বঙ্গবন্ধু একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক। তাঁর রাজনীতির বাইরেও তিনি এক ভিন্ন ধরনের চরিত্রের মানুষ। আমাদের বাঙালির শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সংগীতকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার একজন মানুষ বঙ্গবন্ধু। একটি খঁটি দেশপ্রেমিক ও পরিপূর্ন বাঙালিত্ব হৃদয়ে ধারণ না করলে এমন ভালোবাসা হৃদয়ে জন্মায় না। বঙ্গবন্ধুর এ ভালোবাসা বহু বিশ্লেষণ ও গবেষণার দাবী রাখে। বিভিন্ন সময়ে তাঁর কথাবার্তা ও নানা বক্তব্যের মাধ্যমে সে দর্শন নানাভাবে প্রতিফলিত। বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার এ নানাদিকের মধ্যে সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোলাগা সর্বজনবিদিত। তাঁর রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী কিংবা কারাগারের রোজনামচায় সে ভালোবাসার পরিচয় মেলে। বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথকে-ভালোবাসতেন রবীন্দ্রসংগীত। নজরুলও তাঁর ভীষণ প্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি নিজের একান্ত আগ্রহেই নজরুলকে এনে জাতীয় কবির মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জেল জীবনে তিনি যেমন অবসর ক্ষণে বই পড়তেন, লেখালেখি করতেন, তেমন গুনগুন করে গান গাইতে ভালোবাসতেন। এদেশের অনেক বরেণ্য ও খ্যাতিমান শিল্পীদের সাথে সখ্যতা ছিলো চমৎকার। কোনো রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুর কথা নয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর কথা বললে অনেক কথা ইতিহাস হয়েই কথা বলে। রাজনীতির সমস্ত হিসাব নিকাশের বাইরে বঙ্গবন্ধুর একটি শিল্পানুরাগী মন সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয় সবসময়। তিনি দেশকে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি ভালোবাসতেন দেশের গান, গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষের গান। বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতি করা অনেকেই তাঁদের স্মৃতিচারণে অবলীলায় উল্লেখ করেছেন তাঁর সংগীতনুরাগের কথা। ১৯৫০ সালের কথা। এতদঞ্চলের সংগীত চর্চার অন্যতম পীঠস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বহু খ্যাতনামা সংগীত বিশারদের জন্ম এ অঞ্চলে। সে সময় ব্রাহ্মনবাড়িয়ার কৃষ্ণনগরে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে গান পরিবেশন করেছিলেন বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন, সোহরাব হোসেন, বেদারউদ্দিন আহম্মদ প্রমুখ। এই সভায় শেখ মুজিবুর রহমান আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ১১০-১১১ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত এক জায়গায় তিনি বলছেন,‘আমরা উপস্থিত হয়ে দেখলাম এন. এম. খান ও আব্বাস উদ্দিন সাহেবকে দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক সমাগম হয়েছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শোনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সঙ্গে ছিল তাঁর নাড়ির সম্বন্ধ। দুঃখের বিষয়, সরকারের প্রচার দপ্তরে তাঁর মত গুণী লোকের চাকরি করে জীবিকা অর্জন করতে হয়েছিল।’ আব্বাসউদ্দিনের গানকে বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন। তাঁর জন্য এ অনুভূতি একজন প্রকৃত সংগীতানুরাগীরই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সভা ও গানের পর রাত্রিযাপন শেষে আব্বাসউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রীরা পরের দিন নৌকায় করে আশুগঞ্জ স্টেশনের উদ্দেশে ট্রেন ধরতে যাত্রা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখনীতে বলছেন ‘পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’ গানের প্রতি অপার ভালোবাসাকে তিনি নদীর ঢেউয়ের মনোযোগের যে তুলনা টানলেন তার উপমা যেন একজন বিমুগ্ধ কবি বা সংগীতপ্রেমিরই উচ্চারণ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বঙ্গবন্ধুর প্রিয় শিল্পীদের একজন ছিলেন। তাঁর মেয়ে রানু মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একজনের কথা বলতেই হবে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। শুনেছি, জেলবন্দি অবস্থায় বাবার গান গাইতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই আমরা যখন সপরিবারে সেখানে যাই, মনে আছে বাবাকে দেখে তাঁর চোখে জল এসেছিল।’ বঙ্গবন্ধুর অত্যধিক প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি। যে গানটিকে পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেন। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সানজিদা খাতুনের ভাষ্যমতে, ১৯৫৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের যে অধিবেশন বসেছিল সে অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি তিনি গেয়েছিলেন। সানজিদা খাতুনের মতে বঙ্গবন্ধু গানটার ভেতরের যে অনুভূতি সেটা তিনি তাদের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর মনে তখনই এটাকে জাতীয় সংগীত করবার কথা মনে এসেছিল। কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটিকে বাংলাদেশের রণসংগীত করেছেন বঙ্গবন্ধু। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করে তাঁর নামানুসারে ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন শিল্পী ছিলেন আবদুল জব্বার। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো পিতাপুত্রের মত। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডাকতেন ‘পাগলা’ বলে। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের পূর্বে গান গাইতেন তিনি। বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা’, ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’ ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’, কাজী নজরুলের ‘নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম’, ডিএল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ তাঁর ভীষণ প্রিয় গানগুলোর কয়েকটি। ‘বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান’ নামে এটিএননিউজ চ্যানেলের প্রায় একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা একটি টিভি প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণে চমৎকার বর্ণনা উঠে এসেছে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত কামাল লোহানী সে অনুষ্ঠানে গানগুলো সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য নির্ভর আলোচনা করেছেন। সেখানে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের গান, আজমীর শরীফ জেয়ারতের সময়, সামপ্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত গানসহ বিভিন্ন জনসভায় গাওয়া তাঁর অনেক প্রিয় গানের কথা উঠে এসেছে। যেমন – ও মাঝি বাঁইও, বেলা গেলো সন্ধ্যে হলো, মহারাজা তোমারে সেলাম, ওরা চাইতে জানে না দয়াময়, দুনিয়া মেরে(হিন্দী), ও বিড়াল রুইমাছের খাইওনা মুড়ো, তুই হিন্দু বনেগা তুই মুসলিম বনেগা (হিন্দী), ও মোদের দেশবাসীরে, এলো এলো পাগল করিলো, আমার সাধ না মিটিলো, চাই না মাগো রাজা হতে, ইয়াইয়ার আতংক মোদের বীর মুজিবর, কী চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী পরিত্রাতা কে?, না না ইয়াইয়া তুমি হত্যা যতই করো না (মান্না দের গানের প্যারোডি),বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়, তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, আমারও বসতি ওহে ভালোবাসার দেশে ইত্যাদি গান। শেষে উল্লেখ করা ‘আমারও বসতি ওহে ভালোবাসার দেশে’ গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতার পর ঢাকা এলে বঙ্গবন্ধুসহ একসাথে বসে একান্তে গেয়েছিলেন। কারাগারের রোজনামচা বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর ২২৩ এ জেলখানায় থাকা অবস্থায়ও বাংলা নববর্ষ উদযাপনে গানকে সঙ্গী করে কিভাবে দিনযাপন হতো তার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে, ‘বিকেলে পুরানো বিশ সেলের সামনে নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেমসহ আরো কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দী জমা হয়েছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাবার হুকুম নেই, তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ভাষ্য অনুযায়ী ‘মা আমার সাধ না মিটিলো, আশা না ফুরিলো’ গানটি বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধু পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া এই শ্যামা সংগীতটি শুনতেন প্রায়ই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে নির্মিত ‘হাসিনা: এ ডটার্স টেল’ সিনেমায় এ গানটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কথায় নয় জীবনাচারে পুরো একজন খাঁটি বাঙালি ছিলেন এবং শুদ্ধ বাংলা সংগীতের একজন অনুরাগী হিসাবে আমাদের কাছে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন আছেন সবসময়।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ।