লাশঘরে নারীর নিরাপত্তা

আয়েশা পারভীন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

যুগ যুগ ধরে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছে ঘরে ও বাইরে। একটি পরিবারের নারী ও পুরুষের বসবাস কিন্তু কেউ জানে না কখন কাকে লাশকাটা ঘরে যেতে হয়। যখন যেতেই হয় তখন সেই ব্যক্তি ও মহিলা অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। লাশঘরে যাওয়া আর না যাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য সে তখন বুঝে না। লাশ কাটা ঘরে রাখা লাশের আত্মীয়-স্বজন বাইরে অপেক্ষায় থাকে। সে কী যে কষ্ট! আপনজনের লাশ এর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা। একসময় হয়ত সে অপেক্ষার পালা শেষ হয়। এখানে উল্লেখ্য; অনেক লাশের ক্ষত-বিক্ষত দেহগুলো আপনজনের কাছে প্রশ্নের জন্ম দেয়। আত্মীয়-স্বজন অভিযোগগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে জানায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আত্মীয়-স্বজনের সেই অভিযোগগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখে। অনেক দেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো চুরি করে ফেলা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সন্দেহজনক নমুনাও পাওয়া যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সমপ্রতি মৃত লাশের সাথে অনৈতিক ঘটনা প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে নারী লাশের সাথে যে ধরনের নোংরামির সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে তাতে আতঙ্কিত হওয়ার অপেক্ষা রাখে না। কিশোরী মেয়েদের লাশের সাথে যে নোংরামি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সবার মনে প্রশ্ন জাগে নারীরা কোথায় নিরাপদ? কোনো অপমৃত অথবা এক্সিডেন্ট হলে ময়না তদন্ত ও সুরতহাল করার জন্য লাশ মর্গে নেওয়া হয়। লাশঘরে মৃত লাশগুলো রাখা হয় একজন ডোমের দায়িত্বে। লাশগুলোর নিরাপত্তার সাথে সাথে লাশগুলোর মান মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারটিও একজন ডোমের দায়িত্বে থাকে।
লাশঘরে যাদের কিছুটা সময় রাখা হয় তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি সামপ্রতিক কালে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে নারীদের মৃতদেহ নিয়ে যৌনাচারের সংবাদগুলো বিবেককে নাড়া দেয়। একমাত্র বিকৃত মানসিকতার মানুষের পক্ষেই এ ধরনের কাজগুলো করা সম্ভব। লাশঘরে পড়ে থাকা নারীদের একটা অংশ ২০ থেকে ২৫ বছরের নিচে। এ বয়সী নারীর মৃতদেহগুলোর উপর চালায় বিকৃত লালসা। একজন বাবা ও ভাইয়ের কাছে তার মেয়ে ও বোনের নিরাপত্তার বিষয়টি সবসময় উদ্বিগ্নের ব্যাপার। সমাজে যারা বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত তারাও কারো বাবা- ভাই ও স্বামী। এমতাবস্থায় একজন মৃত নারীর দেহ যে এতটুকু অনিরাপদ তা কখনো ভাবাই যায় না। লাশঘরে অবস্থানরত লাশের উপর চালানো পাশবিক অত্যাচারের ঘটনাগুলো খুব বেশি মানুষ জানে না। কারণ একজন লাশের পক্ষে কোনো ধরনের অভিযোগ করা অসম্ভব। কিন্তু বাহিরে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনের অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়। তদন্ত সাপেক্ষে সত্য ঘটনা বেরিয়ে আসে। বিষয়গুলো বিবেককে নাড়া দেয়। পাশবিক ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য লাশ ঘরের কিশোর কিশোরীর মৃত লাশের সাথে ঘৃণ্য ও জঘন্য অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লাশঘরে যারা প্রবেশ করে তাদের চারিত্রিক সনদের বিষয়টি কতটুকু গুরুত্ব পায়; জানি না। তবে চারিত্রিক গুণাবলীর বিষয়টি শুধুমাত্র সনদ ও পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব না। তাছাড়া সত্যিকার অর্থে নিজেকে যতটুকু যাচাই করা যায় ঠিক ততটুকু অন্যের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব না। একজন ব্যক্তি জানেন; তিনি কতটুকু সৎ। তার মধ্যে থাকা অপরাধ প্রবণতা ও দোষত্রুটি শুধরানোর দায়িত্ব একমাত্র তার। অন্য কেউ কখনো শোধরাতে পারে না। তার মধ্যে কতটুকু অপরাধ প্রবণতা আছে ও কতগুলো দোষ ত্রুটি আছে অন্য কেউ কখনো জানতে পারে না। নিজের বিবেকের দংশনে নিজেকে শুধরাতে হয়। তবুও পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষায় যে নৈতিকতাবোধ ও জীবনবোধ জাগ্রত হয় তাতে সকল ধরনের অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা উচিত। বিবেকবর্জিত মানুষ কখনো পরিবার ও সমাজের জন্য সুখ শান্তি বয়ে আনতে পারে না। বরং একজন বিকৃত ও অসৎ ব্যক্তির জন্য পরিবারের সবাইকে অপমানিত হতে হয়। গ্লানি সহ্য করতে হয়। যেখানে জীবন্ত মানুষের নিরাপত্তা নেই বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে সেখানে একজন মৃত নারীর সাথে এমন ঘৃণ্য আচরণ হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা ও জীবনবোধের অবক্ষয়। অপমৃত্যুর লাশের সম্মান ও মর্যাদার অধিকার আছে। হোক না সেটা অপমৃত্যু। কোনো কারণে হয়তো এ ধরনের মৃত্যু হয়েছে। মানুষ নিজেকে খুব বেশি ভালোবাসে। তবু একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ ধরনের অপমৃত্যুতে যারা শেষ হয়ে যায় তারা সমাজ থেকে যেমন অসম্মান পায় তেমনি আপনজনের কাছেও ঘৃণার পাত্র হয়। একজন মৃত লাশের সম্মান বজায় রাখা একজন জীবন্ত মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে লাশের গোসল করানো দরকার। সুরতহাল অথবা ময়নাতদন্তের লাশ গুলোরও সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা দরকার। জীবন শেষে অন্তত মানুষ সত্যিকার মর্যাদার দাবি রাখে।
লাশঘরে যাদের কিছুটা সময় রাখা হয় সেই সময়টুকুতে বাইরে অপেক্ষমান আত্মীয়-স্বজনের উদ্বিগ্নতা -অস্থিরতা -অসহায়ত্ব চোখে পড়ার মতো। প্রিয়জনের লাশের জন্য তারা অপেক্ষা করেন। ভিতরে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপর তাদের অনেক ভরসা থাকে। সবসময় তারা একটা সুন্দর শেষের অপেক্ষায় থাকে। আমাদের দেশের লাশ ঘরে সাধারণত ব্যক্তি অর্থাৎ পুরুষ মানুষকে ডোম হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই পুরুষ ডোমই সব সময় পুরুষ এবং মহিলা লাশের সুরতহাল ও ময়না তদন্ত করে থাকে। এক্ষেত্রেও একটা বিরাট গলদ থেকে যাচ্ছে। নারীর লাশের জন্য নারী-ডোম নিয়োগ করলে এধরনের ঘটনা হতো না। নারী লাশের জন্য নারী ডোম নিয়োগের ব্যাপারে সরকারের প্রতি আকুল আবেদন রইল। মেডিকেল সাইন্স এর দিকে তাকালে জানা যায়; চিকিৎসক হতে হলে শিক্ষার্থী চিকিৎসকদের মানব দেহ নিয়ে লেখাপড়া করতে হয়। লাশের উপর গবেষণা করতে হয় অর্থাৎ মানব দেহের উপর তাদের সকল ধরনের গবেষণা করতে হয়। এক্ষেত্রেও তাদের লাশের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা প্রয়োজন। ময়না তদন্ত ও গবেষণার জন্য লাশের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৈতিকতার ও জীবনবোধের চর্চা করা অপরিহার্য। একটি মৃত লাশ হয়তো প্রতিবাদ করতে অক্ষম কিন্তু সত্য এক সময় অন্যভাবে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। লাশঘরে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সাথে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এ ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ,
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়ছে ডেঙ্গু : চাই সচেতনতা ও জরুরি পদক্ষেপ
পরবর্তী নিবন্ধঅপরিকল্পিত নগরায়ন ও খেলার মাঠে বাণিজ্যিক স্থাপনা : প্রাসঙ্গিক কথা