
গত বছর দিনপঞ্জী বাবদ যখন আষাঢ়ের প্রথম কদমফুল ফোটার সময় ঘনিয়ে আসছে, সেই সময়টায় আমার প্রকৃতিপ্রেমী প্রথিতযশা স্নায়ুশল্যচিকিৎসক পিতা প্রফেসর ডা. এল এ কাদেরী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালের কেবিনে বিছানাবন্দী, ‘The Emperor of all Maladies’ সেই দুরারোগ্য কর্কটব্যাধির সাথে সমস্ত মনোবল দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রতিটি মুহূর্তে। যেই বাবাকে সমগ্র ইন্দ্রিয় দিয়ে জীবনের রূপরস আস্বাদনে ভরপুর দেখতে অভ্যস্ত আমি, সেই বাবার চলৎশক্তিহীন এই করুন দশা বাবার সাথে থাকা মা ও আমাকে তীব্র মানসিক অসহায়ত্বে হতবিহ্বল করে তুলছিলো বিশেষ করে অতিমারীর কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সেই বিষাদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। খেয়াল করেছি এর মাঝে বাবার বৃহত্তর চিকিৎসক পরিবারের সদস্য, পুরনো ছাত্র এবং সহকর্মীদের উপস্থিতি ও সান্নিধ্য বাবার বেদনাক্লিষ্ট মুখে সাময়িক আনন্দের দ্যুতি বয়ে আনতো, তা আমার কাছে এক পরম স্নেহপরায়ণ শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিতো।
তখন হাসপাতালে বাবার ছয়তলা লেকভিউ কেবিনের জানালাটিই যেনো ছিলো বাইরের পৃথিবীর সাথে আমাদের একমাত্র যোগসূত্র, তাই দুঃসহ সেই সময়টায় জানালার বাইরে তাকিয়ে অস্থির মনকে একটু শান্ত রাখার বিফল চেষ্টা করে যেতাম, চোখের জলে লেকের শান্ত পানির দৃশ্যপট ঝাপসা হয়ে আসার আগ পর্যন্ত সেই ক্ষণিকের জন্য। স্থবির সেই সময়টা আমাদের জন্য স্থির প্রতিপন্ন হলেও প্রকৃতির নিয়মে ঋতুবদলের পালা আসে চিরন্তন ছন্দে, সময় তো কারোর জন্য থেমে থাকেনা।
তো অবশেষে একদিন শেষ বিকেলে আকাশ ভার করে বৃষ্টি নামলো, লেকের দৃশ্যপট আবারো মুহূর্তেই অস্পষ্ট -এবার বৃষ্টির জলের ঝাপটায়। আকাশ পরিষ্কার হতেই আবিষ্কার করলাম পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠেছে লেকের চারিদিক। অগুনিত টিয়ার ঝাঁকে ঝাঁকে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে উড়ে যাওয়া, সারি সারি শুভ্র বলাকার লেকের শীতল পানিতে অবগাহন, যেনো বর্ষণবন্দনায় মত্ত তারা।
মনে পড়ে না কখনো আগে শঙ্খচিল স্বচক্ষে দেখেছি কিনা, তাই প্রথম বারের মতন একজোড়া সোনালী ডানার সেই শঙ্খচিলকে অবিশ্বাস্য গতিতে লেকের পানিতে ছোঁ মেরে হয়তো তাদের আহার্য্য যোগাড় করে পর মুহূর্তেই উন্মুক্ত আকাশে তাদের অলস প্রস্থান করার দৃশ্য আমার বিস্ময়বোধকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিলো। তাই নিজের অজান্তেই সুউচ্চ কণ্ঠস্বরে পুলকিত হয়ে বলে উঠলাম ‘বাবা বাবা দেখো শঙ্খচিল’! বাবা শুনে উঠে বসে সাথে সাথে দেখতে চাইলো ঠিক শিশুদের মতন অবাক বিস্ময়ে। বাবার বিছানা থেকে জানালা বেশ উঁচুতে তাই আমি বিছানা ওঠানোর বোতামটা ক্রমাগত চাপতে থাকলাম একেবারে যতদূর ওঠানো যায় ততক্ষণ পর্যন্ত। বাবার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ‘এইতো আমার পাখিরা’ শুনে বুঝলাম বাবা এখন দেখতে পাচ্ছে আর আমি আমার বাবাকে অপলক দেখা শুরু করলাম কারণ বাবার বুদ্ধিদীপ্ত চোখের তারায় হঠাৎ খুশীর ঝলকানিতে, বাবার ঠোঁটের কোণায় নির্মল হাসিতে আমার সেই জীবনশক্তিতে টইটমু্বর বাবাকে আবারো যেন আমার একদম কাছে ফিরে পেয়েছিলাম।
সেইদিনটাই যেনো বর্ষার আগমন জানান দিলো আর পাখিদের আনাগোনা লেগেই থাকলো রোজ। বাবার সাথে মিতালী গড়ে উঠলো পাখিদের তাই ভোরের প্রথম আলোয় জানালার পর্দা তুলে দিতেই বাবা খুঁজতেন তাঁর আদরের পাখিদের। আবার শেষ বিকেলের নরম আলো যখন বাবার মুখে এসে পড়তো আমি পর্দাটা টেনে দেবার আগে অনুভব করতাম বাবার চঞ্চল শিশুসুলভ চাহনীতে দিনের শেষে পাখী বন্ধুদের বিদায় দেবার আকুলতা।
পাখিদের সাথে বাবাকে পরম মমতায় কথা বলতে শুনে বিস্মিত হইনি, আমারও তো একলা ঘরে বিদেশ বিঁভূইয়ে দিন কাটে সঙ্গী সাথি বিড়াল ছানার সাথে মনের কথা বলে। তাই বুঝতাম এভাবে মনের ভাব আদান প্রদানের মধ্যে একটা প্রশমনী প্রভাব আছে যা বাবার শরীরের গহীনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অশুভ কর্কট রোগটাকে যদি সাময়িক ভাবে হলেও দমিয়ে রাখতে পারে তো ক্ষতি কী।
বেলা শেষে একদিন বাবাকে বলতে শুনলাম ‘এই পাখিরা, তোমরা যাবে, যাবে আমার সাথে হাটহাজারী আমাদের গ্রামে’? এরপর যেনো একটু দাবির সুরেই বললেন ‘আমি তোমাদের নিয়েই যাবো হাটহাজারীর বিলে, তোমরা আমার সাথে ওখানেই থাকবে’। আমার কেন যেন একথাটা শুনে মনটা ভীষণ বিষণ্ন রকমের উদাস হয়ে গেলো, বাবার এই আবদারের মাঝে কোথায় যেনো একটা মিল খুঁজে পেলাম ছোটবেলায় পড়া রবি ঠাকুরের ডাকঘরের অমলের সেই অন্তিম আকুতির সাথে -ঘনঘোর আঁধার নামার আগে পাখিদের দেশ ক্রৌঞ্চ দ্বীপে একটিবার যাবার তরে। বুঝতে পারলাম যে মাটির টানে দিনের পর দিন শয্যাশায়ী বাবার মন উথাল পাতাল করছে, বিলেত ফেরত বিশ্বমানের চিকিৎসক হলেও বাবা আসলেই মাটির সন্তান, বহুতল শহুরে অট্টালিকা গড়ার হাতছানি উপেক্ষা করে নিজের গ্রাম হাটবাজারীতে গড়ে তুলেছেন বিদ্যালয়, কলেজ এবং আরো অনেক শিক্ষা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান , মাটির টান আসলেই বোধ করি এটাই। বাবার এই আত্মকথন শুনতে শুনতে কখন যেনো চোখের সামনে লেকে জলকেলীরত বাবার পাখিদের অবয়ব আবছা বিন্দুতে পরিনত হয়ে ক্রমশঃ বিলীন হয়ে গেলো।
বিদেশ পাড়ি দিয়ে চলে আসার আগে হাসপাতালের সেই কেবিনেই বাবাকে আমার শেষ দেখা তাই কখনো জানা হয়ে উঠবে না বাবা হাটহাজারীতে পাখিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন কিনা শেষ অব্দি নাকি সেই পাখিবন্ধুর ডানায় ভর করে মিলিয়ে গেছেন অনেক অনেক উঁচুতে আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে তবে মনের গহীনে এটুকু জানি হাটহাজারী গ্রামে আমি বাবার পাখিদের খুঁজে বেড়াবো নিরন্তর। নজরুলের কাঠবিড়ালীর সই পাতানো সেই অবুঝ খুকির মতন শুধাবো বারংবার ‘ও শঙ্খচিল, ও ময়না টিয়ে, তোমরা কি আমার বাবাকে দেখেছো কোথাও’?
লেখক: যুক্ত্ররাষ্ট্রের টেক্সাসে কর্মরত গবেষক ও বিজ্ঞানী, ডা. এল এ কাদেরীর কন্যা












