সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) কথাসাহিত্যিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত। মানুষের মনোবাস্তবতার সাথে বহির্বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়ে বাস্তবধর্মী জীবননির্ভর কাহিনি নির্মাণের নিপুণ বুননশিল্পী হিসেবে তিনি অসাধারণ। অথচ মজার ব্যাপার হলো তার সৃষ্টিকর্ম একেবারে হাতে গোনা। ১৯২২ সালের ১৫ জুন চট্টগ্রাম শহরের ‘ষোলশহর’এ জন্মগ্রহণকারী (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচনাবলী, প্রথম খণ্ড -সৈয়দ আকরাম হোসেন সম্পাদিত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রসঙ্গ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। জানুয়ারি ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ৩৮১) এবং ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে মৃত্যুবরণকারী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আয়ু পেয়েছিলেন ৪৯ বছর। এই জীবনকালে তিন দশক জুড়ে তিনি তার সৃষ্টিশীলতাকে সক্রিয় রেখেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ৯ (নয়), যা সংখ্যাবিচারে মোটেই সুপ্রচুর নয়।
[হায়াৎ মামুদ- দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার ‘সাহিত্যঃ কালের মাত্রা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, তাঁর (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর) সমস্ত লেখা পুঞ্জিভূত করে দু-খণ্ডে যে রচনাবলি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে তার পৃষ্ঠাসংখ্যা আটশ’র ওপরে যায়নি। পৃ. ২১৫]। তা সত্ত্বেও সাহিত্য বিচারে তার রচনাবলী আপন স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। বিশালায়তন ভল্যুমের সাহিত্য সৃষ্টি না করেও পাঠক চিত্ত জয় করা খুব কম সংখ্যক লেখনীর মাধ্যমেও যে খ্যাতির পাল্লা ভারী করা যায়, তার প্রমাণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ম্যাজিস্ট্রেট পিতার সন্তান হওয়ার সুবাদে ছাত্রাবস্থায় প্রায় সময়েই পিতার কর্মস্থল বদলের সাথে সাথে নিজেও স্থান বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকা বদলের ফলে অচেনা পরিবেশে এক ধরনের একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা তার মনোজগতকে প্রভাবিত করে, যা তাকে আত্মমগ্ন ও বহুমুখী করে তোলে। পরবর্তীতে এ-প্রবণতাই তার মাঝে সৃজন করে লেখক মানস। ফেনী স্কুলের দেওয়াল পত্রিকা ‘ভোরের আলো’র সম্পাদনা, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অধ্যয়নকালে কলেজ বার্ষিকীতে (১৩৩৯সালে) ‘সীমাহীন এক নিমিষে’ গল্প (১৭ বছর বয়সে লিখিত ‘সীমাহীন এক নিমিষে’ই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম প্রকাশিত গল্প) প্রকাশের মাধ্যমে তিনি নিজের সৃষ্টিশীলতা বিষয়ে জানান দিলেও ১৯৪১/৪২ সাল থেকেই সওগাত, মোহাম্মদী, পূর্বাশা, চতুরঙ্গ, মাহে নও, পরিচয়, মৃত্তিকা, সংলাপ ইত্যাদি পত্রিকা তাঁর লেখা প্রকাশ করতে থাকে।
তিনি প্রধানত ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনায় মনোনিবেশ করে এক্ষেত্রে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করলেও তার কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশের খবরও পাওয়া যায়। মাসিক ‘সওগাত’ এর ফাল্গুন ১৩৪৯ সংখ্যায় ‘প্রকল্প’ এবং ‘মৃত্তিকা’ পত্রিকার গ্রীষ্ম ১৩৫০ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ‘তুমি’ নামে তার দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া ‘খেয়া’ নামে তার এ-পর্যন্ত প্রাপ্ত একমাত্র প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ফাল্গুন ১৩৫০ বঙ্গাব্দে। কবিতা ও প্রবন্ধের ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তেমন নজর না দিলেও গল্প-উপন্যাসে তিনি সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করেন। তিনি ১৯৬১ সালে উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে ‘দুই তীর’ গল্পগ্রন্থের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ‘বহিপীর’ নাটকের জন্য পি.এ.এন পুরস্কারের মতো মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার লাভ করেন। যদিও সমসাময়িক কবি আবুল হোসেন জানান, ‘এই শতাব্দীর চতুর্থ দশকে আমরা যে সাত আটজন অখ্যাত তরুণ মুসলিম বাংলা সাহিত্যের মাঠে বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে আধুনিকতার ঘোড়া ছুটিয়েছিলাম এলোমেলোভাবে, ওয়ালীউল্লাহ সেই দলে ভিড়েছিলেন সবশেষে ’ ( কিছুস্মৃতিঃ ওয়ালীউল্লাহ- আবুল হোসেন, ১৯৮০ ইংরেজি) । তথাপি আজ বলতে হয়, কালান্তরে সবশেষের এই মানুষটি অর্থাৎ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অধিষ্ঠান হয়েছে বাংলাদেশের ‘কথা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক শিল্পী’ হিসেবে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গল্পকে তার আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থও গল্প। ১৯৪৪ সালে (চৈত্র ১৩৫১) কলকাতার প্রখ্যাত ‘পূর্বাশা প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত তার এ গল্পগ্রন্থের নাম ‘নয়নচারা’। এতে ৮টি গল্প সন্নিবেশিত করা হয়। গল্পগুলো নয়নচারা, জাহাজী, পরাজয়, মৃত্যুযাত্রা, খুনী, রক্ত, খণ্ড চাঁদের বক্রতায় এবং সেই পৃথিবী। লক্ষ করলে দেখা যায়, এসব গল্পের নায়কেরা উঠে এসেছেন একেবারে নিম্নশ্রেণির সাধারণ মানুষের কাতার থেকে, যাদের মধ্যে রয়েছে ভিখারি (আমু), সারেং (করিম), খালাসি (আবদুল), চোর (সাদেক) ইত্যাদি পেশা ও নেশার মানুষ। তার নয়নচারা, মৃত্যুযাত্রা, রক্ত এবং সেই পৃথিবী’’গল্পে পূর্ব বাংলার নিম্নবিত্তের মানুষের দুঃখ-বেদনা, বিষণ্নতা, অন্তর্জ্বালা যেমন বাঙময় হয়ে উঠেছে ; তেমনি জাহাজী, পরাজয়, খুনী ইত্যাদি গল্পে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের বাস্তব জীবনের আলো-আঁধারী, রৌদ্র-মেঘ প্রতিফলিত হয়েছে।
‘নয়নচারা’ প্রকাশিত হবার দুই দশক পরে আগস্ট ১৯৬৫ সালে ঢাকার নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় ও শেষ গল্পগ্রন্থ ‘দুইতীর ও অন্যান্য গল্প’। এতে সংকলিত গল্পগুলো হলো- দুইতীর, একটি তুলসী গাছের কাহিনি, পাগড়ি, কেয়ারা, নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা, গ্রীষ্মের ছুটি, মালেকা, স্তন, মতীনউদ্দীনের প্রেম। এ গ্রন্থে তিনি শুধু নিম্নবিত্তে থেমে থাকেননি ; মধ্যবিত্ত ও উচ্চশ্রেণিকেও স্পর্শ করেছেন।
জীবদ্দশায় প্রকাশিত নয়নচারা(১৯৪৪) ও দুইতীর(১৯৬৫) গ্রন্থ দুটির ১৭টি গল্পের বাইরে তার আরও অগ্রন্থিত গল্প রয়েছে, তার সংখ্যা ৩৩টি। (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ- আবদুল মান্নান সৈয়দ, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা- ৪৩)। গল্প লেখার ক্ষেত্রে তিনি ইতোপূর্বকার রাজরাজড়ার ইতিহাস নির্ভর কাহিনির গড্ডালিকা থেকে সরে এসে জীবননির্ভর বিষয়ের দিকে অগ্রসর হয়ে গল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেন। এক্ষেত্রে কল্লোল যুগীয় লেখকদের অবদানও কম নয়। তবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানুষের জীবন চিত্রণে মনোবাস্তবতার সাথে বহির্বাস্তবতার সমন্বয়ে যে পারঙ্গমতা দেখান তা অনন্য।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মাত্র ৪টি উপন্যাস লিখেছেন- লালসালু (১৯৪৮), চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪), কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮) ও কদর্য এশীয় (২০০৬)। এর মধ্যে ‘কদর্য এশীয়’ তার জীবদ্দশায় অগ্রন্থিত ছিল। কিন্তু এগুলোর মাধ্যমেই তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে নিজের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন, যা শুধু শক্তিমান ঔপন্যাসিকের বেলায় খাটে। গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের মতে, ‘রাশি রাশি উপন্যাস না লিখেও ৩টি মাত্র উপন্যাস লিখেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রমাণ করেছেন, তিনি প্রকৃত ঔপন্যাসিক, জীবনের সমগ্রতা সন্ধানী-রূপকার।’ (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ – আবদুল মান্নান সৈয়দ, অবসর, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা- ১২)। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘কদর্য এশীয়’ উপন্যাস বিষয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের গ্রন্থে উল্লেখিত হয়নি, যেহেতু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবদ্দশায় অগ্রন্থিত এ- উপন্যাসটি এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ (কমরেড পাবলিশার্স, কলকাতা, জুলাই ১৯৪৮) বিখ্যাত উপন্যাস হিসেবে তার খ্যাতি এনে দিলেও প্রথমদিকে এটা তেমন পাঠকনন্দিত ও পরিচিত ছিল না। দীর্ঘ ১২ বছর পর ১৯৬০ সালের এপ্রিলে ঢাকা ‘কথাবিতান’ থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হওয়ার পর উপন্যাসটি আলোর পাদপ্রদীপে চলে আসে। পরবর্তীতে উপন্যাসটি ফরাসি (১৯৬১) ও ইংরেজি (১৯৬৭)ভাষায় অনূদিত হয়, অর্জন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ক্লাসিক হয়ে ওঠা ‘লালসালুকে কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দিন আবুল কালাম পূর্ববাংলার ‘সাহিত্যের প্রথম সত্যিকারের উপন্যাস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। (আমাদের সাহিত্য- সরদার ফজলুল করিম সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। পৃষ্ঠা- ১৯৭ । উদ্ধৃত- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জীবন ও সাহিত্যকর্ম- জীনাত ইমতিয়াজ আলী, নবযুগ সংস্করণ ২০০১)।
‘লালসালু’ উপন্যাসের মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে মহব্বতনগর গ্রামের অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মমনস্ক মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে মজিদ নামের এক ধূর্ত-প্রতারক ধর্ম ব্যবসায়ী চরিত্রের মানুষের বানানো এক তথাকথিত ‘মাজার’কে নিয়ে, যা লালসালু কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। উপন্যাসটিতে তিনি গ্রামীণ জীবনের সাধারণ বাস্তবতাকে অসাধারণ নিপুণতায় উপস্থাপন করেন, যা অনবদ্য।
‘চাঁদের অমাবস্যা’ অস্তিত্ববাদী উপন্যাসটি রচিত হয় ১৯৬৩ সালে, যদিও ঢাকার ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ থেকে তা প্রকাশ করা হয় ১৯৬৪ সালে। এই উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জ্যোৎস্না রাতে বাঁশঝাড়ের আবছা আলো-আন্ধারে অর্ধনগ্ন যুবতীর মৃতদেহ দেখা যুবক স্কুলশিক্ষক আরেফ আলীর মনোজগতের রক্ত ক্ষরণের অনুপুঙ্খ বিবরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে অবশেষে তার (আরেফ আলীর) মুখ দিয়েই সত্যি উচ্চারণ করিয়েছেন, ‘কাদের মিঞা একটি মেয়েলোককে (মাঝির বউকে) খুন করেছে।’ আরেফ আলী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন নিরীহ শিক্ষক হলেও বিবেকের দংশন ও প্রচুর দায়িত্ববোধ তাকে অমাবস্যাসম প্রান্তিক পরিস্থিতি অতিক্রমে সাহস যোগায়। জীবনের সব নির্ভরতা হারাবে জেনেও সে প্রকৃত হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে, যদিও অবস্থা বৈগুণ্যে অপরাধে সহায়তায় দায় কাঁধে নিয়ে কাদেরের বদলে স্বেচ্ছা কারাবরণ করতে হয় তাকে। এটা আরেফ আলীর আত্মসমর্পণ নয়, বরং ভোগবাদী মুখোশধারী ‘অপরাধী সমাজ মানুষের’ বিরুদ্ধে সত্যনিষ্ঠ বিবেকী এক মানুষের নিঃশব্দ প্রতিবাদ।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র এক নিরীক্ষাধর্মী চেতনা প্রবাহী উপন্যাস, যা স্মৃতি ও ভাবানুষঙ্গের মধ্য দিয়ে নদীর স্রোতধারার মতো বহমান। এতে ছোট হাকিম মুহাম্মদ মুস্তাফার অন্তর্মুখী চেতনা ও কুমুরডাঙ্গার জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহ বঙময় হয়ে উঠেছে অনন্য দ্যোতনায়। এ উপন্যাসেও খোদেজার মৃত্যু বা আত্মহত্যা মুহাম্মদ মুস্তাফার জীবনে নিয়ে আসে স্বেচ্ছামৃত্যু।
‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’- এ তিনটি প্রধান উপন্যাসের বাইরে তিনি জীবদ্দশায় ‘আগলি এশিয়ান’ নামে ইংরেজিতে আর একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, যার পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে বাংলায় অনুবাদ করা হয় ‘কদর্য এশীয়’ নামে, যা অবসর প্রকাশনা সংস্থা ২০০৬ সালে প্রকাশ করে। ধারণা করা হয়, এটি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে রচনা করা হয়েছিল এবং সম্ভবত এটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দ্বিতীয় উপন্যাস, যা ‘চাঁদের অমাবস্যা’র পূর্বে লিখিত হয়েছিল, যদিও তার জীবদ্দশায় তা প্রকাশিত হয়নি। ‘কদর্য এশীয়’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র এক রাজনৈতিক উপন্যাস, যাতে আমরা এক ভিন্নমাত্রার জনপদ খুঁজে পাই।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গল্পকার, ঔপন্যাসিক শুধু নন, তিনি এক সফল মৌলিক নাট্যপ্রতিভাও। তার ‘বহিপীর’ (১৯৬০), ‘তরঙ্গভঙ্গ’ (১৯৬২), ‘সুরঙ্গ’(১৯৬৪) নাটকগ্রন্থ এবং প্রতীকী একাঙ্ক ‘উজানে মৃত্যু’ একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব নাটকে তার নাট্যপ্রতিভা ক্রম-অগ্রসরমান ধারায় পূর্ণতা লাভ করেছে। গবেষক জীনাত ইমতিয়াজ আলীর কথায় বলা যায়, ‘বহিপীর’ এর মাধ্যমে যে নাট্যযাত্রার সূচনা, ‘তরঙ্গভঙ্গ’, ‘সুরঙ্গ’ এর মোহনা পেরিয়ে ‘উজানে মৃত্যু’তে এসে তা হয়েছে বিশ্বপ্রসারী, সমুদ্র সমর্পিত। (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জীবন দর্শন ও সাহিত্যকর্ম- জীনাত ইমতিয়াজ আলী, নবযুগ সংস্করণ ২০০১, পৃষ্ঠা- ১৮৪)।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখনী ছিল স্বাতন্ত্রমণ্ডিত। নিরন্তর সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে তিনি তার লেখনীতে ব্যক্তি বিশিষ্টতা নির্মাণ করতেন। তার শিল্পীস্বভাবই ছিল ওরকম। তবে তিনি যা লিখতেন প্রাণের তাগিদেই লিখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বতঃস্ফূর্ততাই লেখকের মূল সম্পদ। যে-লেখায় স্বতঃস্ফুর্ততা নেই, তা লেখাই নয়। তিনি বলেন, ‘সাহিত্যিক হতে হবে বলে লেখা- সে আমি ঘৃণা করি। প্রাণের উৎস থেকে না বেরুলে সে আবার লেখা! আপনা থেকে যা বেরুবে তাই খাঁটি।’ (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, প্রথম খণ্ড- সৈয়দ আবুল মকসুদ। মিনার্ভা বুকস, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৮১, পৃষ্ঠা-৩৩৯)। অন্য অনেক লেখকের মতোই তার লেখাতেও কিছু বিষয় বারবার ঘুরে ফিরে আসতে দেখা যায়। নদী, নারী, গ্রাম যেন তার সৃষ্টির অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তার উপন্যাস, নাটক, গল্পে এসব ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। নদী বিধৌত গ্রাম-বাংলার পথে-প্রান্তরে তিনি নোঙর করেছেন তার চিন্তার তরী, যেখানে খারাপ মানুষের কাছে নারী নিগৃহিত, মৃত্যু যেখানে হানা দেয় বারবার। কিন্তু তিনি মৃত্যু চেতন হয়েও জীবনবাদী।তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি সরোবরের একেবারে গহীনে প্রবেশ করে খুঁজেছে জীবনের সমগ্রতার সন্ধান। মানুষের ব্যক্তিজীবন ও সমাজ সমস্যা তার লেখার প্রধান উপজীব্য। তার শিল্প দৃষ্টি ও কথন ভঙ্গিমায় এ-বিষয়টি উঠে এসেছে অকপটে। আর এখানেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব।