শিক্ষা ভাবনা ও চট্টগ্রামের শিক্ষাচিত্র

অধ্যাপক কানাই দাশ | রবিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের শিক্ষাচিত্র দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, পদ্ধতি ও পরিস্থিতির প্রতিফলন মাত্র। শিক্ষায় আনন্দ ও প্রাণের স্বতঃষ্ফূর্ত প্রবাহ, জিজ্ঞাসার অনন্ত আগ্রহ, শিক্ষার্থীর মধ্যে কৌতূহল মিশ্রিত সৃজনশীলতা দীর্ঘদিনের প্রণালীবদ্ধ চাপিয়ে দেয়া, সিদ্ধান্তমূলক ও পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার কারণে হারিয়ে গিয়ে আজকের শিক্ষা স্থবির হয়ে পড়েছে। জীবন ও জগতের প্রাকৃতিক প্রপঞ্চগুলো নিয়ে মুক্ত জিজ্ঞাসা কথিত ধর্মানুভূতির নামে এখন প্রাতিষ্ঠানিক “অপরাধে” পরিণত হয়েছে। “আজি এ প্রভাতে রবির কর / কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে- প্রভাত পাখির গান” রবীন্দ্রনাথের কৈশোরে রচিত বিখ্যাত “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতার প্রথম এ দুটি চরণকে সাধারণভাবে তাঁর কাব্যিক অবগুণ্ঠনের উন্মোচন মনে করা হলেও আমার মনে হয় এ তো এক কৌতূহলী কিশোরের অনন্ত জিজ্ঞাসার মূর্ত প্রকাশ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীও কিশোরের অবোধ দৃষ্টিতে প্রকৃতির দিকে তাকালে তার মনে কোনো না কোনোভাবে এ প্রশ্ন আসে কিন্তু ভাষাহারা এ প্রশ্নের উত্তর সে পায় না বরং মুখস্ত করতে হয় সে বয়সে কিছু শাস্ত্রীয় আপ্তবাক্য বা গণিত ও শুষ্ক জ্ঞানের বিমূর্ত কিছু সূত্র। ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা ও সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যদি শিক্ষা হয় তাহলে প্রকৃতিই হতে হবে সেই শিক্ষার আনন্দ নিকেতন। রবীন্দ্রনাথ আনন্দময় শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে প্রকৃতির কোলে নিয়ে যাবার কথা বারবার বলেছেন। কানাডার শিক্ষাবিদ ম্যালকম নোয়েলসের মতে-“It is no longer functional to define education as a process of transmitting what is known, it must now be defined as a lifelong process of discovering what is not known.” যা কিছু আমাদের অজানা তা আবিষ্কার করার আজীবন অন্তহীন প্রচেষ্টাই শিক্ষা। সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক সাধনা, বৈষম্যহীন সমাজপ্রতিষ্ঠায় সমাজবিজ্ঞানীর বিরামহীন ভাবনা তথা প্রকৃত শিক্ষার ধারা ও অনন্ত জিজ্ঞাসার অবিমিশ্র কৌতূহলের বিপরীতে নিরানন্দ, প্রণালীবদ্ধ, শাস্ত্রাশ্রিত বিশ্বাস ও জ্ঞানের বিমূর্ত কিছু নিষ্প্রাণ ধারণা ও বিশ্বাসকে শিক্ষার নামে চাপিয়ে দেয়ার সহস্রাব্দ প্রাচীন প্রচেষ্টা আজো আমাদের শিক্ষাকে পঙ্গু ও জীবন বিমুখ করে রেখেছে। সম্প্রতি শিক্ষার নামে অর্গলবদ্ধতা, সংকীর্ণতা, অনুদার উগ্রতার বাড়াবাড়ি দেখলে মনে হয় আমরা মধ্যযুগের ইউরোপের গোঁড়া চার্চ শাসিত ব্রুনো-গ্যালিলিও’র যুগে ফিরে গেছি। শুধু তাই নয় ধর্মান্ধতার অনুষঙ্গ হিসাবে শিক্ষাসূচি ও পাঠে যুক্ত হয়েছে ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার প্রচুর উপাদান। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান আমলেও গল্পে-কবিতায় যে মানবিক উদারতার বাণীতে শিক্ষার্থীরা ঋদ্ধ হতো সেগুলো অনেক আগেই বাদ দেয়া হয়েছে। এর সাথে দেদার চলছে বাজার অর্থনীতি ও বাজার রাজনীতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ বাজারী শিক্ষা বা শিক্ষার বাণিজ্য। ফলে দেখতে পাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দ এখন অতীতের যে-কোনো সময়ের চাইতে কম। শিক্ষার প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে এখন শিক্ষা নামক বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে লাভজনক পণ্য। বস্তুত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানুষের এই দুই সংবিধানিক মৌলিক অধিকার আজ লাভজনক ব্যবসায়ী পণ্য হিসাবে অবাধে বিকোচ্ছে। এই ব্যবসা মোটা দাগে চলছে নামে বেনামে ধর্মকে পুঁজি করে। আইডিয়াল স্কুলের নামে নন আইডিয়াল, আপাত নির্দোষ অথচ কৌশলে বিভক্তি আর বিভেদের শিক্ষা চলছে, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার পরোক্ষ পরিবেশ তৈরি করে। সে সব স্কুলে একদেশদর্শী শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে অবোধ শিক্ষার্থীদের। তাদের সহজাত কৌতূহলকে জাগিয়ে তোলা ও তার নিবৃত্তি যে শিক্ষা ও শিক্ষকের দায়িত্ব সে বোধ সমাজে অনুপস্থিত। কৌশলে এ শিশুসুলভ স্বাভাবিক ইচ্ছাকে অবদমন করে তাদের জিজ্ঞাসাকে বন্ধ করা হচ্ছে। এ তো এক ধরনের শিশু হত্যা। এ অপরাধ অমার্জনীয়। অন্যদিকে বিশ্ব বিদ্যার সংগ্রহশালা যে বিশ্ববিদ্যালয়, জ্ঞান সৃষ্টি আর গবেষণা ও সৃজনশীলতা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্য এই ভাবনা আজ বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখাই যায় না। শিক্ষা ও মানব সম্পদের এই অপরিমেয় অপচয় রাষ্ট্রের কাছে, ক্ষমতার করিডোরে একটি সম্পূর্ণ অনাবশ্যক এজেন্ডা। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা বিচিত্র ধর্মী মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার নামে কুশিক্ষা, সংকীর্ণ ঘৃণা, বিদ্বেষ ও পুঁথিগত কিছু অর্থকরী বিষয়ে পাঠদান হলো আজকের আমাদের শিক্ষা পরিস্থিতি। বাংলা, ইতিহাস ও দর্শনের মতো মানবিক আবশ্যিক বিদ্যার স্থান নেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ইউজিসিরও এতে আপত্তি নেই। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক সবকিছুই অর্থ, ক্ষমতা, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এক সর্বনাশা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আজকের শিক্ষার স্থিরচিত্র। অথচ উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ থেকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত তদানীন্তন প্রত্যেক জেলা ও মহকুমা শহরে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় বিশেষ করে কলেজগুলো- সেই খুলনার ব্রজলাল কলেজ থেকে সিলেটের মুরারী চাঁদ বা এমসি কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ-এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনতা পূর্ব ৬০-এর দশকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিবেশেও ছিল উন্নত শিক্ষা, পাঠদান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক অপত্য সম্পর্কে ঋদ্ধ এক একটি জ্ঞানপীঠ। কিছু ব্যতিক্রম বাদে ঋষিতুল্য শিক্ষকরা ছিলেন আত্মনিবেদিত কর্তব্যবোধের মূর্তপ্রতীক, অন্যদিকে মুক্তি সংগ্রামের পানে ছুটেচলা তারুণ্যের দুর্বার গণআন্দোলনের নীরব সমর্থক। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে দেখতে পাচ্ছি সমাজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। এর পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, মুক্ত বুদ্ধির চর্চা বিরোধী সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও অন্ধ অপশিক্ষার যাঁতাকলে বেড়ে উঠেছে কয়েকটি প্রজন্ম। পাল্টে গেছে সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও মূল্যবোধ- প্রাণের কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় “উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ”। বাংলার কাদামাটির বদলে আমাদের পা যেন দাঁড়িয়ে আছে আরবের উত্তপ্ত বালুকারাশির উপর। বঙ্গবন্ধু প্রণীত রক্তস্নাত সেকুলার, বিজ্ঞানমনস্ক সর্বজনীন শিক্ষানীতি প্রায় ১৫ বছর ধরে শাসন ক্ষমতায় সমাসীন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় দল ক্ষমতার সমীকরণ মিলাতে গিয়ে হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে।
একটি জেলা বা এলাকার শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি সেই দেশের সরকারের নীতি নির্ধারনের উপর নির্ভর করে। শিক্ষা খাতের বরাদ্ধ, শিক্ষাকে সুলভ, সর্বজনীন, বিজ্ঞান মনস্ক এবং ইহজাগতিক ধারায় গড়ে তোলা, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য তথা শিক্ষার্থী ও সমাজ মানসে, জানা-বোঝার কৌতূহল সৃষ্টি করা, সব বিষয়ে জিজ্ঞাসা ও জিগীষা তৈরী বা মুক্তবুদ্ধির চর্চা প্রভৃতি নির্ভর করে একটি প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর শিক্ষা নীতির উপর। কার্যত আমাদের দেশে শিক্ষা বান্ধব শিক্ষানীতি কোন সময় ছিল না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও কোন সরকার শিক্ষাখাতে রাজস্ব ব্যয় শতকরা ২-২/১ ভাগের কম ছাড়া বেশি করেনি যা সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শতকরা ৬ভাগ হওয়ার কথা। কাজেই শিক্ষার সামগ্রিক দৈন্যদশা, পরিকল্পনাহীন আমলাতান্ত্রিক টানাপোড়েনের হাত থেকে চট্টগ্রামের শিক্ষাচিত্র ভিন্নতর কিছু হতে পারে না। এই প্রক্ষিতে চট্টগ্রামের শিক্ষার কিছু বাস্তব সংকট তুলে ধরতে চাই, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যেগুলো সহজে সমাধান করা যায়। এ প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের শিক্ষার অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে দু’টি বিদ্যাপীঠ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত দেদীপ্যামান থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে শিক্ষার আলো বিতরণ করে চলেছে সেগুলো হলো চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। ১৮৩৫ সালে মেকলের শিক্ষানীতিতে যখন মোগল আমল থেকে প্রচলিত ফার্সির স্থলে ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হলো তখন থেকে ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার বাহন হিসেবে চালু হলো ইংরেজি যাতে ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় নেটিভ ইংরেজভাষী পাওয়া যায়। শাসকগোষ্ঠীর কিছুটা পৃষ্ঠপোষকতায় ও বহুলাংশে উঠতি হিন্দু মধ্যবিত্তের আগ্রহাতিশয্যে মূলত সারা বাংলায় দ্রুততার সাথে গড়ে উঠতে লাগল মাধ্যমিক পর্যায়ে উচ্চ ইংরেজি ও নিম্ন ইংরেজি বিদ্যালয়গুলো। মাধ্যমিক পর্যায়ে সেদিনের ছোট্ট মফস্বল শহর চট্টগ্রামে সেই ১৮৩৬ সালের প্রতিষ্ঠিত হলো চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। এর পরে শহরের বাইরে পল্লি চট্টলায় সম্পূর্ণ স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের প্রচেষ্টায় ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে পটিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো পটিয়া উচ্চ ইংরেজি স্কুল। সরকারি চাকুরি বা উন্নত কর্মসংস্থানের জন্য অনেকটা নিশ্চিত উপায় হিসেবে ইংরেজি শিক্ষার মানসে তখন অবস্থাপন্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এই দুটো স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করে। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারিভাবে চালু হলো একই কারিকুলাম ভিত্তিক পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি তথা প্রবেশিক্ষা পরীক্ষা বা ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এফ.এ. বা ফার্স্ট আর্টস এবং স্নাতক পর্যায়ে মূলত বিএ পরীক্ষা। এর পরে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় প্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়, মূলত স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের উদ্যোগে। ১৯৪৭ সালের আগেই বৃহত্তর চট্টগ্রামে কয়েকটি ছাড়া প্রায় প্রত্যেক থানায় প্রতিষ্ঠিত হয় এক বা একাধিক উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। মেধাবী এবং আত্ম নিবেদিত শিক্ষকদের পরিচালনায় মান এবং গুণগত দিক থেকে এ সব স্কুলের অধিকাংশই ছিল তখন ঈবহঃৎব ড়ভ ঊীপবষষবহপব. সেদিনের নির্লোভ মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতায় আসত পঠনপাঠনের প্রতি সহজাত আগ্রহ ও সেবার মনোভাব নিয়ে। উন্নত সামাজিক মর্যাদা ও অপরিসীম এক পরিতৃপ্তিবোধে তাঁদের জীবন অতিবাহিত হতো। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানবিক বিদ্যাচর্চা ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য। পরম অপত্য স্নেহে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের যত্ন নিতেন।
১৮৬৯সালে বেসরকারি উদ্যোগেই প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম কলেজ। পরে এটা সরকারি অধিভুক্ত হয়। চট্টগ্রামের উচ্চশিক্ষার ইতিহাস ও চট্টগ্রাম কলেজের ইতিহাস বলতে গেলে এক ও অভিন্ন। দীর্ঘদিন পর ১৯৩৯ সালে বোয়ালখালীতে স্থানীয় বিখ্যাত দত্ত পরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ যা চট্টগ্রামের উচ্চশিক্ষার পরিবেশকে আরো সহজ ও সমৃদ্ধ করে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে আর কোন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রত্যেক থানায় বর্তমানে একাধিক কলেজ রয়েছে। এরি মধ্যে কিছু কলেজ সরকারি করা হয়েছে এবং আরো কিছু কলেজ সরকারিকরণের প্রক্রিয়াধীন আছে।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার একপ্রান্তে জনবিরল বিরাট পাহাড়ী এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শহরের কাছাকাছি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সামগ্রিক শিক্ষাকার্যক্রম আরো গতিশীল, অনায়াসলব্ধ হতো এবং আর্থিক, কায়িক ও মানসিক দিক থেকে সংশ্লিষ্ট সকলে উপকৃত হতো। চট্টগ্রাম শহরের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জগতও আরো বেশি ঋদ্ধ হতো। বিগত ৫০ বছরে চট্টগ্রাম শহরে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদিও জনসংখ্যা বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। সেক্ষেত্রে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত চট্টগ্রাম কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে। এ কলেজে কিছু বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির পাঠদান করা হয় এবং একই সাথে একাদশ শ্রেণির কার্যক্রমও চলে। উচ্চতর শিক্ষার যথার্থ পরিবেশের জন্য ঢাকা কলেজের মত চট্টগ্রাম কলেজেও অবিলম্বে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠক্রম বন্ধ করা দরকার এবং একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এটাকে গড়ে তোলা দরকার। সরকারি সিটি কলেজের বর্তমান যে অবস্থান ও পরিসর তাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার প্রকৃত পরিবেশ নেই বললে চলে। রেলের পরিত্যক্ত জমিতে যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে তোলার অনুমতি পাওয়া যায় তা হলে সিটি কলেজের মত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা যাবে না কেন? ভেটেরেনারি বিশ্ববিদ্যালয়-কে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে ভেটেরেনারি বিজ্ঞান সহ আরো কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়ে পাঠদান করা সহজ হতো। চট্টগ্রামে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছর গত হলেও এখনো বলতে গেলে এর কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ। ফৌজদার হাটের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে বর্তমানে এটির কাজ চলছে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য কোন সুপরিসর সরকারি জায়গায় স্থানান্তর করা গেলে একটি পুর্ণাঙ্গ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চট্টগ্রামে গড়ে তোলা যেত যা চট্টগ্রামবাসীর স্বাস্থ্য পরিসেবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতো। চট্টগ্রাম শহরে ১৯৭২ সালের পর বিগত প্রায় ৫০ বছরে একটি কি দু’টি ছাড়া কোন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং কোন কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি অথচ শিক্ষার্থী বেড়েছে শতগুনের কাছাকাছি। সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী এক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। সিটি কর্পোরেশনের স্কুলগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে এগুলোকে মোটামুটি মানসম্পন্ন সচ্ছল ও গতিশীল করে গড়ে তোলেন এবং বেশকিছু স্কুলকে কলেজে উন্নিত করেন। মহানগরীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কিন্তু অধিকাংশই কর্পোরেশনভুক্ত। সরকারি কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় এই সময়কালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা বলা মুশকিল। এসব কারণে চট্টগ্রামের শিক্ষা পরিস্থিতি আজ নানা সমস্যার সম্মুখীন। সরকারের প্রাইভেটাইজেশান নীতির সুযোগে অলিতে গলিতে অসংখ্য প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠেছে-হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া যেগুলোর অধিকাংশকে মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলা যায়। ব্যক্তি মালিকানায় চলমান শিক্ষা ব্যবসার রমরমা অবস্থায় শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। বিদেশি সিলেবাস নির্ভর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো নিয়ে আলোচনা কম করাই ভালো কারণ এখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য থাকে বিদেশে পাড়ি জমানো যেমন করে তাদের অভিভাবকরা বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকেন। এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম শুধু ব্যাতিক্রমই মাত্র।
শিক্ষায় সরকারী ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী না করে, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্ধ না করে, বিজ্ঞান মনস্ক একমুখী শিক্ষা পদ্ধতি চালু না করে, প্রকৃত শিক্ষার মর্মবস্তুতে শিক্ষার্থীদের মনে মননে মানবিক করার ব্যবস্থা না করে অতীতের মতো মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা না করে, শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করে সম্প্রতি কোয়ালিটি এডুকেশনের যে ফাপা আওয়াজ দেশে-বিদেশে উঠেছে চট্টগ্রামেও তার প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি। এগুলো মানুষকে বিভ্রান্ত করার নামান্তর। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের হতশ্রী শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিকাঠামোকে উন্নত করাই হলো এখন সময়ের দাবি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
পরবর্তী নিবন্ধগৌরবের চট্টগ্রাম, হাজার বছরের চট্টগ্রাম