মানুষ ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল প্রকট

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন | বুধবার , ২৪ আগস্ট, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

এদেশের সাধারণ মানুষ ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিলো অকৃত্রিম। এই দেশের গরীব দুঃখী মেহনতি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজে অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, মানুষের সাথে অতি সাধারণের মত করে মিশেছেন। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান কিন্তু কর্মচারীদের সাথে মিশেছেন আপনজনের মতন। এক ছবিতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীকে অনেকটা জোর করে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। নিরাপত্তাকর্মী ভাইটি হয়ত সঙ্কোচে যেতে চাইছিলেন না। তাঁর চোখে মুখে খুশী আহ্লাদের হাসি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছেন, ‘আজকে কামালের মা মুরগির ঝোল রান্না করছে। আয় একসাথে খাব’। আহা কী ভালোবাসা!
এই জাতিকে বঙ্গবন্ধুর মত করে আর কেউ ভালোবাসতে পারেনি। বাঙালি জাতিও তাঁকে ভালোবেসেছে প্রাণ ভরে। তারাই তাঁকে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত করেছেন, জাতির পিতার আসনে বসিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতা থেকে গণমানুষের নেতা হয়ে তিনি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি অবিচল ছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি কখনোই আপস করেননি। জীবন যৌবনের মায়া ত্যাগ করেছেন, অসংখ্যবার জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন এই বাঙালি জাতির মুক্তির জন্যে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশে এসেছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট। পর যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের প্রধানের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ফ্রস্টের প্রথম প্রশ্নই ছিল, ২৫ মার্চ আপনি কেন গ্রেফতার হলেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মরি, তবু আমার দেশবাসী রক্ষা পাবে। আমি নেতা, প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব, কিন্তু পালিয়ে যাব কেন?’ ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর শক্তি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালিকে ভালোবাসি’। বড় দুর্বলতা কোনটা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালিকে বেশি ভালোবাসি। জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই’। গোটা সাক্ষাৎকারেই ফুটে উঠে বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ববোধ এর চিত্র। বঙ্গবন্ধুর জন্যেও বাঙালিদের বুকে ছিল গভীর মমতা ও ভালোবাসা। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন, তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে ধরে নিজের কুঁড়ে ঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছেন, বলেছেন, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নাও, আমার তো কিছু নেই’। এ ঘটনা তার মনে ভীষণ দাগ কাটে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে এই ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসার অসংখ্য নজির আছে। তার একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সামসুল হুদা দেখা করতে যান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এর মাত্র দু’দিন আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সামসুল হুদা। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পান সামসু। বঙ্গবন্ধু তখন দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা মুড়ি খাচ্ছেন। সামসুকে দেখে বললেন, ‘কেমন আছিস, আয়, মুড়ি নে’। মুড়ি নিতে গেলে সামসুর হাতের আংটি দেখে বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে জানতে চান, ‘তোর হাতে রিং কেন রে?’ সামসু বলেন, মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কিছুটা অনুযোগের সুরে বললেন, ‘এখনই বিয়ে করে ফেললি? এখনো কত কাজ বাকি’। দু-এক কথার পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বউমা কোথায়? বউয়ের জন্য কী কিনেছিস’? সামসু নিচু স্বরে জবাব দিলেন, ‘কিছুই কিনিনি, আমি বেকার। হঠাৎ করে বিয়ে। এর আগে আমি মেয়েকে দেখিওনি’। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কোমরে ১০ হাজার টাকা গুঁজে দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই টাকা শুধুমাত্র বউমার জন্য, এক টাকাও তুই নিবি না’। এরপর বঙ্গবন্ধু আরও দেড় হাজার টাকা দেন সামসুকে। বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমদকে ডেকে পাঠান। তোফায়েল আহমদ এলে তাঁকে বলেন, ‘খবর শুনেছিস; সামসু বিয়ে করেছে। শোন, সামসু এখন বেকার। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমাকে ১০ হাজার টাকা ধার দে।’ তোফায়েল বলেন, ‘৫ হাজারের বেশি দিতে পারব না’। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তা-ই দে’। শেষে তোফায়েলের কাছ থেকে আরও ৫ হাজার টাকা নিয়ে চলে আসেন সামসুল হুদা। কর্মীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার এমন অসংখ্য উদাহারণ জাতির পিতা আমাদের জন্যে রেখে গেছেন। প্রত্যেকের মনের খবর তিনি জানতেন। মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথা তিনি বুঝতেন। হৃদয়বান এক মহান নেতা তিনি সবাইকে আপন করে নিয়ে পারতেন নিমিষেই। বিশাল মনের অধিকারী বঙ্গবন্ধু সবসময় নেতাকর্মীদের বড় করে তুলতেন। জেলা-উপজেলায় সফরকালে সভা সেমিনারে বক্তৃতায় তিনি স্থানীয় নেতাকর্মীদের বড় করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। ইউনিয়ন, থানা ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের তিনি জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত করেছেন। এর ফলে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু দলের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতেন। দলের কর্মীদের মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন বঙ্গবন্ধু। একেবারে তৃণমূলের কর্মীদের কোনো বীরত্বগাথা কর্মকাণ্ডকে বঙ্গবন্ধু বড় করে দেখতেন। সাধারণ মানুষ আর বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তেমন কোনো দুরত্ব ছিল না। তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছিল জনগণ আর নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থল। এই বাড়িতে তাঁদের প্রবেশাধিকার ছিল অতি সহজ। দেশের যেকোনো প্রান্তের মানুষ যে কোনো সময় জাতির পিতার সাথে দেখা করতে পারতেন। মানুষের অবাধ যাতায়তের জন্যেই বঙ্গবন্ধু এই বাড়ি ছেড়ে সরকারি বাসভবনে উঠেননি। পরবর্তিতে যা বঙ্গবন্ধুর জীবননাশের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
স্কটিশ দার্শনিক টমাস কার্লাইলের ‘দ্য গ্রেট ম্যান’ তত্ত্বে বলা হয় ‘Great leaders are born, not made’ অর্থাৎ মহান নেতারা জন্মান, তৈরি হন না। প্রশিক্ষণ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে মহান নেতা হিসেবে তৈরি করা যায় না। মহান নেতারা জন্মগতভাবেই নেতৃত্বের গুণাবলি সঙ্গে করে নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতা হয়েই জন্মেছিলেন। যার ভেতরকার বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। এই স্বাতন্ত্র্য গুণাবলীর মাধ্যমে তিনি বাংলার ইতিহাসকে নতুন করে রচনা করেন। বাঙালি ও বাংলাদেশ জাতির পিতার কাছে ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এদেশের জনগণ তাঁকে নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। যার পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে কোটি কোটি বাঙালির ভালোবাসা, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের আস্থা। এই আস্থা ও ভালোবাসার প্রতিদান তিনি ও তাঁর পরিবারের জীবনের বিনিময়ে দিয়ে গেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌতুক আধুনিক সমাজ জীবনের এক মারাত্মক ব্যাধি
পরবর্তী নিবন্ধসংসদ নির্বাচনে সর্বাধিক ১৫০ আসনে ইভিএম