প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র মদিনায় বাদশাহ ফাহাদের স্মরণীয় অবদান

২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জাতীয় দিবস। বাদশাহ আবদুল আজিজ ১৯৩২ সালের এদিন তার অধিকৃত সমস্ত অঞ্চলকে নিয়ে সৌদি আরব নামকরণ করে রাজতন্ত্র ঘোষণা দেন। তারই ৪র্থ পুত্র বাদশাহ ফাহাদ এর পবিত্র মদিনায় অবদানের বিষয় নিয়ে আজকের প্রয়াস।
১৯৮২ সালে বাদশাহ খালেদ ইন্তেকাল করলে যুবরাজ থেকে পূর্ণাঙ্গ বাদশাহ হন ফাহাদ। তিনি হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে নানাবিধ অবদান রেখে গেছেন। সব অবদান কে ছাড়িয়ে গেছে পবিত্র মদিনায় নবী পাক (স.)’র যেয়ারতকারী আল্লাহর হাবিবের মেহেমানগণের কল্যাণ সাধনে কাজ করাকে। তিনি রাজতন্ত্রীয় ক্ষমতা লাভ করে মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে ১৯৮৫ সালে পবিত্র মসজিদে নববী বিশালভাবে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন। এতে শ্রম দেন তুরস্কের প্রকৌশলীসহ লোকবল।
১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মসজিদে নববীর নামাজীর ধারণ ক্ষমতা ছিল হয়ত ২০/২৫ হাজার নর-নারীর। এতে হজ্ব সিজনে, রমজানে ৫ ওয়াক্ত জামাত পড়তে মসজিদে নববী পেরিয়ে তিন দিকের রাস্তায়, হোটেল রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন দালানের অভ্যন্তরে জায়গা পেতে নামাজীগণের তৎপরতা প্রত্যক্ষ করা যেত।
এমনি প্রতিকূল অবস্থায় বাদশাহ ফাহাদ মসজিদে নববী বিশালভাবে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন। বর্তমান দক্ষিণপাশে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা মসজিদে নববী হল নবী পাক (স.) কর্তৃক নির্মিত মূল মসজিদ।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র.) ও হযরত ওমর ফারুক (র.) ছোটখাট মেরামত করেন। হযরত ওসমানগণি (র.) মসজিদে নববী প্রথম সম্প্রসারণ করেন। পরবর্তীতে ওমাইয়া, আব্বাসীয় আমলে ছোটখাট সম্প্রসারণ ও কাঠামোগত সংস্কার কাজ করা হয়। তুর্কি সুলতানেরা প্রায় ৪ শত বছর হেজাজ শাসনকালে মূল মসজিদে নববী মজুবত করে পুনঃ নির্মাণ করেন।
রওজাপাকসহ মসজিদে নববীর কাঠামো আজও বহাল রয়েছে। এখানে নামাজীর ধারণ ক্ষমতা হয়ত ৪-৫ হাজার জন হবে।
তুর্কি সুলতানগণের শাসনের শেষের দিকে এসে মসজিদে নববী উত্তর দিকে সম্প্রসারণ করেন। এতে মূল মসজিদে নববীর উত্তর সংলগ্ন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র.) খেলাফত পরিচালনার স্থান এবং এর প্রায় শত ফুট উত্তরে হযরত ওমর ফারুক (র.) খেলাফত পরিচালনার স্থানকে উন্মুক্ত রেখে মসজিদে নববীর উত্তর দিকে সম্প্রসারণ করা হয়। এ বর্ধিত কাঠামোতে পূর্বপাশে মহিলাগণের নামাজের ব্যবস্থা রাখা ছিল। তুর্কি সুলতানগণের বর্ধিত অংশসহ মসজিদে নববীর মডেল ইস্তাম্বুলের তোপকাপি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
বাদশাহ আবদুল আজিজ ১৯২৪ সালে হেজাজ দখলের পর নবী পাক (স.) আমলের মসজিদে নববীকে অক্ষত রেখে উত্তর দিকে তুর্কি সুলতানগণ কর্তৃক নির্মিত মসজিদে নববীর পুনঃ নির্মাণ করেন। মূল মসজিদে নববী এবং তুর্কি সুলতান কর্তৃক উত্তর দিকে সম্প্রসারিত মসজিদে নববীর চারদিকে রাস্তা ছিল। রাস্তাটির প্রস্থ ১৫-২০ ফুট হবে। এই রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট বাস টেক্সি চলাচল করত। এ রাস্তার চারিদিকে পবিত্র মদিনাবাসীর বাড়ী ঘর, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ছিল। এরই মধ্যে পূর্ব উত্তর দিকে চান্দ মিয়া সওদাগরের মুসাফিরখানা এবং এর ২/৩ শ মিটার পূর্ব উত্তর দিকে ইসলাম খানের মুসাফিরখানা ছিল। এখানে ঘরগুলোর মধ্যে অনেক ঘর পুনঃ নির্মিত হয়ে ৫/৭ তলা বা ৮/১০ তলা দালান ছিল। বাকী অবশিষ্ট ঘর বাড়ি ৩/৪ তলা বিশিষ্ট মাটির নির্মিত খেজুর গাছের বিমের সহযোগিতায় ছাদ দেয়া।
সম্ভবত ১৯০০ শতক ত বটেই হয়ত ১৮০০ শতকেও এমনি পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। এমন অবস্থায় মসজিদে নববীতে ধারণ ক্ষমতা ছিল প্রায় ২০/২৫ হাজার জনের। অবশ্য শত বছর আগের হজ্বযাত্রীর সংখ্যা ছিল লাখের কম বেশি। তার অন্যতম কারণ যাতায়াত প্রতিকূলতা ও নিরাপত্তার অভাব। কিন্তু ১৯০০ শতকে এসে হজ্বযাত্রীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯৫০ এর দশক থেকে এ হজ্বযাত্রীর সংখ্যা দ্রুততার সাথে আরও বাড়তে থাকে। ১৯৮০/৯০ এর দশকে এসে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ নর-নারী হজ্ব করতে ছিল। ফলে পবিত্র মদিনায় যেয়ারতকারীর ব্যাপক সমাগম হত। যারা ১৯৭০/৮০ এর দশকে পবিত্র মদিনায় যেয়ারতে গেছেন তাদের স্মরণে থাকার কথা মসজিদে নববীতে ৫ ওয়াক্ত জামাত পড়তে কি রকম প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হত। তিন দিকে রাস্তায় হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানে মানুষের ঘরে নামাজীগণ ঢুকে যেতে বাধ্য হতেন জায়গার অভাবে।
এমনি অবস্থায় ১৯৮৫ সালে বাদশাহ ফাহাদ মসজিদে নববী বিশালভাবে সম্প্রসারণে হাত দেন। পূর্ব দিকে জান্নাতুল বাকী পর্যন্ত সমস্ত অবকাঠামো ভেঙে ফেলা হয়। দক্ষিণ দিকে ৩/৪ শ’ মিটার এবং উত্তর ও পশ্চিম দিকে প্রায় ৪/৫ শত মিটার করে সমস্ত অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হয়। অতঃপর দক্ষিণ দিকে মূল মসজিদে নববী তথা তুর্কি হেরেমকে দক্ষিণ দিকে সামনে রেখে বাদশাহ আবদুল আজিজ হেরেমের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর তিন দিকে মজবুতভাবে ফাউন্ডেশন দিয়ে বিশালভাবে সম্প্রসারণ কাজ শুরু করেন তুর্কি প্রকৌশলীসহ তাদের শত শত লোকবল এর মাধ্যমে। ১৯৮৫ সাল থেকে এক নাগাড়ে ১১ বছর কাজ চলমান থাকে।
এরই মধ্যে পবিত্র মদিনার শহরে মনে হয় শতভাগ অবকাঠামো ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। শুধু মাত্র মসজিদে নববীর উত্তর দিকে ওবরাই হোটেল ও গ্রীণ প্যালেস হোটেল অক্ষত ছিল। পরবর্তীতে গ্রীণ প্যালেস হোটেলও ভেঙ্গে ফেলা হয়। মসজিদে নববীর দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর দিকে যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে ১৫/২০ তলা উচ্চতায় ৪০/৫০ টি হোটেল নির্মাণ করা হয়। স্টারমানের এসব হোটেলের নিচের তলায় মার্কেট, ছোটখাট অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। এক কথায় বাদশাহ ফাহাদ পবিত্র মদিনা নগরীকে নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন। তেমনিভাবে মসজিদে নববীকে ৮/১০ গুণ বড় করে দৃষ্টিনন্দনভাবে সম্প্রসারণ করে দিয়ে গেছেন।
পবিত্র মক্কার মসজিদুল হারমে জমজমের পানি পান করতে হয়ত ভিড় ঠেলে জমজমের কূপে হতে হবে অথবা ১ রিয়াল দিয়ে ১ গ্লাস কিনে পান করতে হত। পবিত্র মদিনায় জমজমের পানি পানের ব্যবস্থা ছিল না। বাদশাহ ফাহাদ পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনায় জমজমের পানি আনার ব্যবস্থা করেন। এ পরিবহনে যাবতীয় স্বাস্থ্য সম্মত সুরক্ষা করা হয়। মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে জায়গায় জায়গায় ৩/৪ টি বা ৪/৫ টি করে দামী দামী কন্টেইনার বসানো থাকে। সাথে ওয়ান টাইম গ্লাস। এই কন্টেইনে একপাশে অব্যবহৃত এবং অপরপাশে ব্যবহৃত গ্লাস রাখা দেখতে পাবেন। প্রতিদিন হাজার হাজার গ্লাস ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদে নববীতে খেদমতের জন্য বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ভাগ করা আছে। তৎমধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিভাগ, জমজমের পানি সরবরাহ বিভাগ ইত্যাদি। ফ্লোরে দামী কার্পেট, আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যথোপযুক্ত বৈদ্যুতিক লাইন যেয়ারতকারীগণের দিল মন যেন খোশ হয়ে যায়। যেখানে ধারণ ক্ষমতা ছিল ২০/২৫ হাজার যেখানে বর্তমানে ৬/৭ লাখ নর-নারী যেয়ারতের পাশাপাশি অতি আরামে এবাদত বন্দেগী করতে পারছেন।
বর্ধিত অংশের উত্তর-পূর্ব দিকে ও উত্তর-পশ্চিম দিকে সম্পূর্ণ ঘেরা দিয়ে মহিলাগণের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মহিলাগণের এবাদতের পূর্ব-উত্তর এরিয়া থেকে দিনে ৩/৪ বার যেয়ারতে আসতে পারে সেজন্য আলাদা খাদেম গ্রুপ রাখা আছে পার্টিশন দেয়ার জন্য।
বর্তমান মসজিদে নববীর চতুরদিকে উঠানের নিচে টয়লেট, গাড়ির পার্কিং বানানো হয়েছে। এ চতুরদিকে হাজার হাজার টয়লেট দেখবেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
মসজিদে হারমের পাশাপাশি মসজিদে নববীতে যেয়ারতকারীগণের সেবাদান করতে, আরাম দিতে হাজারের অধিক বিদেশী খাদেম নিয়োজিত। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে শতের অধিক প্রধান, উপ প্রধান সৌদি নাগরিক কর্মতৎপর দেখবেন।
মসজিদে নববীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভাববার বিষয়। প্রায় ২/৩ কি.মি দূূরে পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল আকারের অবকাঠামো বসানো হয়েছে। ওখান থেকে একাধিক পাইপের মাধ্যমে মসজিদে নববীতে কানেকশন দেয়া হয় ঠান্ডা বাতাস পেতে।
মসজিদে নববীর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাও অসাধারণ। দেয়ালের ভিতর বাল্ব, উপরে আয়নার কভার। তেমনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও অসাধারণ দেয়ালের ভিতর। অর্থাৎ আমাদের দেশের মত এসি লাইট বাহির থেকে দেখা যাবে না।
শত বছর বা তারও অধিক আগে থেকে মসজিদে নববীর চারকোণে ৪টি মিনার ছিল। ১৯৮৫ সালে সম্প্রসারণের পর আর ৬টি মিনার নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে মসজিদে নববীতে ১০টি মিনার। এ ১০টি মিনার খুবই সুউচ্চ।
অর্থাৎ বাদশাহ ফাহাদ প্রশাসন মসজিদে নববীর শত বছর বা তারও আগের অবকাঠামোতে পরিবর্তন পরিবর্ধন আনেন নাই। কিন্তু এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বৈদ্যুতিক লাইটের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তেমনিভাবে দক্ষিণ দিকে মূল মসজিদের নববীর শত বছর বা তারও অনেক আগের পিলারগুলো মজবুত ধরে রাখার জন্য নিচের দিকে পৃথক ঢালাই দেয়া হয়েছে।
বাদশাহ ফাহাদ ১ আগস্ট ২০০৫ সালে ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলে যুবরাজ আবদুল্লাহ বাদশাহ হন। তিনি ২০০৫ সালে ইন্তেকাল করলে বর্তমান সালমান বিন আবদুল আজিজ বাদশাহ হয়ে আজও বর্তমান। বর্তমান বাদশাহ সালমান বাদশাহ ফাহাদের সহোদর ছোট ভাই। তাদেরকে সুদাইরী সেভেন বলা হয়। তাদের নানার গোষ্ঠী রিয়াদে অতি প্রভাবশালী। তাদের ৭ ভ্রাতার ২ ভ্রাতা সুলতান ও নায়েফ যুবরাজ থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। বস্তুত বাদশাহ ফাহাদ সরকার মসজিদে নববীসহ পবিত্র মদিনা নগরীকে নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবিজিসি ট্রাস্ট ভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের কর্মশালা