সদাশয় সরকার অর্থ আইন ২০২২ এর মাধ্যমে আয়কর আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে এনেছেন। ব্যক্তি করদাতাদের এই বিষয়ে জ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন। করদাতাদের সুবিধার্থে সংক্ষেপে পরিবর্তন ও সংযোজন সমূহ উপস্থাপন করা হলো :
০১) রপ্তানী হতে অর্জিত সর্বপ্রকার আয় ৫০% শতাংশ করমুক্ত।
০২) একজন ব্যক্তি করদাতা যিনি পূর্বে কখনোই রিটার্ন দাখিল করেননি, তার জন্য আয়বর্ষ শেষ হবার পরবর্তী ৩০ শে জুন কর দিবস হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ তিনি ৩০ শে নভেম্বর এর পরিবর্তে ৩০ শে জুনের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।
০৩) কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো আয়বর্ষে কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার কোনো ঋণ বা সুদ মওকুফ করলে তা উক্ত আয়বর্ষে উক্ত স্বাভাবিক করদাতার অন্যান্য উৎসের আয় হিসাবে পরিগণিত হবে না। এর ফলে মওকুফযোগ্য ঋণ বা সুদ করযোগ্য হবে না।
০৪) কোনো করদাতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৭% হারে কর পরিশোধ করে তার অপ্রদর্শিত বৈদেশিক সম্পদ প্রদর্শন করতে পারবেন এবং এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষ তাকে প্রশ্ন করতে পারবেন না। এটা কালো টাকা সাদা করার সুবর্ণ সুযোগ। এই ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সূত্রে বিদেশ থেকে টাকা আনতে হবে এবং উৎসে মূলে ব্যাংক ৭% কর কেটে প্রত্যায়ন পত্র ইস্যু করবে।
০৫) নিবাসী বাংলাদেশী করদাতার রিটার্নে অপ্রদর্শিত বিদেশস্থ সম্পদের জন্য জরিমানার বিধান সংযোজন করা হয়েছে। ফলে দেশী করদাতার বিদেশ স্থিত সম্পদ প্রদর্শন না করলে জরিমানা করার বিধান প্রবর্তিত হলো। করকর্মকর্তা বিদেশে তথ্যানুসন্ধান করতে পারবেন এবং রাজস্ব বোর্ড যে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।
০৬) পূর্বে সরকারি সিকিউরিটিজ এবং স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানীর স্টক ও শেয়ার হস্তান্তর হতে অর্জিত মুলধনী আয় কর অব্যহতি প্রাপ্ত ছিল এবং বর্তমানেও আছে। বর্তমান অর্থ আইনে শুধু মাত্র সরকারি সিকিউরিটিজকে কর যোগ্য করা হয়েছে। কিন্তু পরিপত্রে ভুল ভাবে শেয়ার হস্তান্তর হতে অর্জিত মূলধনী আয়কেও করযোগ্য বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে ইস্যুকৃত এস আর ও নং-১৯৬-আইন/আয়কর/২০১৫ তাং ৩০/০৬/২০১৫ অদ্যাবদি বলবৎ থাকায় ও ২০১০ সালের অর্থ আইনে স্টক ও শেয়ারকে ৩২(৭) ধারা হইতে বাদ দেয়া হয়েছে।
০৭) প্রকৃত বিনিয়োগের মধ্য হতে কর রেয়াতযোগ্য অংকের উপর ১৫% হারে কর রেয়াত প্রাপ্য হবেন কিন্তু যথা সময়ে রিটার্ন জমা না করলে রেয়াতের ৭.৫০% পাবেন এর ফলে করদাতা যথা সময়ে রিটার্ন জমা দানে অনুপ্রাণিত হবেন।
০৮) ৮২ সি (২) ধারায় বর্ণিত উৎস সমূহ হতে প্রাপ্ত আয় বা কর অব্যহতি প্রাপ্ত আয় বা হ্রাসকৃত কর হার প্রযোজ্য এমন আয় থাকলে তা ব্যতীত করযোগ্য মোট আয়ের ২০% রেয়াতযোগ্য বিনিয়োগ হবে।
০৯) যে সকল উৎসের আয় করমুক্ত বা হ্রাসকৃত হারে করযোগ্য সে সকল খাতের সকল প্রাপ্তি ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে করতে হবে। তবে ব্যক্তি খাতে মোট প্রাপ্তি ১ কোটি অতিক্রম না করলে বা কৃষি বা ফার্মি আয় থাকলে এই বিধি প্রযোজ্য হবে না।
১০) অভ্যন্তরীণ নৌযান ও বাণিজ্যিক যানবাহন পরিচালনা হতে নির্ধারিত হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে।
১১) উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রাপ্তি স্বীকার পত্র জমা না দিলে উৎসে কর্তন ৫০% বৃদ্ধি পাবে।
১২) ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে পেমেন্ট গ্রহণের ব্যর্থতায় উৎসে কর কর্তনের হার ৫০% বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংক ট্রান্সফারের সংজ্ঞায় ক্রসড চেক, মোবাইল ফাইন্যানসিয়াল সার্ভিস ও বাংলাদেশ ব্যাংক এর অনুমোদিত অন্য পন্থা ও বুঝাবে।
১৩) বাংলাদেশী মালিকানাধীন সমুদ্রগামী জাহাজের বিদেশী মুদ্রায় অর্জিত আয় উৎসে কর কর্তনযোগ্য হবে না ও জুন ৩০, ২০৩০ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি বলবৎ থাকবে। ফলে বাংলাদেশী সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকগণ জাহাজী ব্যবসা সম্প্রসারণে অনুপ্রাণীত হবেন।
১৪) রপ্তানীকারকের রপ্তানী মূল্য দেশে আনয়নকালে ব্যাংক ১% হারে উৎস কর কর্তন করবে যা পূর্বে .৫০% ছিল। ডলারের অবমূল্যায়ন ও কর্তনের হার বৃদ্ধি করায় কর দায় বেড়ে যাবে।
১৫) সরকার কর্তৃক স্পন্সর বা অনুমোদিত ডিপোজিট পেনশন স্কীম থেকে প্রাপ্ত সুদের উপর উৎসে কর কর্তন হবে না। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক আর্কষণীয় নামে মাসিক ডেপোজিট স্কীম চালু করেছে কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না থাকায় ঐ সব স্কীমের সুদ করযোগ্য হয়।
১৬) স্থাবর লিজ বা ইজারা ক্ষেত্রে ইজারা মূল্যের উপর ৪% হারে উৎসে কর কর্তন যোগ্য হবে।
১৭) সরকারি সম্পত্তি নয় এমন সকল জলাধারের ভাড়া মূল্যের উপর ৫% উৎসে কর কর্তন করতে হবে।
১৮) বাণিজ্যিক ভাবে পরিচালিত মোটরযান সমূহের ফিটনেস নবায়ন কালে ৩০ শে জুন তারিখের মধ্যে অগ্রিম কর পরিশোধ করতে হবে।
১৯) বহুকাল পর আবার ষ্পটে করদায় নির্ধারণ করার আইন পুনরায় চালু করা হয়েছে। উপকর কমিশনার পূর্বানুমতি সাপেক্ষে কোনো স্থানে বিধি মোতাবেক নতুন স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার ব্যবসা ও পেশা আয় নির্ধারণ পূর্বক কর আদায় করতে পারবেন। করদাতা এই ক্ষেত্রেও প্রারম্ভিক মূলধনের আইনগত সুবিধা প্রাপ্য হবেন। অর্থাৎ ঘোষিত আয়ের ৫ গুণ মূলধন হিসাবে প্রদর্শন করতে পারবেন।
২০) বকেয়া কর আদায়ের উপর কমিশনার করদাতার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বা অন্যান্য সেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন বা বন্ধ করার জন্য সরবরাহের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্দেশ দিতে পারবেন। এটা একটা ভয়ানক আদেশ যা নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারে।
২১) বর্তমানে ৩৮ টি সেবা গ্রহণে রিটার্নের প্রাপ্তি স্বীকার পত্র কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করতে হবে। তবে বিগত ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখ বিশেষ আদেশ বলে কর আরোপ যোগ্য আয় না থাকা সাপেক্ষে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ এবং শিক্ষার্থী ক্যাটাগরীতে ২ লক্ষ টাকা সীমা পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের ক্ষেত্রে তপসিলী ব্যাংক সমূহে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করেছেন।
লেখক : আয়কর বিশ্লেষক