হে জাতির পিতা! আপনি মৃত্যুঞ্জয়ী

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | সোমবার , ২২ আগস্ট, ২০২২ at ৮:১০ পূর্বাহ্ণ

আগস্ট মাস বাঙালির জীবনে শোকের মাস। এ মাসের ১৫ আগস্ট ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭ তম শাহাদৎবার্ষিকী। দিবসটি ইতিহাসে সংঘটিত নৃশংস এক কলঙ্কময় দিবস এবং বাঙালির ভাগ্যাকাশে মর্মান্তিক এক শোকাবহ দিবস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ তথা বিশ্ব ইতিহাসে একটি ঘৃণ্য বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। পরাজিত পাক হায়েনার দোসররা তাঁর সাফল্য ও অগ্রযাত্রাকে মেনে নিতে পারেনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর কতিপয় পথভ্রষ্ট লোক খুনী মোশতাকদের অপচেষ্টায় রাতের অন্ধকারে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটাত্মীয় এবং সেনাবাহিনীর নিরীহ লোকদের হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতি, সমগ্র দেশ এমনকি প্রকৃতিও যেন স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ পিতা লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের ঘর আলোকিত করে খোকা নামের যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গোপালগঞ্জের মিশনারী স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সেখান থেকে যথাক্রমে আই.এ.বি.এ পাস করে তিনি আইন বিষয়ে অধ্যয়নের লক্ষ্যে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬ এর ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০এর নির্বাচন এবং ৭১ এর মুক্তি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু জাতিকে সংগ্রামী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৬৯ এর ৫ জানুয়ারি ৬ দফা ও ১১ দফার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম অভ্যুত্থানে রূপ নিলে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পৃথিবী খ্যাত সম্মোহনী সৃষ্টি কারী ব্যক্তির নামের তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব। ৭ মার্চ ১৯৭১ এ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণটি ছিল বিশ্ব নেতৃত্বের এক অত্যুজ্জ্বল ভাষণ। রেসকোর্স ময়দানে যাবার প্রাক্কালে তিনি নাকি বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ভাষণে তিনি কী বলবেন। বেগম মুজিব উত্তরে বলেছিলেন, ‘তোমার সামনে জনতা, পিছনে রাইফেল, তোমার মনে যা আসে তা বলবে’। লক্ষ জনতা উদগ্রীব, উৎকণ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু এসে কী বলবেন। অত:পর কবি আসলেন,
‘গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি
শোনালেন অমর কবিতা খানি
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণ সম্পর্কে চার খলিফা খ্যাত ছাত্র নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে বললেন ভাষণে স্বাধীনতার কথাই বলতে হবে। প্রত্যুত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন ‘শেখ মুজিব জানে কোথায় কি বলতে হবে, কখন কি বলতে হবে’।
মূলত জাতির পিতার ৭ মার্চ’র কালজয়ী ভাষণটি ছিল স্বাধীনতার পূর্ব ঘোষণা। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দুই দফা আলোচনা করেন। তিনি বললেন আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং খুব শীঘ্রই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হবে। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবার প্রাক্কালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন শেখ মুজিবুর রহমান দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে লারকানায় পিউপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাসভবনে জেনারেল দের সাথে ইয়াহিয়া গোপন বৈঠক করেন।
পাকিস্তানিরা যে নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের ষড়যন্ত্র করছিলেন সেটি বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি দিন দিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। মার্চের ১ তারিখ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা থাকলেও জেনারেল ইয়াহিয়া তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যায়িত করেন। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন।
এদিকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগের প্রতিবাদে এবং জাতির উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খানের ভাষণে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের বর্বরতার ইংগিত বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তুলে। পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের কুটচাল নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে লাগলো।
বর্বর পাক বাহিনী ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্মম গণহত্যা শুরু করে। রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালিয়ে নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের উপর পাক বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। অস্ট্রেলিয়ার এক সাংবাদিকের মতে সেই কালো রাতে ঢাকার বুকে প্রায় লক্ষাধিক নিরীহ লোককে হত্যা করা হয়। নরখাদক টিক্কা খান ঘোষণা করে, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাই না, মাটি চাই’।
২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট পৃথিবীর ইতিহাসে এক নৃশংসতম গণ হত্যার নাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মিয়ানওয়ালী কারাগারে। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করে। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। সারা দেশব্যাপী পাক বাহিনীর তাণ্ডব মানবতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মানবিক দায়িত্ব ও ভারতীয় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে প্রায় এক কোটি লোক শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নির্ঘুম সময় ও সহযোগিতা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে যে সাহস যুগিয়েছিল তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় ঘটনা।
ইন্দিরা গান্ধী ৩ ডিসেম্বর ৭১ এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলে এসেছিলেন ‘পূর্ব বাংলার মানুষ মরছে, সারা বিশ্ব ঘুমে থাকলেও আমি চুপ থাকব না ’।
পাপ কখনো চাপা থাকে না। ইয়াহিয়া, নিয়াজি, ভুট্টো, রাও ফরমান আলী ও টিক্কা খানদের পাপের নৈতিক পরাজয় ও প্রায়শ্চিত্ত বাংলাদেশের মাটিতেই হয়েছে। ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্র বাহিনীর হাতে নিয়াজির নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বর ‘৭২ ঢাকায় পৌঁছে ১২ ডিসেম্বর ‘৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সামনে জাতি গঠনের আরেক যুদ্ধ। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ বাংলাদেশে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠিত করে সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, আত্মত্যাগ ও আদর্শিক ঔদার্য তাঁকে বিশ্বে এক মহান নেতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আলজেরিয়ার জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত, একভাগ শোষকের, আর একভাগে শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে’। একই সম্মেলনে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি, ব্যক্তিত্বএবং সাহসের দিক থেকে এই ব্যক্তিটি হিমালয়ের মতো। হিমালয় দর্শনের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে’।
বঙ্গবন্ধু যে কত বড় মাপের বিশ্বনেতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বাঙালির জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম ও কলঙ্কজনক ঘটনা হলো পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কালরাত্রি যেদিন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দোসর কর্তৃক বিশ্ব নন্দিত বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে।
হে জাতির পিতা! আপনি মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যুর পরও আপনি সকল বাঙালির অন্তরে এবং বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। আপনার বাসগৃহ আজ শুধু বাঙালির নয়, বিশ্ব জনতার কাছে স্মৃতিযাদুঘরে পরিণত হয়েছে এবং আপনার কবর কোটি জনতার কাছে পুণ্যতীর্থ, আপনার স্বপ্ন চেতনা বহমান কোটি জনতার অন্তরে।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর সংগীত প্রেম
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ২৭.৬১ কোটি টাকা