নগরের টাইগারপাস মোড় থেকে নেভি কনভেনশন হলের পাশ দিয়ে যাওয়া দেওয়ানহাট মোড় পর্যন্ত সড়কটি বহু পুরনো। দেওয়ানহাট ব্রিজ হওয়ার পর এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে সাধারণ পথচারীরা নিয়মিত ব্যবহার করেন এ সড়কটি। দুদিকে রেলবিট পর্যন্ত রিকশাও চলে। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির দুই পাশে অন্তত ৫০টি দোকান গড়ে উঠে অবৈধভাবে, যার ৩০ থেকে ৩৫টি স্থায়ী। বাকিগুলো ভাসমান।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এ সড়কে অভিযান চালায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এ সময় উচ্ছেদ করা হয় ১৫ থেকে ২০টি দোকান। বাকি দোকানদাররা নিজ উদ্যোগে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে অভিযানের পর প্রায় দুদিন পার হলেও নিজ উদ্যোগে কেউ সরে যায়নি। উল্টো যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তারা ফিরে আসছে। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টায় উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, উচ্ছেদকৃতরা ত্রিপল দিয়ে আবারও দোকানের কাঠামো তৈরি করে ব্যবসা শুরু করেছে। উচ্ছেদ করা একটি হোটেলও একইভাবে ত্রিপল টাঙিয়ে চালু করা হয়েছে। অবশ্য বৃহস্পতিবার বিকেলেও উচ্ছেদ হওয়া জায়গায় ভাসমান দোকান দেখা গেছে।
শুধু টাইগারপাস-দেওয়ানহাটের পুরনো সড়কটি নয়; গত একমাস ধরে প্রায় প্রতিদিন নগরের বিভিন্ন সড়ক ও ফুটপাতে অভিযান চালিয়েছে চসিক। উচ্ছেদ করা হয় কয়েকশ স্থায়ী-অস্থায়ী দোকান ও অবৈধ স্থাপনা। কিন্তু যার বেশিরভাগই আবারো দখল হয়ে গেছে।
চকবাজারসহ কয়েক জায়গায় এমনও হয়েছে, সকালে উচ্ছেদ করলে বিকেলেই বসে গেছে দোকানপাট। এ যেন চসিকের সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের ‘চোর-পুলিশ’ খেলা।
এ দিকে উচ্ছেদ হওয়া জায়গা পুনর্দখল রোধে ‘স্ট্রাকিং ফোর্স’ নামে বিশেষ দল গঠন করে চসিক। গত ১৭ আগস্ট থেকে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে দলটি। কথা ছিল ২১ সদস্যের দলটি উচ্ছেদকৃত জায়গা আবারো দখল হয়েছে কী না তা মনিটরিং করবে। কোথাও দখল হতে দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অবহিত করবে এবং আবারো উচ্ছেদ করবে। কিন্তু যাত্রা শুরু পর থেকে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ এর এমন কার্যক্রম চোখে পড়েনি। বরং চসিক নিয়মিত যে অভিযান চালায় সেখানেই অংশ নিচ্ছে তারা। ফলে এ স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠনেরও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।
নগরবাসী বলছেন, শুধু উচ্ছেদ করলেই হবে না। পুনরুদ্ধার হওয়া ফুটপাত পুনর্দখল রোধে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজনে মিনি বাগান করে দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে উচ্ছেদের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা জায়গা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় উচ্ছেদ করেও কাজ হবে না। কেউ কেউ ফুটপাতের পরিবর্তে বিকল্প স্থানে হকারদের বসার জায়গা করে দেয়ার পরামর্শ দেন।
উচ্ছেদের পর আবার দখল : গত ৩ আগস্ট চকবাজার কেবি আমান আলী রোডের ফুলতলা পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালায় চসিক। এখানে মূল সড়কের উপর বসা কাঁচা বাজারের দোকানসহ বিভিন্ন ভাসমান দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু যেদিন উচ্ছেদ করা হয় সেদিন বিকেলেই দোকানপাটগুলো বসে গেছে। এরপরও দুয়েকবার সর্তক করে চসিক। কিন্তু সরেনি অবৈধ দখলদাররা। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পূর্বের মত দখল অবস্থায় দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হামিদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, এখন দখলদাররা নতুন কৌশল নিয়েছে। তারা সকালের দিকে রাস্তার কিছু অংশ ফাঁকা রাখে। বিকেল হতে না হতেই আবার পুরোটা দখল করে নেয়।
চকবাজার মোহাম্মদ আলী শাহ লেইনে গত ২২ আগস্ট অভিযান চালায় চসিক। অভিযান শেষ করে চসিকের কর্মকর্তারা নগর ভবনে পৌঁছার আগেই আবারো দখল হয়ে যায় সড়কটি। এ সড়কে বসে মাছের বাজার। গত পরশুও মাছের দোকান দেখা গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে আন্দরকিল্লা মোড়ে শাহী জামে মসজিদের সিঁড়ির গোড়া বেশ কয়েকজন ভাসমান ব্যবসায়ী অবৈধ দখলে নিয়ে রাখে। সেখানে সিঁড়ির নিচের অংশ ব্যবসা করে আসছে তারা। যা মুসল্লি এবং মসজিদ মার্কেটে আসা ক্রেতাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। গত ৩ সেপ্টেম্বর অভিযানে ভাসমান দোকানগুলোও উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু কয়েকদিন না যেতেই সেখানে আবারো পূর্বের অবস্থা ফিরে আসে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে সরেজমিন পরিদর্শনে কয়েকটি ভাসমান খাবারের দোকান দেখা গেছে। দোকানের ক্রেতাদের ভিড় জমেছিল সেখানে। এতে হাঁটতে বেগ পেতে হয় পথচারীদের। তৌসিফ নামে এক মুসল্লি দৈনিক আজাদীকে বলেন, শুধু উচ্ছেদ করেই চসিক চলে গেছে। পরে আবার বসছে কী না খবর নেয়নি।
কাজীর দেউড়ি, নুর আহমদ সড়ক, এস এস খালেদ রোড ও জামালখান রোডের উভয় পাশ এবং আরাকান সড়কের বহদ্দারহাট হতে সিএন্ডবি মোড় পর্যন্ত অংশে গত ৫ সেপ্টেম্বর অভিযান চালানো হয়। সে দিন ১০ ব্যবসায়ীকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। এ সব এলাকার সড়ক ও ফুটপাত দেখলে মনেই হবে না, কয়েকদিন আগে অভিযান চালানো হয়েছে। আগের মতই ব্যবসায়ীরা দোকানের মালামাল রেখে পথচারী ও যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
৭ সেপ্টেম্বর অভিযান চালিয়ে কদমতলী এলাকায় রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে দোকানের মালামাল রাখায় ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে চসিক। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত চলে আসার ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ফিরে আসে পূর্বের অবস্থা। গত মাসের শেষ দিকে বহদ্দারহাট বাজারগলিতে অভিযান চালানোর কয়েকদিন না যেতেই আবারো দখল হয়ে গেছে বলে দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা রতন।
একইভাবে গত এক মাসে শেখ মুজিব রোডের দেওয়ানহাট মোড় থেকে বাদামতলী মোড়, পিসি রোড ও এঙেস রোডের বিভিন্ন পয়েন্ট, আগ্রাবাদ সিডিএ মার্কেট এলাকা, আমান বাজার, মাঝিরঘাট ও বাংলা বাজার সড়ক, বহদ্দারহাট মোড়, বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার গলি, এশিয়ান হাইওয়ের বহদ্দারহাট থেকে মুরাদপুর এবং ২নং গেট থেকে জিইসি, ডিটি রোডের দেওয়ানহাট মোড় হতে কদমতলী পর্যন্ত, আন্দরকিল্লা থেকে মোমিন রোড, চেরাগীপাহাড়, জামালখান হয়ে আসকার দীঘি পাড় পর্যন্ত এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, তেলিপট্টি সড়কসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা ও ভাসমান দোকান উচ্ছেদ করে চসিক। যার বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে।
চসিকের বক্তব্য : চসিকের অভিযানে অংশ নেয়া সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম দৈনিক আজাদীকে বলেন, কিছু কিছু জায়গা উচ্ছেদের পর প্রকৌশল বিভাগকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তাদের সেখানে বেষ্টনি দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আরো কিছু জায়গায় বাগান করে দেয়ার পরিকল্পনা আছে। একদম বৃহৎ বাগান না; মানুষের হাঁটার জায়গা রেখে বাকি অংশে কিছু ফুলের টব দিয়ে দিলে আর কেউ দখল করতে পারবে না। বায়েজিদের কিছু কিছু পয়েন্টে এমন ব্যবস্থা করেছি।
এ কর্মকর্তা বলেন, টাইগারপাস থেকে দেওয়ানহাট মোড় পর্যন্ত পুরনো সড়কে আবার কিছু দোকান বসে গেছে। তবে দুইপাশে বসেনি। সেখানে আবার অভিযান চালাব। বহদ্দারহাটে অভিযানের ফলে অবৈধ দোকানপাট কিছুটা কমেছে। তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে হলিডে মার্কেট বা বিকল্প ব্যবস্থা করতে না পারা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারলে কিন্তু আমরা আরো কঠিন হব।
স্ট্রাইকিং ফোর্স মনিটরিংয়ের পরিবর্তে নিয়মিত অভিযানে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, এরা তো সাধারণ সেবক। একা মনিটরিং করতে গিয়ে কোথাও অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আপাতত তাদের নিয়মিত অভিযানে অংশ নিয়ে এক ধরনের বাস্তবিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা তৈরি হবে। এরপর তাদের মনিটরিংয়ের কাজে লাগানো হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদের বক্তব্য : উচ্ছেদের পর আবার দখল হওয়া প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান দৈনিক আজাদীকে বলেন, কেউ তো এটার সমাধান করতে পারছে না। এর সঙ্গে প্রভাবশালীদের অবৈধ উপার্জনের একটা বিষয় আছে। যদিও মেয়র সাহেব আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, হকারও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। নির্দিষ্ট একটা শ্রেণির মানুষ হকারের উপর নির্ভরশীল। তাই হকারদের বাদ দিয়েও চলবে না। ওয়ার্ড ভিত্তিক সিটি কর্পোরেশনের অনেকগুলো জায়গা আছে, সেখানে হকারদের পরিকল্পিতভাবে বসার ব্যবস্থা করে দেয়া যায়। এতে কন্ট্রোল থাকবে। হকারদের শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার জন্য তাদের নিবন্ধনের মাধ্যমে পরিচয়পত্র দেয়া যেতে পারে। যেখানে বসবে সেখানে তারাই পরিষ্কার রাখবে।
ফুটপাতে কোনোভাবেই হকারদের বসতে দেয়া উচিত না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ফুটপাত হচ্ছে নাগরিকদের হাঁটার জায়গা। কিন্তু পুরো শহরেই ফুটপাত হয়ে গেছে বাজার। রাস্তাঘাটেও বাজার বসে যায়। এ ভাবে একটা শহর চলতে পারে না। এ সব নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা লাগবে।












