চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পড়েছে দেশের চা শিল্প। টানা ১৫ দিনের কর্মবিরতিতে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি ছাড়াও চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বাগানে পাতা বড় হয়ে যাওয়ায় উৎপাদনে ধস দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ২১টি বাগানে ৩০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বাগান মালিকরা জানিয়েছেন।
অপরদিকে এই পাতা ছেঁটে ফেলার পর নতুন কুঁড়ি গজানোর জন্য অন্তত দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। সবকিছু মিলে ১৫ দিনের কর্মবিরতির ধকল সামলে বাগানকে স্বাভাবিক গতিতে আনতে ভর মৌসুমে অন্তত এক মাসের ধাক্কা খেল চা শিল্প। এটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানা যায়, ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরে ১৮৫৪ সালে সিলেট অঞ্চলে চা চাষ শুরু হয়। দেশে বর্তমানে ছোট-বড় মিলে ২৫৬টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু বাগান বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনোটি পরিত্যক্ত। দুইশর কাছাকাছি বাগানে নিয়মিত উৎপাদন চলে। দেশের সবচেয়ে বড় চা বাগানসহ চট্টগ্রামে বাগান রয়েছে ২১টি। তবে সবচেয়ে বেশি বাগান রয়েছে মৌলভীবাজারে, ৯১টি। এছাড়া হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙামাটিতে ২টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান রয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চলের পাশাপাশি সমতল ভূমিতেও চা চাষ হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ১ লাখ ৬২ হাজার একর ভূমিতে চা চাষ করা হচ্ছে। গত ১০ বছরে চা চাষের আয়তন ৩০ হাজার একরের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালে দেশে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার ৬শ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার কেজি বেশি। চলতি বছর দেশে চা উৎপাদন ১০ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
২০২৫ সালে ১২ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল সরকার। কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলন চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের দেয়া তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত চা শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৩ হাজারের কিছু বেশি। অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। দেশে মোট চা শ্রমিক পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ লাখের কাছাকাছি।
শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে সময়মতো চা পাতা উত্তোলন না করায় চট্টগ্রামের ২১টিসহ সারা দেশের বাগান মালিকদের কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রামের বাগানগুলোতে ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে একাধিক বাগান মালিক জানিয়েছেন, এর মধ্যে কোটি কোটি টাকার পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। বড় হয়ে যাওয়ায় যেগুলো থেকে আর মানসম্মত চা তৈরি হবে না। নতুন কুঁড়ি না গজানো পর্যন্ত ভালো মানের চা পাওয়া যাবে না। চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্র জানিয়েছে, চা শ্রমিকেরা তাদের দৈনিক বেতন ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করাসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করে। ১৩ আগস্ট সাপ্তাহিক ছুটির পরদিন ১৪ থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত টানা কর্মবিরতি পালন করে। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকর স্থলে ১৭০ টাকা নির্ধারণ হওয়ায় শ্রমিকেরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেয়। চট্টগ্রামে প্রায় ১৬ হাজার শ্রমিক রয়েছে। চট্টগ্রামের চা শ্রমিকদের পরিবারগুলোর বাসিন্দা প্রায় ৩৯ হাজার।
চা বাগানের ভর মৌসুম হচ্ছে আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস। এই তিন মাসে প্রচুর চা উৎপাদন হয়। কিন্তু এবার ১৫ দিনের আন্দোলনের কারণে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
কয়েকটি চা বাগানের কর্মকর্তারা বলেছেন, চট্টগ্রামের ২১টি বাগান থেকে দৈনিক প্রায় ৪ লাখ কেজি চা পাতা সংগ্রহ করা হয়। আন্দোলনের কারণে এসব বাগান থেকে অন্তত ৬০ লাখ কেজি চা পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এসব পাতা প্রক্রিয়াজাত করে অন্তত ১৫ লাখ কেজি চা পাতা পাওয়া যেত, যার পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে।
চা বাগানের একাধিক মালিক বলেছেন, শুধু চা পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি সেটা নয়, একই সাথে আরো অন্তত ১৫ দিনের জন্য বাগানগুলো পিছিয়ে গেছে। টানা ১২ দিনসহ ১৫ দিন পাতা সংগ্রহ না করায় প্রতিটি পাতা বড় ও ভারী হয়ে গেছে। এসব পাতা ছেঁটে ফেলা না হলে নতুন কুঁড়ি আসবে না। তাই প্রতিটি বাগানে এখন পাতা ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। ছেঁটে ফেলা পাতাগুলো বাছাই করে সামান্য পরিমাণে চা উৎপাদন সম্ভব হবে। বেশিরভাগ পাতা ফেলে দিতে হচ্ছে।
চা বাগান মালিকেরা গতকাল আজাদীকে বলেন, ১৫ দিনের আন্দোলন অকল্পনীয় ব্যাপার। দেশের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় চা বাগান অচল রাখার নজির নেই। এই আন্দোলনে বিশেষ মহলের চক্রান্ত আছে। ১২০ টাকা মজুরির মিথ্যা কাহিনী প্রচার করে আন্দোলন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা হলেও তারা যে মাত্র এক টাকা কেজি দরে চাল ও গম পায়, সেটা বলেনি। তারা প্রভিডেন্ট ফান্ড পায়, চিকিৎসা পায়, আবাসন পায়, শিক্ষা পায়, সবজি ফলানোর জমি পায়। তাছাড়া প্রতিদিন তারা ২৩-২৪ কেজি পর্যন্ত পাতার জন্য ১২০ টাকা পেলেও এর বাড়তি প্রতি কেজি পাতার জন্য ৫ টাকা করে পায়। সবকিছু মিলে একজন শ্রমিক বর্তমানে ২৩-২৪ কেজি পাতার তোলার জন্য গড়ে ৪১৭ টাকা মজুরি পায়।
মজুরি বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করতে হয় না উল্লেখ করে তারা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়। মজুরি বাড়ে। করোনাকালে কিছুটা সমস্যা হওয়ায় এবার ইনক্রিমেন্ট দিতে কিছুটা দেরি হয়েছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ মহল শ্রমিকদের মাঠে নামিয়ে এই সেক্টরটিকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে।
চট্টগ্রামের শীর্ষ এক চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার গতকাল আজাদীকে বলেন, শ্রমিকদের এই আন্দোলনে শুধু বাগান মালিক নয়, সরকারও কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে। চা শিল্প থেকে সরকার ভ্যাট, ট্যাঙসহ নানাভাবে রাজস্ব আয় করে। টি বোর্ডকে টাকা দেয়া হয়। সবকিছু মিলে সরকারের অন্তত ৪০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ১৭০ টাকা নির্ধারণ করায় ব্যাপারটি মেনে নিয়ে বাগান মালিকেরা বলেন, এখন সরকারিভাবে কিছু সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা না হলে এত টাকা মজুরি দিয়ে বাগানগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। সরকার ব্যাংক ঋণের সুদ, ভ্যাট ট্যাঙ, শ্রমিকদের রেশন ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিতে পারে।
মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে চা পাতার দাম বেড়ে যাবে উল্লেখ করে একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা পাতা বিক্রি করি নিলামের মাধ্যমে। এতদিন গড়ে ১৯০-২১০ টাকার মধ্যে প্রতি কেজি পাতা বিক্রি হতো। এখন নিলামে পাতার দাম ৩০০ টাকার কাছাকাছি চলে যাবে। নিলামে ৩০০ টাকা হলে খুচরা বাজারে ভালো মানের পাতার দাম ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় গিয়ে ঠেকবে।