সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তি বজায় রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | সোমবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

গতকাল মহালয়ার পর থেকে শুরু হয়ে গেছে দুর্গাপুজোর আবহ ও ক্ষণ গণনা। অতি প্রত্যুষে শঙ্খ ধ্বনি ও চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে, ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই চিরচেনা কণ্ঠের মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবীপক্ষের। আবাহন ঘটে দেবী দুর্গার। ধ্বনিত হয় আগমনী সঙ্গীত, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মর্ত্যলোকে। মহালয়া থেকে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা পৌঁছে যায় সনাতনী ভক্তদের কাছে। হিন্দুশাস্ত্র মতে কথিত রয়েছে যে, মহালয়া হচ্ছে সেই দিন যেদিন দেবী দুর্গা এই মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন এবং মহিষাসুরকে বধ করে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন। তাই শুভ শক্তির আরাধনায় মহালয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা দেখতে পাই, বাঙালিদের কাছে শারদীয় দুর্গাপূজা সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটি। এ উৎসব বর্তমানে সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। মহালয়ার প্রকৃত বার্তা সর্বজনীন উদারতা। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’-এই মনোভাব নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ব বৃহৎ এ ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
আগামী ১লা অক্টোবর ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে ৫ই অক্টোবর দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের পূজা উদযাপন। গত দুই বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দুর্গাপূজায় উৎসবের বিষয়ে ভক্তরা কিছুটা ছাড় দিয়েছিল। তাই এবার উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা করতে উন্মুখ। বাংলাদেশ পুজা উদযাপন কমিটির তথ্যমতে, এবছর দেশব্যাপী ৩২ হাজারেরও বেশি মণ্ডপে দুর্গামায়ের পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী যা গত বছরের তুলনায় প্রায় এক হাজার বেশি। গতবছর কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার ঘটনায়, নোয়াখালী, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় দশজন নিহত হয়েছিল। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এবারের দুর্গাপূজায় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা দেখি সরকারের পক্ষ হতে বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে, এবং সাথে সাথে কিছু শর্তারোপও করা হয়েছে। তার মানে এবছর নিরাপত্তার নানা শর্তের বেড়াজালে থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের আয়োজন করতে হবে বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ উৎসবমুখর পরিবেশে স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ করতে একধরনের বাধা প্রচ্ছন্নভাবে অনুভব করছে সনাতনী সমাজ।
একথা মানতে হবে যে, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার্থে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। তবে আমাদের সংবিধান ও বিদ্যমান আইনে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও এটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগে তা বিঘ্নিত হতে দেখি নানা কারণে। যেমন-সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ধর্মনিরপেক্ষতার পথে অন্তরায়। আরো দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক আচরণ ও মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারকে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ন করে। আমরা যখন দেখি সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সাম্প্রদায়িক হামলা গুলোর বিচারহীনতা চলে তখন তা হামলাকারীদের আরও হামলা করতে উৎসাহ যোগায়। এক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধী ও তাদের ইন্ধনদাতাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সামনের বছর নির্বাচন, তাই সরকারের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ এবারের পুজোয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আবার এসময়টা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ সহিংসতা সৃষ্টিকারী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসহ স্বার্থান্বেষী মহলের কাছেও। যারা সহিংসতা সৃষ্টি করে ফায়দা লুঠতে চায় তারা সুযোগ খুঁজবে। সরকারি নিরাপত্তায় নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি হলেও পাঁচদিনব্যাপী এ পুজোর পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ-এ কথা বলা যাবে না। এত লম্বা সময়ে দুর্ঘটনা যেকোনো সময় ঘটতে পারে। কুমিল্লায় কিন্তু ঘটেছিল একেবারে মধ্যরাত্রে। সুতরাং প্রথমত যা দরকার তা হলো সচেতনতা। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া যেতে পারে। সম্ভব সর্বোচ্চ জায়গায় সবসময়ের জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। সাধারণতঃ গ্রামাঞ্চলে দুর্গাপূজার যে মণ্ডপগুলো মন্দিরের ভেতরে বা সুরক্ষিত জায়গায় না হয়ে অস্থায়ী মণ্ডপ করে পূজা হবে, সেগুলো তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে। সরকার প্রায় দুই লাখের বেশি আনসার সদস্যকে নিরাপত্তার কাজে লাগাবে বলে আমরা শুনেছি। এদের পাশাপাশি প্রতিটি মন্দিরে নিজ উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের ও ব্যবস্থা করতে হবে, যারা আনসার বাহিনির সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে পারে। আরো যে ব্যাপারটি ইদানীং আমরা লক্ষ্য করছি সেটি হচ্ছে ‘গুজব’। সবাইকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক হতে হবে। কিছু শুনলে বা জানলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে অবহিত করতে হবে ও সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে।
আমরা দেখেছি প্রতি বছর পুজোর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সনাতনী নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দের মতবিনিময় সভা হয়। জানামতে গত বছরও হয়েছিল এবং সেসব বৈঠকে নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিলো। এবারও দেয়া হয়েছে। প্রত্যাশা এধরনের আশ্বাস শুধুমাত্র কথা দেওয়ার জন্য যেন কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। আমরা দেখেছি দেশের বিভিন্ন জেলায় গত বছর হিন্দুসম্প্রদায়ের মন্দির-পূজামণ্ডপ এবং বাড়িঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যে সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতা হয়েছিল, তারমধ্যে বেশি সহিংসতা হয়েছিল নোয়াখালী জেলার চৌমুহনীতে। সারাদেশে এধরনের বেশি সংবেদনশীল অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করে সরকার ও স্থানীয় পূজা উদযাপন পরিষদ যৌথ সমন্বয়মূলক বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এখন থেকেই তৎপর হতে হবে, যাতে যে কোনো ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা শুরুতেই নস্যাৎ করে দেওয়া যায়। আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার বিশেষ করে র‌্যাব ও পুলিশের আইটি সেলগুলোকে সক্রিয় হতে হবে, ফেসবুক বা অনলাইনে যেন কোনো ধরনের গুজব বা অপপ্রচার বিস্তার লাভ করতে না পারে। যে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বছরব্যাপী অনলাইনে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয় তাদের প্রতি এসময়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি। পাশাপাশি প্রতিমা বিসর্জনের দিন রাস্তা, জলাশয়, খাল ও নদী ঘাটসমূহে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। শহর এলাকায় বিসর্জনের সময়ও অনেক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এগুলো রোধকল্পে, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।
এধরনের প্রবন্ধ যখন লিখতে হয়, তখন মনে একধরনের চাপা কষ্ট অনুভব করি। নিজের অজান্তে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াই। কেন এগুলো লিখতে হবে? কেন উৎসব করতে নিরাপত্তা চাইতে হবে? পূজা, ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা-এসব কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির সুরক্ষায় হবে? ছোটবেলায় বা আজ হতে বিশবছর আগেও আমরা কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই পূজা করেছি। এখন নিরাপত্তা ছাড়া কেন পূজা করা যায় না? শুধু পূজার পাঁচ দিন শুধু নয়, আমাদের সারাবছরের নিরাপত্তাটা দিবে কে? পূজা শুরুর আগে এখন আমরা প্রতিদিনই প্রতিমা ভাঙচুরের খবর আসছে-এটাই বা থামাবে কে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। আমরা এমন একটা পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই, যেখানে পূজাসহ সামাজিক ও ধর্মীয় আয়োজনগুলো হবে নির্বিঘ্ন। যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তি বজায় রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা রাষ্ট্রের উপর আস্তা রাখতে চাই। পরিশেষে বলি, এবার দেবী আসছেন গজ বা হাতিতে চড়ে। সনাতন ধর্মমতে বিশ্বাস, বসুন্ধরা শস্যপূর্ণ করতেই এবার দেবীর আগমন। প্রত্যাশা শস্যপূর্ণ হোক ধরণী। সকল অশুভ শক্তি বিলুপ্ত হোক। এবারের পূজা হোক নির্বিঘ্ন ও পৃথিবী হোক শান্তিপূর্ণ। সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবে সর্বসাধারণের উৎসবে পরিণত হোক। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ আর উপভোগে সফল হবে উৎসব। উৎসবের আনন্দে ভরে উঠুক আমাদের সবার জীবন।

লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঢাকায় কুরিয়ার সার্ভিসের কাভার্ডভ্যানে বিস্ফোরণ একজন নিহত
পরবর্তী নিবন্ধপলাশ আচার্য