দৈনিক আজাদী : সত্যনিষ্ঠ গণমাধ্যম পথিকৃৎ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:২১ পূর্বাহ্ণ

এটি সর্বজনবিদিত যে; বৈশ্বিক-জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়ন-অনুন্নয়ন পর্যালোচনায় গণমাধ্যম সংস্কৃতির অভীষ্টতম অনুষঙ্গ হিসেবে সর্বত্রই বশবর্তিতা। গণমাধ্যমের নবতর বিকাশ-বিস্তার-বিতরণ-বিনিয়োগ-উদ্ভাবন তথ্য বিপ্লবের যুগসন্ধিক্ষণে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। লুম্পেন বিশ্বায়নের মোড়কে বৈশ্বিক সংস্কৃতির কাঠামো-প্রযুক্তি-বিনোদন-মুদ্রিত উপাদান-সাহিত্য-চিত্রকলা-বেতার-টেলিভিশনসহ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি চলমান সভ্যতার বশীভূত সংযোজন। সংস্কৃতির বস্তু ও অবস্তুগত প্রবাহের জটিল মিথস্ক্রিয়ায় সততা-নৈতিকতা-সত্যবাদিতা-শুদ্ধাচার আপেক্ষিক পরিশুদ্ধ সমাজে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত। সুনিপুণ পরিকল্পনায় একদিকে নির্মিত হয়েছে আগ্রাসনবৃত্ত, অন্যদিকে পর্যুদস্ত ঐতিহ্য-কৃষ্টির ভৈরবী। বৃহত্তর সমাজের বৈষম্যের বিভাজিত যুগপৎ সংকট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদকেই পক্ষান্তরে উম্মোচিত করেছে নির্ভরশীলতার নতুন কদর্য দিগন্ত।
আধুনিক সভ্যতার উপাগত বিকাশ ও বিস্তার মানদন্ডে গণমাধ্যম কোন নির্দ্দিষ্ট ভূখন্ড নয়; সমগ্র বিশ্বে ‘ছায়া-সরকার’ অভিধায় ভূষিত। সমাজের বৃহত্তর পরিসরে সুচিন্তিত জনমত-যৌক্তিক সচেতনতা সৃষ্টি ও সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে পৃথিবী নামক এই গ্রহকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও মানবিক করার লক্ষ্যেই গণমাধ্যমের ভূমিকা সর্বত্রই সমাদৃত। মহাত্মা গান্ধীর মতানুসারে ‘ভারতবর্ষের সর্বাগ্রে’ দেশের প্রবেশদ্বার ও বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বিশ্বনন্দিত এই জনপদের নাম চট্টগ্রাম। অফুরন্ত সমাজ-ইতিহাস সমৃদ্ধ এই চট্টগ্রামের অখন্ড-অক্ষুব্ধ অনুবর্তনে দৈনিক আজাদী প্রকাশনার নিরবচ্ছিন্ন গৌরবোজ্জল অধ্যায় যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে অনুসৃত। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ প্রকাশের সূচনালগ্ন থেকে একই ধারাবাহিকতায় দৈনিক আজাদীর পথচলা আধুনিক গণমাধ্যম পরিক্রমায় শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো দেশ ও বহির্বিশ্বেও দৈনিক আজাদী সকল বাঙালির কাছে নান্দনিক দৃশ্যপটে সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্ষপূর্তির এই দিনে পত্রিকার সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা; নির্মোহ-নির্লোভ-ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ক্ষণজন্মা, জনকল্যাণ মানস তৎকালীন খ্যাতিমান বিদ্যুৎ প্রকৌশলী প্রয়াত আবদুল খালেকসহ প্রতিষ্ঠাকালীন সকল সাংবাদিক ও কলা-কুশলীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের অবস্থান ছিল অনন্য অসাধারণ। ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই-যুব বিদ্রোহ-সিপাহী বিদ্রোহ-মহান মাতৃভাষা আন্দোলন-স্বাধীনতার ম্যাগনাকার্টাখ্যাত বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের সূচনা-বঙ্গবন্ধুর মহান মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সম্প্রচারসহ বিভিন্ন কালজয়ী অর্জনে আউলিয়াদের পূণ্যভূমি চট্টগ্রামের রয়েছে বিশাল গৌরবগাঁথার অনুশীলন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ জননী-জায়া-কন্যার সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত মুক্ত মাতৃভূমির প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে দৈনিক আজাদীর প্রকাশ একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এটি শুধু দৈনিক আজাদী পত্রিকাকেই মর্যাদাসীন করেনি; বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ইতিহাসে প্রতিশ্রুত অধ্যায় নির্মাণ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিনকার সূচনা প্রহরে দৈনিক আজাদী পাঠ এবং নির্যাসকে ধারণ করেই চট্টগ্রামবাসীর সুখের নিদ্রায় রাত্রিযাপন পূর্ণতা পায়। ভোরের আলোর প্রত্যাশার সাথেই সম্পৃক্ত থাকে দৈনিক আজাদীর পাঠোদ্ধার। স্বাভাবিকভাবেই এটি চট্টগ্রামের অত্যুজ্জল ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রণিধানযোগ্য বাহন হিসেবে সমধিক জনপ্রিয় ও বরণীয়। প্রাসঙ্গিকতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মাঙ্গলিক’ কবিতার কয়েকটি পংক্তির উচ্চারণ; অত্যন্ত বৈরী সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে আজাদী পত্রিকার আবির্ভাব ও দীর্ঘ পদচারণার কৃতার্থ অভিবাদনের উদ্দেশ্যেই জ্ঞাপন করা যেতে পারে – ‘ভোরের বেলায় পূব-গগনে সূর্য্যিঠাকুর দেন উঁকি / বলেন, অলস জড়ের মতন ব’সে ব’সে করছ কি?/ আমার আকাশ-মায়ের কোলে জাগি আমি ভোর বেলায়,/ আমার হাসির উচ্ছলতা বনে বনে ফুল ফোটায়।/ ক্রমেই যত উর্ধ্বে উঠি ততই আমি হই প্রখর,/ শক্তি-তেজের উজল দ্যুতি ছড়াই বিশ্ব-ভুবন ’পর।/ রঙে রঙে রাঙাই আকাশ, যখন সাঁঝে অস্ত যাই,/ ত্রিলোক মলিন মোর বিদায়ে, যাবার বেলা দেখতে পাই।/ তোমার জীবন এমনি হ’বে শৈশবে আনন্দময় ;/ যেথায় যাবে, সেথায় যেন নূতন প্রাণের লহর বয় !’ পত্রিকা প্রকাশের পটভূমি এবং অত্যধিক সত্যনিষ্ঠতার নান্দিপাঠ নিবেদন না করলে এর অবদান বর্তমান সময়ে বিশেষ করে তরুণ পাঠক সমাজের হৃদয়ের গভীর উপলব্ধিতে প্রোথিত করা যাবে না।
কালের পরিক্রমায় বিশ্বায়ন-দমিত শতাব্দীতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিক্ষার গুনগত উৎকর্ষতা সামগ্রিকভাবে বিশ্ব-জনগণের জীবন মান উন্নয়ন, নগরায়ন, শিল্পায়ন, দারিদ্র বিমোচন তথা টেকসই আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং এর প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের গুরুত্ব অপরিসীম। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানবতাবাদী জনমুখী ও প্রগতিশীল দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ উন্নয়নে মননশীল, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের বহুমুখী ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম অগ্রগন্য চালিকা শক্তিরূপে সুদৃঢ়। উল্লেখ্য আচ্ছাদনে দৈনিক আজাদীর অবস্থান বরাবরই একাশ্রিত দীপ্যমান। আমাদের অনেকেরই জানা যে, খ্যাতিমান গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জেম্‌স হিকী, চার্লস ম্যাকলিয়েন, জেমস্‌ সিল্ক বাকিংহাম প্রমূখ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে জনগণের প্রিয়ভাজন হলেও শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে নির্বাসিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপরেও বহু অপরিমেয় ঘটনা রয়েছে; যাতে শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-অনাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন সংবাদ কর্মীদের কলম ও বাক্যরুদ্ধ করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।
উপরোল্লেখিত শোষণ-বঞ্চনার নাতিদীর্ঘ উদাহরণ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই আমাদের পর্যবেক্ষন ও আত্মস্থ করতে হয়েছিল। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক ভাষা অন্দোলনের অলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রথম পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর। এই পুস্তিকাটি প্রকাশের উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রামের অন্যতম কীর্তি পুরুষ অধ্যাপক আবুল কাশেম। ‘বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা ও অফিসাদির ভাষা’ অধ্যাপক আবুল কাশেমের বইয়ের মুখবন্ধে এই ভাবেই তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। চট্টগ্রামের বুকে হালদা নদীর কাছে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই মাদার্শার টেকে পাকিস্তানীরা প্রথম যে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল, এই হত্যার প্রতিবাদ ও ঘটনা পরম্পরায় বস্তনিষ্ট সংবাদ প্রকাশ করার জন্য দৈনিক পূর্ব পাকিস্তানের সম্পাদক আবদুস ছালামকেও অর্থদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল।
মাতৃভাষার দাবিতে ঢাকায় শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে রচিত চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান মাহবুব-উল-আলম রচিত কবিতাটি প্রথম ছাপানো হয় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার সূতিকাগার কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে। এ পুস্তিকাটি ছিল একুশের প্রথম সংকলন। এই প্রেসের স্বত্তাধিকারী দৈনিক আজাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অনুমতিক্রমে তৎকালীন প্রেস ম্যানেজার দবির আহম্মদ চৌধুরী প্রচন্ড সাহসীকতার সাথে এই কবিতাটি ছাপানোর দায়িত্ব নেন। ফলস্বরূপ পাকিস্তান সরকার পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করে কহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কাজ বন্ধ এবং দবির উদ্দিন সাহেব ছয় মাস কারাবরণ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থ থেকে কিছু অমিয় বাণী উল্লেখ করতে চাই ু ‘সদা সত্য কথা কহিবে। যে সত্য কথা কয়, সকলে তাহাকে ভালবাসে। যে মিথ্যা কথা কয়, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না, সকলেই তাহাকে ঘৃণা করে।’ ‘আমি যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ের সে কাজ করি। এজন্য বাবা আমাকে ভালবাসেন। আমি তাঁর কাছে যখন যা চাই, তাই দেন। যদি আমি এখন, পড়িতে না গিয়া, তোমার সহিত খেলা করি, বাবা আমাকে আর ভালবাসিবেন না।’ এসব অমূল্য চেতনা শাণিত বক্তব্যগুলোকে নুন্যতম আমলে নেয়নি বলেই বিশ্ব সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে পোঁছেও আদর্শিক ও নৈতিকতায় প্রচন্ড এক পশ্চাৎপদ অবস্থানে রূদ্ধ হয়ে আছে। মানুষের বিশ্বাস-চিন্তা-চেতনা-ভাবনার মূলে রয়েছে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মের মৌলিক মেলবন্ধন এবং বিশ্বমানবতাবাদে উজ্জীবিত অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, সত্য-সুন্দর-কল্যাণ ও আনন্দের জাগতিক সংযোগ উৎকর্ষতা।
সুশাসন বা সততা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার যৌগিক গতিময়তা বৃহত্তর পরিসরে একধরণের নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যাহ্নিক বলয় অতিক্রম করছে। সৎ-যোগ্য-মেধাবী-প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন যেন সমাজে অবমূল্যায়নের তলানিতে এসে ঠেকেছে। বড়ই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত আলোকময় এই জগৎ। পরিবর্তিত এহেন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ট-সত্যনিষ্ঠতা চর্চার বিশ্লেষণ অতীব প্রয়োজন। সত্যমানস, জ্ঞানঐশ্বর্যের প্রবুদ্ধ ধারক-বাহক এখনো বৈদগ্ধ বিশ্বাসের উপর ভর করে উপলব্ধি করতে চায় – গণমাধ্যম সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ ব্রতী হয়ে প্রবর্তমান অনুন্নয়নের উন্নয়ন নয়; বরং গণউন্নয়নের উন্নয়ন সংস্কৃতিকে জাগরিত রাখবে। গণবিচ্যুত গণমাধ্যম অপসংস্কৃতির নষ্টধারাকে বিশ্বময়তাদানে উন্নয়নশীল বিশ্বকে কতটুকু নির্মমভাবে প্রভাবিত ও দুর্বৃত্তায়নের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পরাঙ্গম, সচেতন বিশ্বজনিন মানবতাবাদি বিবেকবান মানুষের বোধে তা অত্যন্ত সুষ্পষ্ট।
প্রসঙ্গত: মহাত্মা গান্ধীর নিগূঢ় মন্তব্য – ‘আমি আমার ঘরটিকে চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত ও আমার জানালাগুলি বন্ধ রাখতে চাইনা। আমি চাই সকল দেশের সংস্কৃতি আমার ঘরের চারপাশে যত ইচ্ছা স্বাধীনভাবে এসে ভিড় করুক। কিন্তু তার কোনটি আমাকে স্থানচ্যুত করবে সেটা আমি হতে দেব না।’ নিত্যনৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা,ভাবাদর্শ, মূল্যবোধ, জ্ঞান আহরণ-বিতরণ ও সৃজনের প্রতিকী প্রকৃতি-প্রবাহ এবং পরিকর্ষ নিয়ামকে এর প্রায়োগিক বিনিময় আজকের দিনে গান্ধীজীর অমূল্য মন্তব্য কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ তা বিবেচনার দাবি রাখে। বস্তুতপক্ষে গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ, স্যাটেলাইট সংস্করণ, ফেইসবুক, ইন্টারনেট ইত্যকার ক্রমবর্ধমান উপকরণসমূহ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে জনপ্রত্যাশা পূরণের সক্ষমতা নিয়ে সমুদিত সংশয় অত্যধিক প্রবল।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার – নোবেল প্রাইজ প্রণেতা আলফ্রেড নোবেলকে গভীর স্মরণে আসছে। তিনি পরিহাস করে নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘কোনো ডাক্তারের উচিত ছিলো জন্ম মুহূর্তে তাঁর শোচনীয় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ : তিনি অর্থলোলুপ ছিলেন না।’ এই কঠিন সত্যকে যাঁরাই ধারণ করছেন তাঁরাই প্রতিমুহূর্তে সমকক্ষতা পরাভূত ব্যক্তি-গোষ্ঠীসৃষ্ট নির্মম সংকটে নিপতিত হচ্ছেন। এই বিপ্রতীপ সংশ্লেষ পুরো সমাজকেই বিপন্ন নির্বন্ধতায় আলোকনিবারিত করে তুলছে। সময়ের জোরালো দাবি – গণমাধ্যমের সত্যনিষ্ট লেখনি, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, মনন-সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ তারুণ্যের অদম্য সক্ষমতার অবগাহনে এক আধুনিক যুগের ব্যাবর্তন সংস্কৃতির উৎসমূলে থাকবে এবং প্রতিটি সভ্য জাতিগোষ্ঠীতে সুশাসনের সংসর্গ প্রতিস্থাপন করবে।
বরেণ্য যোগাযোগবিজ্ঞানী Tom Bethel বলেন, “The Press needs government to make headlines and the politicians need the press to get into the headlines. Their relationship is symbiotic. One group gets headlines, the other bylines. Both enjoy the same daily ‘Fix ”. এ বক্তব্যের বাস্তবতা সকল সমাজে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। দৈনিক পত্রিকার উন্নয়ন, প্রচার ও প্রসারের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন সরকার বা রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে সত্যনিষ্ট যাচাই-বাছাই, বিচার-বিশ্লেষণে তুলে আনা যা পত্রিকাকেও তার অবস্থান সুদৃঢ় করতে সহায়তা করে। এটি একটি প্রচলিত পারস্পরিক যোগসাজশ। চিরাচরিত শুদ্ধাচার, রীতি-নীতিকে অবজ্ঞা নয়, সমাজের অসংখ্য অসঙ্গতির গভীর অধ্যয়ন এবং সমস্যার সমাধান নিরূপনে উদ্ভাবিত নবতর পন্থার সমাহারে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যসাধনে দৈনিক আজাদীর সামগ্রিক পরিবেশনা পাঠক সমাজকে নিরন্তর আগ্রহী ও বশঙ্গত বর্ষিয়ান গণমাধ্যমের অভিভাবক বিবেচনায় প্রশংসিত।
দৈনিক আজাদী শহর, নগর ও গ্রামীণ জনপদের সকল ধরণের সংবাদ, বিজ্ঞাপন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, খেলাধুলা, শিক্ষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য, নৃত্য, বিতর্ক, গান, আবৃতি বিশেষ করে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পকিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, গবেষণা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যকার বিষয়গুলোকে গুরুত্বসহকারে প্রচার করে থাকে। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, অঞ্চল, গোত্র নির্বিশেষে আজাদীর পরিবেশনা অসাধারণ। রুচিশীল কৃষ্টি, ঐতিহ্য, চারুশিল্প, চলচিত্রের প্রকাশ ও বিনোদন প্রকাশের দৃষ্টিভঙ্গীও অনবদ্য। চমৎকারভাবে সুপঠিত এবং সুলিখিত শুধু কালো কালির মধ্যে নয় প্রিয় সংবাদ কর্মী ও সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধকার, প্রতিবেদকের লেখনিতে এই পত্রিকার সত্যনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। দৈনিক সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে সমসাময়িক, সাধারণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, বিভিন্ন অপরাধমূলক, সামাজিক, সাংগঠনিক সংবাদ সহ ইত্যাদি সংবাদসমূহ বিশেষভাবে বিবেচিত। বিগত কয়েক মাসব্যাপী আণুমানিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পত্রিকায় নিয়মিত সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ছাড়া উল্লেখিত নানা সংবাদ দৈনিক আজাদীর বহুমাত্রিক উদ্যোগ যথার্থ কার্যকারিতা পেয়েছে।
দৈনিক আজাদীর বর্ষপূর্তির এই দিনে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা পরম শ্রদ্ধেয় ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক, জাতির বিবেক-মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক-বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন সহচর প্রাক্তন সাংসদ ও পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, নির্যাতিত ম্যানেজার দবির উদ্দিন, প্রকাশকাল থেকে আজাদী পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়াত কলমযোদ্ধা, সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারি-হকারসহ সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মহান স্রষ্টার কাছে তাঁদের আত্মার শান্তি প্রার্থনা করছি। নিরপেক্ষ-বস্তুনিষ্ঠ নয়; সত্যনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ-পরিবেশন-সৃজনশীল প্রবাহ সৃষ্টি করে গণমাধ্যমের মর্যাদাকে সমাসীন করার অন্যতম প্রবক্তা একুশে পদকপ্রাপ্ত বর্তমান আজাদীর সম্মানিত সম্পাদক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব জনাব এম এ মালেক, সাংবাদিক, পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিত্ব, সম্মানিত পাঠক বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের প্রতি অজস্র অভিনন্দন এবং আজাদী পত্রিকার অদম্য অগ্রযাত্রার শুভ কামনা করছি।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদী পথ দেখায়, অন্যরা তা অনুসরণ করে
পরবর্তী নিবন্ধসাতকানিয়ায় বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা, যাত্রী নিহত