শোকগাথা আগস্ট এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছন্দপতন

ড. নারায়ন বৈদ্য | রবিবার , ২৮ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

আগস্ট মাস। বাঙালি জাতির শোকের মাস। এ মাসেই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে এ দেশেরই কিছু অকৃতজ্ঞ লোক যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য বেঈমানের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। অথচ স্বাধীনতা লাভের জন্য, শত শত বছরে পরাধীন হতাশাগ্রস্ত, দারিদ্রপীড়িত, শিক্ষাদীক্ষা বঞ্চিত মৃতপ্রায় বাঙালি জাতিকে তিনি তাঁর যাদুকরি নেতৃত্বে উদ্দীপিত ও অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা একজন নেতা। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮’র সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬’র ৬-দফা, ৬৯’ গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচনসহ বাঙালির মুক্তি ও অধিকার আদায়ে পরিচালিত প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। ফাঁসির মঞ্চেও তিনি বাংলা ও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতা অর্জনে যেমন, তেমনি দেশ গঠনেও তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে হাতে নিয়ে সাহসিকতার সাথে দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। এক বছরের মধ্যে দেশকে তিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী একটি সংবিধান উপহার দেন। সুদক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলেন। সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশবাহিনী গঠন করেন। বাংলাদেশের একমাত্র সামরিক একাডেমি তাঁরই হাতে গড়া। তিনি ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। পাকিস্তানে আটকে পড়া নাগরিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গকে আর্থিক সাহায্য প্রদান ও নির্যাতিতা মা-বোনদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন এবং আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
শিক্ষা ও নৈতিকতা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব আরোপ করেন। মদ, জুয়া, হাউজি সহ সব ধরনের ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা বোর্ড গঠন, পবিত্র হজব্রত পালনে সরকারি অনুদান প্রদান, তাবলীগ জামাত অনুষ্ঠানের জন্যে জায়গা দান ইত্যাদির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ইসলামি মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার প্রয়াসী হন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসারে জাতির জনক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্যে গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ প্রণয়ন, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ, ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারিকরণ, বহুসংখ্যক স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ এবং শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৃষক ও কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল- পাকিস্তান আমলের বকেয়া খাজনাসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কয়েক লাখ কৃষি ঋণের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, চাষীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণদান নিশ্চিত করা, ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বিতরণ, বিনামূল্যে কীটনাশক ঔষধ, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দানের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে সার, বীজ ও যৎসামান্য ভাড়ায় পাওয়ার পাম্প ও গভীর নলকূপ সরবরাহ ইত্যাদি। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে আস্তে আস্তে অর্থনীতি স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। দেশে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে হার্ডিঞ্জ ও ভৈরব সেতুসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরি, ১৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগি, ৪৬০টি বাস, ৬৫০টি নৌযান ও ৩টি পুরাতন বিমান চালু করে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে অচল নদী ও সমুদ্র বন্দরসমূহ চালু করেন।
পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি উৎপাদনক্ষম প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে চালু করার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারীর রুটি-রুজির সংস্থান করেন। নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গিকারের প্রতিফলন ঘটিয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দিকনির্দেশনায় কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। জিডিপি বৃদ্ধির হার তখন ছিল সাত ভাগের মতো। সরকারি কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল ও সাংবাদিকদের প্রথম বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বঙ্গবন্ধুই প্রথম ঘোষণা করেন।
১৯৭৩ সালে লাহোরে ইসলামি ঐক্যসংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে শর্ত ছিল আগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দিতে হবে। স্বীকৃতি আদায় করে মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত এবং পি,এল,ও নেতা ইয়াসির আরাফাতের মধ্যস্থতায় তিনি ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, দেশের মর্যাদা ও সম্মানকে তিনি সবচেয়ে ওপরে স্থান দিতেন। ইসলামি উম্মাহভুক্ত হওয়া এবং আরব বিশ্বের সাথে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রয়াসকে সে সময় অনেক বন্ধুরাষ্ট্র ততটা সুনজরে দেখেনি। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেননি। সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ তিনিই নিয়েছিলেন। সৌদি আরবের তদানীন্তন বাদশাহ ফয়সল বিন আবদুল আজিজ বঙ্গবন্ধুকে ‘শ্রেষ্ঠ মানব’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ভারত ও রাশিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি গণচীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে যান। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা যেমন- ফারাক্কার ৪৪ হাজার কিউসেক পানি আদায় করেন। লাঠিটিলাসহ একাধিক ছিটমহল আদায়, সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি ইত্যাদি বঙ্গবন্ধুরই কৃতিত্ব।
উল্লেখ্য যে, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা চুক্তি তাঁরই সময়ে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর সময়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ছিল উজ্জ্বল। জাতিসংঘ ও সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদসহ ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে একটি বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের জন্যে তাঁকে ‘জুলিওকুরি’ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশকে সব দিক থেকে যখন বঙ্গবন্ধু এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক এ সময়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। এ অধ্যায়ের দিনটি ছিল ১৫ আগস্ট। এ কারণে বাঙালি জাতির নিকট আগস্ট মাসটি হয় শোকগাথা। ১৯৭৫ সালের এ দিনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে এ দেশের ক্রম উন্নয়নের ধারাও স্থিমিত হয়ে যায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রগতিশীল ও মুক্তমনের কবি শামসুন নাহার
পরবর্তী নিবন্ধকাগতিয়া বাজারে আগুনে পুড়েছে ৪ দোকান ও বসতঘর