চুরির অভিযোগে খুঁটিতে বেঁধে দুই শিশুকে মারধর ও মাথার চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় হয়েছে নগরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় তুলেছে ঘটনাটি। আজাদীতে গত ২২ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন পুলিশ কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করে মনসুরবাদ নগর পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সিএমপির উপ-কমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ থেকে তিন শিশুকে ধাওয়া দিয়ে পুলিশ সদস্যরা জিলাপি পাহাড়ে নিয়ে যান। সেখানে লোহার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে তাদের মারধর করা হয়। একজনের মাথার চুল সামান্য কেটে দেওয়া হয়। পরে তারাই আবার শিশু দুটিকে অভিভাবকের কাছে দিয়ে দেন। পুলিশ সদস্যদের কাছে অভিযোগ ছিল যে, এই শিশুরা এলাকায় চুরির সঙ্গে জড়িত। যা-ই হোক, তারা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানা কিংবা ঊর্ধ্বতন কাউকে অবহিত করেনি। এজন্য সিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশে তাদের দায়িত্ব থেকে সাময়িক সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আসলে বড়দের নিষ্ঠুরতার কাছে শিশুরা সবচেয়ে অসহায়। সেই নিষ্ঠুরতা অনেক সময় বাবা-মার কাছ থেকেও আসে, বাইরের মানুষ থেকেও আসে। এই শিশু নির্যাতন যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়, তাহলে তা হবে দুঃখজনক। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে সুরক্ষা। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, শিশুরা কোথাও নিরাপদ নয়। অথচ শিশুর নিরাপত্তা খুব জরুরি। শান্তিপূর্ণভাবে বাস করার নিরাপত্তা। স্কুলে যাওয়া-আসার নিরাপত্তা। খেলাধুলা-বিনোদনের নিরাপত্তা। মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার নিরাপত্তা। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করার নিরাপত্তা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি। সে জন্য শিশুরা নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হলেও তার সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।
পৃথিবীর জঞ্জাল সরিয়ে শিশুকে তার বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার গ্রহণ খুবই জরুরি। কেননা, অনেকের প্রত্যয় ভরা কণ্ঠে শিশুর সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও সে এখনো নির্যাতনের শিকার। সে অবহেলিত। সুবিধা বঞ্চিত। কোথাও কোথাও সে তার স্বাভাবিক কাজে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কোথাও না কোথাও সে অপমাণিত হচ্ছে। কোথাও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রম দিতে হচ্ছে। ফলে গোটা পৃথিবী আজ তার জন্য নিবেদিত। আজকাল সব কটি দেশে শুরু হয়েছে বিশ্ব শিশু আন্দোলন। তার অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে বৃদ্ধি পাচ্ছে জন-সচেতনতা। শিশুর প্রতি নির্যাতন ও অবহেলার বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছে জনমত। নেওয়া হচ্ছে সামাজিক উদ্যোগ। বিশ্বের এক জননন্দিত মহানায়ক-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লবী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘যে জাতি শিশুদের কথা ভাবে না, সেটা কোনো জাতিই নয়।’ তাই বলা যায়, একটি জাতিকে যদি অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে প্রথমেই দরকার শিশুর পরিচর্যা। মেধায় মননে শক্তিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জাতি সমৃদ্ধ হবে। শিশুর মৌলিক অধিকার বিষয়ে সোচ্চার জাতিসংঘ। প্রণয়ন করা হয়েছে শিশু অধিকার সনদ। এটি জাতিসংঘের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বর্তমানে একের পর এক বীভৎস কায়দায় শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। আইন কানুন থাকার পরও শিশুদের প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা বাসা বাড়িতে, খেলার মাঠে সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এসব নির্মম আচরণের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে আমাদের সমাজে। ফলে শিশুদের ওপর দৈহিক নির্যাতন করলেও নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এই আচরণের পেছনে কাজ করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এ জন্য আমাদের সামাজিক ও প্রচলিত নেতিবাচক আচরণগুলোকে পাল্টাতে হবে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ব্যাক্তিগত ভাবেও পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা চাই, শিশুর সামনে কোনো বাধা না থাকুক। তার ভালোভাবে বাঁচা দরকার। খেলাধুলা করা দরকার। কিন্তু সবসময় সে হাসিখুশি থাকতে পারে না। খেলতে পারে না। তার জন্য মাঠই নেই। তার কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। কেননা, শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের ওপর নির্ভর করে গোটা জাতির কল্যাণ।