অবাক করা সংবাদ হলো ‘৩৩ মন্ত্রণালয়ের কাছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পাওনা ২৩৪ কোটি টাকা’। গত ২৮ আগস্ট সংবাদটি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশের পর ব্যাপক তোলপাড় হয় নগরে। নাগরিকদের আড্ডার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ঘটনাটি। কেননা, সিটি কর্পোরেশনের গৃহকর বাড়ানোর জন্য সিটি মেয়র উঠে পড়ে লেগেছেন। সরকারি, আধা সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর্পোরেশন যদি কোটি কোটি টাকা বকেয়া রাখে এবং টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সাধারণ জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কোনো মানে আসে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের চেয়ে সরকারি, আধা সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করা বেশি উচিত।
আজাদীর সংবাদে বলা হয়, নগরের সাধারণ ভবন মালিকের চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পৌরকর (গৃহকর ও রেইট) পরিশোধ না করার প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমানে ৩৩ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বকেয়া পৌরকরের পরিমাণ ২৩৩ কোটি ৮৪ লাখ ৪২ হাজার ১৯০ টাকা। বকেয়া পরিশোধে বারবার তাগাদা দিলেও সাড়া দিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে (২০২১-২০২২) ১৯৩ কোটি ৮ লাখ ৬১ হাজার ৯০৭ টাকা পৌরকর আদায় হয়। এর মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মালিকানাধীন হোল্ডিং থেকে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায়ের হার ছিল ৫৪ শতাংশ। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় হয়েছে ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠানের পৌরকর পরিশোধের অনীহার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
এ প্রসঙ্গে আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপুল অংকের ট্যাক্স বকেয়া রেখে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায়ের বিষয়টি নগরপিতার ভেবে দেখা উচিত। সরকারি প্রতিষ্ঠান দিবে না, তাহলে সাধারণ মানুষের দোষ কী। আমি মনে করি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বকেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সম্মতি আদায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবর উপানুষ্ঠানিক পত্র (ডিও লেটার) দিতে পারেন বর্তমান মেয়র। এরপর সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্রোকি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। এর মাধ্যমে তাদের এই বার্তা দেয়া, যদি ট্যাক্স পরিশোধ না কর তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো।
গৃহকর বাড়ানো প্রসঙ্গে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম তাঁর এক লেখায় বলেছেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব রেজাউল করিম চৌধুরী সিটি কর্পোরেশনের গৃহকর বাড়ানোর জন্য ১৯৮৬ সালের ‘দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস’ অধ্যাদেশের ২১ ও ২২ ধারার বিধি মোতাবেক বাড়িভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণের মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছেন। ২০২১ সালে আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে ভূতপূর্ব মেয়র জনাব আ জ ম নাছির ২০১৬ সালে একই অধ্যাদেশের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণ করতে গিয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা হারিয়ে চরম বিপদে পড়েছিলেন। ঐ ভুল অধ্যাদেশের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণ করায় বর্ধিত গৃহকর বিদ্যমান করের তুলনায় ছয়গুণ থেকে দশগুণ বেড়ে যাওয়ায় ঐ সময় ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত জনপ্রিয় মেয়র জনাব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীও আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন। এর কিছুদিনের মধ্যে একই ভুল অধ্যাদেশ অনুসরণ করতে গিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তদানীন্তন মেয়র জনাব সাঈদ খোকনকেও ব্যাপক আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয়েছিল। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আন্দোলনের তীব্রতায় তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পুরো ব্যাপারটা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও জনাব রেজাউল করিম চৌধুরী ভুল অধ্যাদেশটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার পরিবর্তে আবারো ঐ অধ্যাদেশটি অনুসরণ করে গৃহকর বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, সিটি মেয়র বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলে চলেছেন যে সংক্ষুব্ধ করদাতা সিটি কর্পোরেশনের কাছে আপিল করলে গৃহকর কমিয়ে দেওয়া হবে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে পারি, এতে অনিয়ম ও দুর্নীতির রাস্তাটি প্রশস্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছেন তিনি। সিটি মেয়র মহোদয়ের যদি কর কমিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে থাকে, তাহলে আপিল ছাড়াই কমাতে পারেন। আপিলের মাধ্যমে তা কমাতে গেলে শুধু দুর্নীতিই বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। অযৌক্তিক ভাবে গৃহকর বাড়িয়ে দিয়ে সিটি মেয়র যেভাবে সাধারণ নাগরিকের কাছে বিরাগভাজন হচ্ছেন, তার ব্যাপারে নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন আছে।