ইতিহাস সবসময় সত্যকে ধারণ করে। যতোই ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চলুক না কেন, একদিন ঠিকই সত্যটা উদঘাটিত হয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশ এক এবং অভিন্ন সত্তা। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী, বাংলাদেশ বিরোধী, দেশীয় বেঈমান ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের পরাজয়ের সুপরিকল্পিত জঘন্য ও কাপুরুষোচিত নির্মম প্রতিশোধ ছিল এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিভীষিকাময় ঘটনা এ হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সদ্য বিবাহিত শেখ কামাল, তার নববধূসহ পরিবারের সকল সদস্য, আপনজন এমনকি বাবা মায়ের কোলে থাকা ছোট্ট রাসেলও সেই বর্বর হানাদের হাত থেকে রক্ষা পায় নি।
শোকাবহ সেই কালো রাত্রিকে উপজীব্য করে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) মাল্টিপারপাস শেডে বাংলাদেশ পুলিশ থিয়েটারের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘অভিশপ্ত আগস্ট’। গতকাল ছিল নাটকটির ১০৮তম মঞ্চায়ন। চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো পুলিশ সদস্যদের অভিনীত ইতিহাস আশ্রয়ী গবেষণালব্ধ ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নাটকটি মন কেড়েছে উপস্থিত দর্শকদের।
সন্ধ্যায় নাটক শুরুর আগেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী, পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের সংস্কৃতিনুরাগী, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্য এবং সিএিমপির বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্যরা নাটকটি উপভোগ করেন।
নাটকটিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই হত্যাকাণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটি ঘিরে কর্মব্যস্ততার চিত্র দেখে বোঝারই উপায় ছিলনা কিছুক্ষণ পরই বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস এই বাড়ি হয়ে উঠবে বীভৎস এক মৃত্যুপুরী। খলনায়ক খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ঘাতক চক্রের মিত্রতা, কর্নেল রশীদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিনসহ পর্দার আড়ালে থাকা মাস্টারমাইন্ডদের দেশ দখলের নীলনকশা তৈরি এবং সে ষড়যন্ত্রে সাম্রাজ্যবাদী প্ল্যানারদের ষড়যন্ত্রের বীজ বুনন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং ক্ষমতা দখল ইত্যাদি নানা বিষয় নাটকটিতে তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের নিখুঁত অভিনয়ে অতিথিসহ দর্শকদের অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। নাটক শেষে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
নাটক শেষে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, নাটকটির মাধ্যমে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মকে বার্তাটি দেওয়া। তারা জানে না পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ভয়াবহতা। অনেকে বই পড়ে জেনেছে। নাটকটি দেখার আগে পর্যন্ত মনে হতো পুলিশ বুঝি তার ডিউটির বাইরে আর কিছু করে না। কিন্তু এই নাটকে যারা অভিনয় করেছেন, প্রত্যেকে যার যার চরিত্রের সাথে এতটাই একাত্ম হয়ে গেছেন যে, মনে হচ্ছিল পেশাদার নাট্যকর্মী তারা। আগামীতে এ ধরনের আরো নাটক দেখতে চাই পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন। ওই কালো রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিরল। নাটকটিতে সেই দিনের ঘটনাটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজারবাগ থেকে প্রথম প্রতিরোধ করেছে পুলিশ। প্রথম রক্ত দিয়েছে পুলিশ, প্রথম শহীদ হয়েছে পুলিশ। ১৫ আগস্টের কাকডাকা ভোরে নৃশংসতার ঘটনাটি নতুন প্রজন্ম এই নাটকটির মাধ্যমে জানতে পারবে। নাটকটির নির্দেশনা, প্রযোজনা, অভিনয় সবকিছুই করেছে পুলিশ সদস্যরা। তারা জাতির পিতার চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে নাটকটিতে অভিনয় করেছে বলেই নাটকটি এতটা মর্মস্পর্শী হয়েছে।
দৈনিক পূর্বকোণের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, পুলিশরা যে হৃদয় বিদারক নাটকটি মঞ্চস্থ করলেন, আসলে মন ছুঁয়ে গেছে। তারা চমৎকারভাবে সব বিষয়গুলো তুলে নিয়ে এসেছেন। এ সময় তিনি নাটকটির অভিনয় শিল্পীদের ধন্যবাদ জানান।
নাটকটির রচয়িতা, নির্দেশক ও অভিনয় শিল্পী মো. জাহিদুর রহমান বলেন, ১৫ আগস্টের ঘটনায় হত্যা মামলার নথিপত্র ও বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নাটকটি রচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ একটি রেকর্ড করেছে। আর কোনো মঞ্চ নাটক এক বছরে শততম মঞ্চায়ন করতে পারে নি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে হত্যার ঘটনা আমাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। নাটকে ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড, আর্তনাদ, ষড়যন্ত্রসহ সবদিক উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি আমি।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তার, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ প্রমুখ। তাঁরা বলেন, যদিও এটি নাটক। তবে তা বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে করা হয়েছে। প্রত্যেকের অভিনয় হৃদয় ছুঁয়েছে। এমন নাটক দেশের প্রতিটি জেলায় হওয়া উচিত। যাতে করে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম এই নাটক থেকে ইতিহাস জানতে পারে। প্রত্যেকেই খুব মর্মস্পর্শী অভিনয় করেছে। মনে হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে মঞ্চের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসায় তাঁরা বাংলাদেশ পুলিশের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।
প্রসঙ্গত, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমানের তথ্য, সংকলন ও গবেষণায়, পুলিশ পরিদর্শক জাহিদুর রহমানের রচনায় ও নির্দেশনায় এবং বাংলাদেশ পুলিশ থিয়েটারের প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে ‘অভিশপ্ত আগস্ট’। আজ (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ লাইনে নাটকটি মঞ্চস্থ হবে।












