গৌরবের চট্টগ্রাম, হাজার বছরের চট্টগ্রাম

অভীক ওসমান | রবিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কর্ণফুলীর ওপারে শিকলবাহা, কোলাগাঁও, চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা ও জুলধার খোয়াজনগর, ইয়ানগর, চরফরিদ, চরলক্ষ্যা, ডাঙ্গাচর, দ্বীপকালামোড়, লাখেররার ভগ্ন রাস্তা, আর শিল্প-সংস্কৃতির পশ্চাদপদতা দেখলে ইতিহাসও অভিসম্পাত দিবে। কারণ এসব অব্জল হাজার বছরের চট্টগ্রামের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এক সময় এসব অঞ্চলে কর্ণফুলীর হয়ে পর্যটক, ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারকরা চট্টগ্রামে আসতেন। জাহাজ তৈরির জন্য ব্যবসায়ীরা শিকলবাহা ও কোলাগাঁওকে পছন্দ করতেন বেশি। আজ কিন্তু এসব অঞ্চলের অবস্থা দেখলে মনে হবে কত অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার এসব অঞ্চলের মানুষ। এছাড়া শহরতলীর উত্তর-পূর্ব দিকের বোয়ালখালী, কুয়াইশ-বুড়িশ্চর- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট, সলিমপুর এলাকার অবস্থাও একই। (আবু তালেব বেলাল, দুর্বার বাংলা, ২০২২)
আরব বণিকরা বাণিজ্যের সুবাদে আসলেও তারা ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হালদা নদী ও কর্ণফুলীর মিলনতলায় কর্ণফুলীর উপরে বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার প্রবর্তনকারী মেধসমুনির মন্দিরে সহজ যাতায়াতের পথও কালুরঘাট। শাহ সুজার আরকান পালানোর হাত ধরে সড়ক যোগাযোগের অবতারণা। শাহ সুজা পালানোর সময় পেয়াদারা যে সড়ক নির্মাণ করেন, তা এখনো আরকান সড়ক নামে পরিচিত। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব-পশ্চিমে আরকান সড়কের মিলন ঘটায় কালু নমের কোন খেয়াঘাটের মাঝি। পরবর্তীতে তার নাম অনুসারে কালুরঘাট নামের প্রচলন।
কর্ণফুলীর পশ্চিম পাড়ে গড়ে তুলে ভারী শিল্পাঞ্চল। যেখানে বিনিয়োগ করে দেশি-বিদেশি শিল্প উদ্যোক্তা। সেখানে বহুজাতিক প্রসাধনী কোম্পানী লিভারব্রদার্স গড়ে তোলে দেশের বৃহৎ প্রসাধনী শিল্প। তা ছাড়াও পেপসি, কোকাকোলা, আরামিট ঔষধ, মুদ্রণ, দেশের রংশিল্পের নেতৃত্বদানকারী বার্জার, মুনস্টার পেইন্ট ছাড়াও দেশের গ্লাস শিল্পের পথিক ওসমানিয়া গ্লাস ফ্যাক্টরি। আজ টেনারি শিল্প কালুরঘাটের জন্য শুধুই ইতিহাস। (্‌এস এম ওসমান, দুর্বার বাংলা, ২০২২)
আমদানী
কর্ণফুলী ও সমুদ্র বন্দরের কারণে দেশের সিংহভাগ আমদানী অর্থাৎ ৬০ থেকে ৮০% চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা করে থাকেন। এখানে খাতুনগঞ্জের ভূমিকা মুখ্য। স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমদানী সংকটে পড়ে। ৭৫ এর পরবর্তী পর্যায়ে অবাধ আমদানী নীতি ঘোষণা করা হয়। এরশাদ আমলে কিছু এক্সপোর্ট হাউস গড়ে উঠে। যার সূবিধা মূলতঃ ঢাকা এক্সপোর্ট হাউসগুলো নিয়েছে। যারা এক্সপোর্টের বিপরীতে আমদানীও করতে পারতো। মূলতঃ সে সময় চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারী আমদানীকারকদের জন্য যে সুবিধাটা প্রচলিত ছিল তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এতে করে ক্ষুদ্র ও মাঝারী আমদানীকারক তথা ব্রোকার শ্রেণির বাঙালি ব্যবসায়ীদের বিলুপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে ওয়াল ষ্ট্রিট খ্যাত খাতুনগঞ্জে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য খাতুনগঞ্জের আমদানীকারকরা আমদানী করতে থাকেন। গড়ে উঠে বড় বড় কর্পোরেট হাউস সমূহ। চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম জানাচ্ছেন খাতুনগঞ্জে দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাজগরীয়া পরিবারের দেশত্যাগ, চেক ডিসঅনার হওয়া সহ বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া সমপ্রতি একটি গোল টেবিল বৈঠকে তারা নিম্নোক্ত সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করেছেন। নৌপথে বাণিজ্য পুনরুদ্ধার ও সমপ্রসারণের জন্য কর্ণফুলি নদী কার্যকরভাবে খনন এবং চাক্তাই খালসহ শাখা খালগুলো নৌযান চলাচলের উপযোগী করে তোলা। খাতুনগঞ্জের দক্ষিণে পাথরঘাটা, আশরাফ আলী সড়ক, উত্তরে দেওয়ান বাজার, পূর্বে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা। জলাবদ্ধতা নিরসনে চাক্তাই – রাজাখালী খালের মুখে জলকপাট (স্লুইচগেট) নির্মাণ ও দ্রুত সময়ের মধ্যে বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী নগরের বিপ্লব উদ্যান থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের ঘরে নিয়ে আসা। কর্ণফুলি নদীর তীরে চাক্তাই এলাকায় সরাসরি খাস জমিতে ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ। বিদ্যুৎ, সড়ক, গ্যাসের সংযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া চাক্তাই খাল খনন ও সংস্কারে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন। কর্ণফুলি নদীর তীর দিয়ে সদরঘাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ ও নৌঘাট চালু। আরএস জরীপ অনুযায়ী চাক্তাই খালকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমূহ এর সমাধান পূর্বক খাতুনগঞ্জের পূর্ব ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে।
অন্যান্য খাতে বাণিজ্য
শিপিং, স্টিভিডারিং, বার্থ অপারেটর, সিএন্ডএফ এজেন্ট, শিপ সেন্ডলার, লাইটারেজ জাহাজ, ইনডেন্টিং, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, গুদাম ও মজুদকরণ, রিকন্ডিশন গাড়ী ব্যবসা, আবাসন শিল্প, পরিবহন সহ বহুমুখী বাণিজ্য খাত বিকশিত হয়েছে। তাছাড়া ঝুট ব্যবসা, প্রকাশনা, কমিউনিটি সেন্টার, ডিজাইনিং, বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড ইত্যাদি অনেকগুলো ইনফরমাল সেক্টরে বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের যাত্রা শুরুঃ মূলতঃ আশির দশকের শেষ দিকে এসে চট্টগ্রামে ২য় স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে সিলেটেও তার শাখা খোলা হয়।
রপ্তানি
বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মুখ্য সচিব, ডাইনেমিক পারসোনালিটি সম্পন্ন নুরুল কাদের খান চট্টগ্রামে প্রথম দেশ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করে। পাট বা সোনালী আঁশ ছিল বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানী পণ্য। সেক্ষেত্রে তৈরী পোশাক শিল্প রপ্তানী বাজার তথা বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতির মধ্যে বিপ্লব সাধন করেছে। বিজিএমইএ চট্টগ্রামের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন চট্টগ্রামে প্রায় ৫০০ গার্মেন্টস উৎপাদনে রয়েছে। তাছাড়া হিমায়িত খাদ্য বা ফ্রোজেন ফুড্‌স দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকা পর্যত হ্যাচারী ও সংশ্লিষ্ট শিল্প সমূহ বিকাশ লাভ করে। বর্তমানে চট্টগ্রামে দেড় হাজার কোটি টাকার ফ্রোজেন ফুডস রপ্তানি হয়ে থাকে।
বিজিএমইএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট এম এ সালাম জানিয়েছেন, ইপিজেড-সহ আরএমজি সেক্টরে তিন শতাধিক কারখানা চালু হয়েছে। সরকার শুরুতেই তাদের প্রণোদনা দিয়েছে। চট্টগ্রামে চা পাতার উৎপাদন আশাব্যাঞ্জক বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে।
কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ঘাটতি পূরণ করা যায়, তা ভাবতে হবে। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বহুমুখিকরণ হলো এ সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায়।
আমরা ইতোমধ্যেই ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি, ইস্পাতজাত সামগ্রী, পাটের তৈরি চট, বস্তা, চা, হিমায়িত মাছ, প্রক্রিয়াজাত শাক-সবজি, মাংস ও বিভিন্ন ধরনের অপ্রচলিত দ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে পারি। শ্রমশক্তি রপ্তানির ঘাটতি পূরণের জন্য আমরা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে পারি। এজন্য কোনো প্রাইভেট সেক্টরের ওপর এ দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায়।
বিপণন
এক সময় পণ্য বিপণনে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট (বিপণী বিতান) ও রেয়াজউদ্দিন বাজার ছিল চট্টগ্রামে শীর্ষ পণ্য বিপণন কেন্দ্র। এখন অবকাঠামো ও প্রযুক্তির গুণে বহুধা বিস্তৃত হয়েছে বিপণনের কেন্দ্র সমূহ। টেরীবাজার থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৭টি জেলায় বস্ত্র বিপণন করা হয়। তাছাড়া সানমার সিটি, ইউনোস্কো, আখতারুজ্জামান সেন্টার, দেশী দশ সমৃদ্ধ আফমী প্লাজা, মিমি সুপার মার্কেট, লাকী প্লাজা, সেন্ট্রাল প্লাজা, সিংগাপুর ব্যাংকক মার্কেট, চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স সহ আরো অনেক বিপণন কেন্দ্র। তার সাথে যুক্ত হয়েছে আড়ং, আগোরা, স্বপ্ন, স্বদেশ পল্লী, বাস্কেট, শপিং ব্যাগ ধরনের হাউসগুলো। তাছাড়া প্রত্যেকটি আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে বিপণন কেন্দ্র, এমনকি বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ীর নীচে থাকছে ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর। জুয়েলারি এলাকা হাজারী লেইন হয়ে উঠে ঔষধের পাইকারী বাজার। কাজীর দেউড়ি, ফলমূল মার্কেট, কাঁচা বাজারে নতুন সংযোজন।
বিনিয়োগ-শিল্পায়ন
বিনিয়োগ বোর্ড সূত্র জানাচ্ছে চট্টগ্রামে প্রায় ৩০০০ শিল্প ইউনিট নিবন্ধিত হয়েছে। বাংলাদেশের শুরুতে শিল্প কল-কারখানা সমূহ রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশ শুরু হতে থাকে। চট্টগ্রামে সিমেন্ট, সিআই সীট, রি-রোলিং মিলস, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি খাতে বেশ কিছু শিল্প গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পূর্বে বিসিক যেসব শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছিল, স্বাধীনতার পরে আর কোন শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেনি। তবে চট্টগ্রামে প্রথম ইপিজেড, ষ্টীল মিল্‌সকে পরিত্যক্ত করে কর্ণফুলি ইপিজেড গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এতে করে শিল্প চাহিদা কোনো মতেই পূরণ হচ্ছেনা। দক্ষিণ চট্টগ্রামে ২৭০০ একর এলাকা জুড়ে দেশের প্রথম প্রাইভেট ইপিজেড কোরিয়ান ইপিজেড গড়ে তোলা হয়েছে। নভেম্বর ২০১১ তে একাধিক সু-ফ্যাক্টরী চালু ঘোষণা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের ঘোষণা ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম পদক্ষেপ নেই। শাহ আমানত সেতু নির্মিত হওয়ায় দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্প বিকশিত হচ্ছে। সর্বশেষ সংযুক্তি হচ্ছে আনোয়ারায় সাদ মুছা গ্রুপের প্ল্যান্ট, পিএইচপি ফ্যামিলির মালেশিয়ার মটর-যান প্রোটনসাগা বিপণন শুরু করেছে।
সুসংবাদ হচ্ছে সরকার ইকনোমিক জোন এ্যাক্ট ২০১০ ঘোষণা করেছেন। চট্টগ্রামের মীরশ্বরাই ও আনোয়ারায় (২৯১ একর জায়গায়) বিশেষ ২টি শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে। জাপান, চীন, ভারত এসব শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশ ইকোনোমিক জোন অথোরিটির মতে, পর্যটন শিল্প উন্নয়নের জন্য টেকনাফ ও কক্সবাজারে ১০০০ একর জমি ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া যে কোন প্রাইভেট কোম্পানী নিজস্ব শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে পারবে।
ব্লু ইকোনমি
মূলত যে ব্লু ইকোনমির কথা বলা হচ্ছে, তা চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগরকে নিয়ে। এর জলসীমা নিস্পত্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে এ ক্ষেত্রে করোনাকালে আমাদের স্থলভাগের চেয়ে ব্লু ইকোনমির ওপর আরও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে করে ফিশিং, মেরিন, মিনারেল, মেরিন রিনিয়েবল এনার্জি, মেরিন ম্যানুফেকচারিং, শিপিং পোর্ট অ্যান্ড মেরিন লজিস্টিকস, মেরিন টুরিজম অ্যান্ড লেইজার, মেরিন কনস্ট্রাকশন, মেরিন কমার্স, মেরিন আইসিটি, এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের সর্বোচ্চ আউটপুট নেওয়া যায়।
ই-কমার্স
আইটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২১তম স্থানে রয়েছে। করোনা নিদানকালে অনলাইন বাণিজ্য বা ডোর টু ডোর সার্ভিস বেড়েছে। সাধারণত ব্র্যান্ডেড অনলাইন শপিং সাইটগুলোর মধ্যে দারাজ, ইভ্যালি, ফুডপান্ডা, সহজ প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়। এক্ষেত্রে করোনাকালীন সামগ্রী ঔষধ, মাস্ক, অক্সিমিটার, সেনিটাইজার, ফেইসশিল্ড- এগুলো বেশ বাজার পেয়েছে।
প্রিয় পাঠক, ফেসবুক খুললেই আপনারা দেখবেন, সুন্দরি মালিকনগণ তাদের ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশি ড্রেসের সচিত্র ডেমনেস্ট্রেশন দিচ্ছেন। ঈদ-চাঁদ ছাড়াও তারা সারা বছর জামা, জুতো, জুয়েলারি, গৃহসজ্জার সামগ্রী, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্ত এবং যাদের করোনাকালে অবসর রয়েছে, তারা বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করছেন।
তরুণ উদ্যোক্তাদের হাতে করোনাকালেও ই-কমার্স ভালো সার্ভিস দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সিলেটের ‘কি লাগবে’, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কুমিল্লাভিত্তিক ‘খাস ফুড’, ‘ম্যাক বাই’, রংপুরভিত্তিক ‘বিডি এসিস্টেন্ট’ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া চট্টগ্রামের তরুণ উদ্যোক্তারা আম, ইলিশ, মধু, কনজিউমার ও গ্রুসারি আইটেম, এমনকি চট্টগ্রামে একজন সংস্কৃতিকর্মী ‘কাঁকড়া এক্সপ্রেস’ নামে জীবিত কাঁকড়া ও রন্ধনকৃত কাঁকড়া সরবরাহ করছেন।
অনেকে হোমমেড ফাস্টফুড আইটেম বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি সার্ভিস দিচ্ছেন। অতি আশার বিষয়, এই উদ্যোগের সঙ্গে চট্টগ্রামের কমপক্ষে ২০০ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা জড়িত। তবে সমপ্রতি কিছু ব্রান্ডেড প্রতিষ্ঠানের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মানহীন পণ্য সরবরাহ করে গ্রাহক ঠকানোর ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। এক্ষেত্রে অনলাইন বিজনেস সরকারি রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে প্রতারণার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
বৃহৎ শিল্প- ইস্পাত, সিমেন্ট, অবকাঠামো, রিসাইক্লিং
চট্টগ্রামে দেশের প্রথম সিইপিজেড স্থপিত হয় ৮০-এর দশকে। এখানে কর্ণফুলী ও কোরিয়ান ইপিজেড রয়েছে। তাছাড়া বিডাসূত্র জানাচ্ছে, বর্তমানে হান্ড্রেড পারসেন্ট দেশীয় শিল্পের সংখ্যা হচ্ছে ১১৯৯টি, যৌথ বিনিয়োগে রয়েছে ৩৫টি। অন্যদিকে, শতভাগ বিদেশি ২৩টি।
এক্ষেত্রে বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএসআরএম, জিপিএইচ ইস্পাত, কেএসআরএম, একেএস, গোল্ডেন ইস্পাত, বায়েজিদ, সীমা, শীতলপুর, আরএসএম, সালেহ স্টিল। আরও রয়েছে প্রায় ৬টি ম্যানুয়েল প্রতিষ্ঠান, যদিও এরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তাছাড়া জিপিএইচ ইস্পাত কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, অস্ট্রিয়ার প্রাইমেটালসের নতুন প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় ও এশিয়ার প্রথম কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ও উইনলিংক প্রযুক্তি দিয়ে ক্লিনেস্ট ও পিউরেস্ট স্টিল উৎপাদনের শুরু করে চিনে ২০২১ সালে বিলেট রপ্তানী করেছে।
সিমেন্ট ম্যানুফেকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা হাকিম আলী বলেছেন, চট্টগ্রামে বর্তমানে আরামিট, এস আলম, শাহ সিমেন্ট, ডায়মন্ড, কনফিডেন্স, রয়েল, প্রিমিয়ার রুবি, এনজিএস, মোস্তফা হাকিম-এর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি রয়েছে। গত ৫ মাস ধরে ডেলিভারি পরিবহন ও রাজমিস্ত্রি সংকটের কারণে তাদের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তবে গত ২ মাসে তারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।
বাংলাদেশে লোহার খনি খ্যাত চট্টগ্রামে শিপ রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এদের সিস্টার কন্সার্ন-সহ ১৬১টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা জানাচ্ছে, ব্যাংক লোন অ্যাডজাস্ট করার জন্য করোনার আগে বেশি দামে কেনা জাহাজগুলো এখন কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আশার বিষয়, ৪০-৪৫ টি নতুন জাহাজ আসছে।
সমুদ্র বন্দর
শতবছরের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বন্দরকে বিশ্বমানে করার লক্ষ্যে অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা তৈরী হচ্ছে। সকল প্রকার যন্ত্রপাতি সংকটে সমাধান করা হবে। ৩০ বছরের মহাপরিকল্পনার খসড়া প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এই বে-টার্মিনালে ৩৫টি জাহাজ একই সঙ্গে ভিড়তে পারবে। অন্যদিকে মহেষখালিতে ডিপ সী-পোর্ট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। লয়েডস এর জরীপ অনুযায়ী ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল ৯৮তম স্থানে। ২০১৪ সালে তা ৭৬তম স্থানে উঠেছে। অপরদিকে গণমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা কমছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণতঃ স্বাভাবিক সময়ে একটি গড় অবস্থান সময় ৩ দিন। ২০১১ তে তা ছিল ৩ দিন ১৫ ঘণ্টা, ২০১২ তে ৩ দিন ১৭ ঘণ্টা, ২০১৩-১৪ তে ৪ দিন, ২০১৫ তে এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ দিন। ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে বন্দরের সমস্যা সমূহের কথা বলা হচ্ছে, বন্দরের বর্তমান কন্টেইনার জটসহ অচলাবস্থা নিরসন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল নিয়োগ, বিশ্বমানের বন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ, ট্রাফিক ব্যবস্থা, অকশন কন্টেইনার ও খালি কন্টেইনার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, আধুনিক ও দক্ষ অপারেশনাল ম্যানেজমেন্ট, বার্থ অপারেটরদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংস্থান, স্ক্যানিং মেশিন, সিটিএমএস ও এস্যাইকোডা সিষ্টেমের ত্রুটিমুক্ত অপারেশন, কাষ্টমস, পোর্ট ও আইসিডিসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয় কোলকাতায় ১২০টি ইউএস কন্টেইনার হ্যাল্ডলিং এ যেখানে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় দেড় দিন লেগে যায়। এক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির সমস্যা, অপারেটরের অভাব সহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়। এতে করে কন্টেইনার জট, জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম বৃদ্ধি, ডেমারেজ চার্জসহ ব্যবহারকারীগণ নানা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন যার দায়ভার শেষ পর্যন্ত জনগণের উপর বর্তায়। একই সাথে বন্দরের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। তাই বন্দরের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও গতিশীলতা আনয়নে এসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনাপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর
দেশের বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের অন্যতম গেইটওয়ে বলে পরিচিত চট্টগাম শাহ আমানত বিমানবন্দরকে ২০০১ সালে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্যে আন্তর্জাতিক মানের বিমান বন্দরে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু পর্যটক আকর্ষণে অনভিজ্ঞতার কারণে এই বিমান বন্দরটি শুধুমাত্র ১২% ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ বিমান বন্দর আর্ন্তর্জাতিকভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিদেশী অপারেটর হিসেবে থাই এয়ারওয়েজকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ এর পরিচালনায় কার্যক্রম হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক্ষেত্রে থাই এয়ারওয়েজের সাথে একটি চুক্তি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তা বাতিল হয়ে যায়। উপরন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে ইতোপূর্বে ফুকেট,আরএকে এয়ারলাইন্স এবং থাই এয়ারওয়েজ চট্টগ্রাম থেকে তাদের বিমান পরিচালনা বন্ধ রেখেছে।যার ফলে চট্টগ্রাম থেকে থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণেচ্ছু ব্যবসায়ী, রোগী, পর্যটক ও যাত্রী সাধারণ বর্তমানে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। চট্টগ্রামবাসীর পূর্বের প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা অনুযায়ী চট্টগ্রাম-জেদ্দা হজ্ব ফ্লাইট, চট্টগ্রাম মধ্যপ্রাচ্য ফ্লাইট সমূহ চালু হয়েছে। তাছাড়া প্রাইভেট সেক্টরে বেশ কিছু নতুন উদ্যোক্তারা ডোমেস্টিক ফ্লাইট চালাচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ কলকাতা, ব্যাংকক পর্যন্তও যাচ্ছে। শাহ আমানত বিমান বন্দরে যেতে আসতে একটি মাত্র রোড ব্যবহৃত হয়, এতে ফ্লাইট ধরা এবং নগরে ফিরে আসা এক দোজখী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। এর জন্য আরো একাধিক বিকল্প সড়ক স্থাপনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সমপ্রতি চিটাগং মেট্রোপলিটন কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি আগ্রাবাদ বাড়িক বিল্ডিংয়ের মোড় থেকে বন্দর এলাকা ও ইপিজেড থেকে লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এর জন্য সিডিএ বা রোডস এন্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্টকে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

লেখক : সাবেক সচিব ও প্রধান নির্বাহী, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি, অতিথি শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা ভাবনা ও চট্টগ্রামের শিক্ষাচিত্র
পরবর্তী নিবন্ধবিচারহীনতার সংস্কৃতি শুধু জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কেন?