চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি : মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

আমিনুল ইসলাম | রবিবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারী ও তার পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশ সহ পুরো বিশ্বের মানুষ যখন অর্থনীতিকভাবে বিপর্যস্ত, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী উর্ধ্বগতি, ডলার সংকট, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ সহ সর্বক্ষেত্রে যখন সারাদেশে হাহাকার চলছে ঠিক সেই সময় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স ৫৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি মানুষের মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে দেখা দিয়েছে।
এই হটকারী সিদ্ধান্তে ভবন মালিকসহ ভাড়াটিয়ারাও অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে। জানা যায় চসিকের পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন শেষে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে নগরীর সরকারি ও বেসরকারির ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮ টি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ৮৫১ কোটি ৩০ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা পৌরকর আদায়ের প্রস্তাব করা হয় যা পূর্বে ছিল ১৩১ কোটি ৯১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৪১ টাকা। অর্থ্যাৎ এক লাফে ৫৪৫ দশমিক ৩২ শতাংশ গৃহকর বৃদ্ধি পায়। তখন এই এসেসমেন্টের বিরুদ্ধে জনমনে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ভবনের মালিকরা বিভিন্ন ব্যানারে চসিকের এই হটকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতে থাকে। প্রয়াত মেয়র এ,বি,এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ও সাবেক মেয়র মঞ্জুরুল আলম এর তীব্র বিরোধিতা করেন। ২০১৭ সালে ১৬ নভেম্বর গৃহকর বৃদ্ধি করায় জাতীয় সংসদেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মন্ত্রী ও এমপিরাও। একই বছর ২৬শে নভেম্বর স্থানীয় মন্ত্রণালয় এই অ্যাসেসমেন্ট স্থগিত ঘোষণা করেন। ৫ বৎসর পর ২০২২-২০২৩ অর্থ বছর থেকে পুনরায় স্থগিতকৃত পুরনো সেই গৃহকর আদায়ে কার্যক্রম শুরু করল চসিক। করদাতাদের বক্তব্য পূর্বে ভবনের মূল্যায়ন করা হতো বর্গফুটের ভিত্তিতে। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে রিঅ্যাসেসমেন্ট করা হয় ভবনের ভাড়া বা আয়ের বিপরীতে। এটা সম্পূর্ণ আইন বিরোধী কার্যক্রম। কারণ ভবনের আয়ের উপর ভবনের মালিকরা আয়কর পরিশোধ করেন, আবার একই আয়ের উপর যদি হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদান করতে হয় তবে একই উৎসের উপর ডবল ট্যাক্সেশন হয়ে যায়। যাহা আইনসিদ্ধ নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কোলকাতা, বোম্বে, দিল্লি সহ অন্যান্য শহরগুলোতে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শহরগুলোতে গৃহকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) ধার্য করা হয় ভবনের আয়তনের (বর্গফুটের) উপর ভিত্তি করে। ভবনের মালিকরা চসিকের এই একতরফা ও মনগড়া আইনবহির্ভূত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠিন আন্দোলনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তারা আরো জানান, বর্তমান মেয়র তার নির্বাচনী ইশতেহারে গৃহকর বৃদ্ধি না করার অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হবার পর আইনের দোহাই দিয়ে নির্বাচনী ওয়াদা ভঙ্গ করে গৃহকর বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে তার নির্দেশে চসিক কর্তৃপক্ষ বর্ধিত পৌরকরের উপর আপিল শুনানী নিষ্পত্তি করার জন্য করদাতাগণকে নোটিশ প্রদান করিতেছেন। ইহা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক। করদাতাগণ এই প্রহসনের নাটক অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে ২৮ মার্চ ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত চসিকের বর্তমান পর্ষদের ১৪ তম সাধারণ সভায় ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের স্থগিতকৃত গৃহকর মূল্যায়নের আলোকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছর থেকে কর আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। এতে চলতি জুলাই মাস থেকে তা কার্যকরের কথা বলা হয়।
চসিক সূত্রে আরো জানা গেছে গত ২ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব দেয় চসিক। পরদিন সিটি মেয়রের নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে। চসিকের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শহীদুল আলম এ বিষয়ে সহযোগিতা চান। এই প্রেক্ষিতে ১৮ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অবশ্য বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার চার মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৩ জুন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রদান করেছিলেন। ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া রিঅ্যাসেসমেন্টের আলোকে পৌরকর আদায়ের প্রস্তাব দেন। এর প্রেক্ষিতে ২৫ অক্টোবর সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় মন্ত্রণালয়। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পূর্বের স্থগিতাদেশ বহাল থাকায় সাধারণ ভবন মালিকরা রক্ষা পায় অতিরিক্ত করের বোঝা থেকে। এখন সেটাও কার্যকর হতে চলল। চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদ, চট্টগ্রাম নাগরিক ঐক্য পরিষদ সহ অনেক সংগঠন ইতিমধ্যে চসিকের এই হটকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামার অঙ্গীকার করেছে। উল্লেখ্য চসিকের নিজস্ব আয়ের কয়েকটি উৎসের মধ্যে পৌরকর একটি। সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই কোনো ভবনের ধার্যকৃত ভেলুয়েশনের উপর বার্ষিক ১৭ শতাংশ কর আদায় করে চসিক। তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর) ৩ শতাংশ বিদ্যুৎতায়ন রেইট এবং বাকী ৭ শতাংশ আবর্জনা অপসারণ রেইট আছে। লেখক: সভাপতি, চট্টগ্রাম কর সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅব্যবস্থাপনার যাঁতাকলে ঝরে গেলো শিক্ষকের প্রাণ
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে