আবার অনেকেই পুরানো জাহাজ মেরামত করে পরিচালনা করছেন। ফলে বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের সংখ্যা কমে গেছে। বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের পরিমাণ কমে যাওয়ায় দামও বেড়েছে ব্যাপকভাবে। প্রতিটন স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম ৩শ’ ডলার থেকে বেড়ে ৬৫০ ডলারে গিয়ে ঠেকে। হু হু করে বাড়তে থাকা দামে বহু ব্যবসায়ী জাহাজ আমদানি বন্ধ করে দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ঋণখেলাপি হওয়ায় দেশত্যাগ করেছেন। এতেও জাহাজ আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বন্দর এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) ৩৬টি প্রতিষ্ঠান ৬২টি জাহাজ আমদানি করেছিল। সে সব জাহাজ স্ক্র্যাপ করে ৪ লাখ ৭৭ হাজার টন লোহা পাওয়া যায়। যা স্থানীয় বিভিন্ন রি রোলিং মিলে রড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম তিনমাসে মাত্র ১৬টি প্রতিষ্ঠান ২৭টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করেছে। ছোট আকৃতির জাহাজগুলো ভেঙে ১ লাখ ২৬ হাজার টন স্ক্র্যাপ লোহা পাওয়া গেছে। এক বছরের ব্যবধানে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। সূত্র বলেছে, জাহাজ স্ক্র্যাপ করার সংখ্যা কমে গেছে। বড় জাহাজ খুব একটা স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে না। অপরদিকে যে সব বড় জাহাজ স্ক্র্যাপ হচ্ছে সেগুলোর এক একটির দাম কয়েক কোটি ডলার। বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা বড় আকৃতির জাহাজগুলো আমদানি করতে পারছে না। এক একটি জাহাজ আমদানি করতে কয়েক কোটি ডলারের এলসি খুলতে হচ্ছে। কিন্তু বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় দেশের ডলার ব্যবস্থাপনায় ত্রিশ লাখ ডলারের উপরের এলসি খুলতে বাংলাদেশ থেকে থেকে আগেই অনুমোদন নিতে হচ্ছে। এই অনুমোদন জুটানো অনেক কঠিন হয়ে উঠায় অনেক ব্যবসায়ী বড় জাহাজ আমদানি করতে পারছেন না। শুধু সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকই নয়, ব্যাংকগুলোও ডলার সংকটে বড় বড় এলসি খোলার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে। আবার স্ক্র্যাপ জাহাজের জন্য ইউপাস ঋণপত্র খোলার আনুষ্ঠানিকতা সারতেও লাগে দীর্ঘসময়। সবকিছু মিলে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গতকাল কয়েকজন ব্যবসায়ী দৈনিক আজাদীকে জানান, যেসব জাহাজ প্রতিটন ৩শ’ ডলারে আমরা কিনতাম সেগুলো এখন ৬শ’ ডলারের বেশিতে কিনতে হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ৬৫০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে জাহাজের দাম। এত চড়া দামে স্ক্র্যাপ কিনে তা বিক্রি করা যাবে কিনা, বাজার পরিস্থিতি এমন থাকে কিনা ইত্যাদি নানা কিছু যোগ বিয়োগ করেও বহু ব্যবসায়ী স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করছেন না। ব্যবসায়ীরা জানান, আগের বছর মাত্র ৪টি জাহাজ থেকে যে পরিমান স্ক্র্যাপ পাওয়া গিয়েছিল চলতি বছর ১৬টি জাহাজ থেকে তার থেকে কম লোহা পাওয়া গেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আগামীতে ইস্পাত কারখানাগুলোতে কাঁচামালের সংকট দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী জানান, বৈশ্বিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এমন অনিশ্চয়তার মাঝে ব্যবসা করা কঠিন বলেও তারা মন্তব্য করেন।