ভূমি উন্নয়ন, বন্ধক, ফ্ল্যাট বা জমি কিনতে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে

জিয়া হাবীব আহ্‌সান | সোমবার , ২২ আগস্ট, ২০২২ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

ভূমি উন্নয়ন করতে বা ফ্ল্যাট বা জমি-জমা ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধক, ঋণের জামানত গ্রহণে, ডেভেলপার বা ফ্ল্যাট ক্রেতাকে নানা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ এক প্রকার সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র রিয়েল এস্টেট প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির সাথে জড়িত। তারা এতই প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কখনো কখনো তেমন কোনো ফল পাওয়া যায় না। প্রবাসী সহ বহু নাগরিক এসব চক্রের হাতে পড়ে জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে বা বসার উপক্রম হচ্ছে। আমাদের দেশের রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা এখনও সম্পূর্ণ অনলাইন ডাটাবেইজ বা ডিজিটালাইজড হয়নি। ফলে জমি-জমা, ফ্ল্যাট, দালান ইতিপূর্বে কোথাও দায়বদ্ধ আছে বা হস্তান্তর হয়েছে কিনা তা জানার সুযোগ নেই। সাব রেজিস্ট্রি অফিস এনইসি (দায়মুক্ত সনদ) নামের ১২ বছরের যে সনদপত্র ইস্যু করে তার উপর ভরসা বা নির্ভর করা যায় না। কারণ ২০১৬ সালের পর কোনো হস্তান্তর দলিল রেজিস্ট্রেশন হয়েছে কিনা তা জানার কোনো সুযোগ নেই। প্রস্তাবিত খরিদা জমি কেনার আগে বা বন্ধক গ্রহণের আগে পত্রিকায় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করলেও অনেক সময় কিছু তথ্য পাওয়া যায় (যদিও এর দ্বারা জমি নিষ্কণ্ঠক প্রমাণ করা যায় না) কিন্তু প্রতারকচক্র কথিত মানসম্মান চলে যাওয়ার অজুহাতে পত্রিকায় দিতেও আপত্তি করে। স্বত্বের মালিকানার ধারাবাহিকতা পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় দলিলপত্র, সরেজমিন সার্ভে রিপোর্ট, দাগ খতিয়ানের অবস্থান যাচাইয়ের সুযোগ দেয় না। এই মাত্র আরো দুজন কাস্টমার রেডি আছে, সময় নেই এক্ষুণি টাকার দরকার এসব নানা অজুহাতে তাড়াহুড়ো করতে থাকে। তখন সন্দেহটা আরো বেড়ে যায় কিছু ক্রেতা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইনবিদ বা এডভোকেট এর পরামর্শ না নিয়ে কতিপয় টন্নি টাউট ও দেশের সর্বশেষ সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের সংশোধন ও সার্কুলার সম্পর্কে অজ্ঞ আইন জ্ঞানহীন ব্যক্তির পরামর্শে সর্বশান্ত হচ্ছেন। আইনের ডিগ্রি বা ′ল” ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যতিত কতিপয় কোয়াক মুসাবিদাকারকদের আইন অজ্ঞতা ও ভুলের কারণে জমি-জমা সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমার যে পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে তা ৫০ বছরেও শেষ হওয়ার নয়। দলিলে চৌহদ্দি না থাকলে এবং দাগ খতিয়ান ভুল লিপি হলে ঐ দলিলের পরিণতি কী হবে, জমির অবমূল্যায়ন এর ফলাফল কী? কখন হকশূফা বা অগ্রক্রয়ের আশংকা বিদ্যমান ইত্যাদি বিষয়ে আইন জ্ঞানহীন ব্যক্তির দ্বারা দলিল লিখালে বা মতামত নিলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশংকা বেশি। এজন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর সনদপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ এডভোকেট ব্যতিরেকে আইনগত অভিমত নেয়া, দলিল ড্রাফটিং করা উচিৎ নয়। দেওয়ানী আদালতের মামলা সমূহের নথি পর্যালোচনা করলে আইনবিদবিহীন মতামত ও দলিল লিখার করুণ পরিণতির প্রমাণ পাওয়া যাবে। কারণ যিনি দলিল লিখবেন তাঁকে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, জমিদারি বিলুপ্তি ও প্রজাস্বত্ব আইন, দেওয়ানী আইন, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, পাওয়ার অব এটর্নি আইন, তামাদি আইন, অর্থ আইন, স্ট্যাম্প এ্যাক্ট, রাজস্ব ও ভ্যাট সংক্রান্ত আইন, ওয়াকফ আইন, সাকশেসান আইন, পার্টনারশীপ আইন, সোস্যাইটি এ্যাক্ট, অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, ট্রাস্ট আইন, অভিভাবকত্ব আইন, রিয়্যাল এস্টেট আইন, মুসলিম, হিন্দু ও খৃস্টান আইন, সর্বশেষ সংশোধিত গেজেট নোটিফিকেশন, সার্কুলার ইত্যাদি জানতে হয়। শুধু নিজের নামে কিংবা মা বা বাবার নামে বি.এস রেকর্ড থাকলেই হয়ে যাবে এ কথা মানা যায় না। সি.এস, আর.এস, পি.এস, বি.এস, মিউটেশন পর্যন্ত স্বত্বের মালিকানার ধারাবাহিকতা পরীক্ষা করে দাগ সিট খতিয়ান চৌহদ্দি ইত্যাদি মিলিয়ে না দেখে দলিল মুসাবিদা যেকোনো বিপদ বা মামলা মোকদ্দমার সৃষ্টি করতে পারে। তাই কোনো জমি জমা খরিদ উন্নয়ন বা ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য যেসব দলিল পরীক্ষা করতে হয় তার একটি ন্যূনতম ধারনা এখানে দেয়ার চেষ্টা করছি। জমি বন্ধক গ্রহণ ও ক্রয় বিক্রয়ের পূর্বে যে সব বিষয় যাচাই করতে হয়ঃ-
১) স্বত্বের দলিল (যে দলিল মূলে বিক্রেতা মালিকানা স্বত্ব অর্জন করেন), ২) বায়া দলিল সমূহ ও তার ধারাবাহিকতা পরীক্ষা করা, ৩) ১-২ নং ক্রমিকের দলিল সমূহ রেজিস্ট্রি অফিসে সঠিক আছে কিনা যাচাই করা, ৪) সি.এস, আর.এস, পি.এস ও বি.এস খতিয়ান সমূহের ধারাবাহিকতা যাচাই করা, ৫) বি.এস মিউটেশন বা নামজারী খতিয়ান বিক্রেতার নামে ডিসিআর সহ সঠিক আছে কিনা? তা এসি ল্যান্ড অফিসে যাচাই করা, ৬) হাল সন খাজনার দাখিলা বিক্রেতা বা দাতার নামে লিপি আছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে যাচাই করা, ৭) মৌরশী সম্পত্তির ক্ষেত্রে ওয়ারিশান সনদ, ফরায়েজ বা অংশনামা যাচাই করা, ৮) রেজিস্ট্রি দাতা সাবালক ও সুস্থ না হলে আদালত থেকে গার্ডিয়ানশীপ সনদ ও অনুমোদন নেয়া আছে কিনা তা যাচাই করা, ৯) প্রিয়েমশন বা অগ্রক্রয়ের আশংকা থাকলে অংশীদারদের নোটিশ দেয়া, ১০) সম্পত্তিটি সরকারের খাস খতিয়ানভূক্ত, অর্পিত সম্পত্তি আইন, পরিত্যক্ত বা অধিগ্রহণভূক্ত কিনা সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে নিশ্চিত হওয়া, ১১) সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে এনইসি বা নন এমকাম্ব্রান্স সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা, ১২) পাওয়ার অব এটর্নির ক্ষেত্রে সম্পত্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত ক্ষমতার পরিধি যাচাই করা ও তা বিদেশ হতে পাঠানো হলে ডিসি অফিসে এসএফডি হয়ে সাব রেজিস্ট্রার এর কাছে রেজিষ্ট্রি হয়েছে কিনা যাচাই করা, ১৩) সরেজমিনে দখল যাচাই পূর্বক দাগ খতিয়ান শীট ট্রেস ম্যাপ ইত্যাদি মিলিয়ে দেখা, ১৪) পদাধিকার বা ইজম্যান রাইটস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, ১৫) মৌজা রেইট যাচাই করা, ১৬) সিটি কর্পোরেশন এলাকায় হলে হোল্ডিং নাম্বার, হালসন ট্যাক্স দাখিলা ইত্যাদি যাচাই করা, ১৭) বিদ্যুৎ, গ্যাস, বিটিসিএল, ওয়াসা ইত্যাদি সরকারি পাওনার দাবীতে কোনো সার্টিফিকেট মামলা আছে কিনা, ১৮) সিডিএ বা কোনো সরকারি লীজের জমি বা প্লট হলে কর্তৃপক্ষের হস্তান্তর অনুমোদন পত্র, ১৯) ওয়াকফ্‌, দেবোত্তর, লীজ বা হাউজিং এর জমি হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি, ২০) মামলার রায় ডিক্রি বা নিলামকৃত সম্পত্তির ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি, বায়নামা, দখল দেওয়ানী সার্টিফিকেট ইত্যাদি, ২১) বন্ধক ও পাওয়ার, রিডেমশান, রিভোকেশনের ক্ষেত্রে ব্যাংকের অনুমোদন পত্র, ক্ষমতাপত্র ইত্যাদি যাচাই করা, ২২) ফ্ল্যাট এর ক্ষেত্রে ভূমি মালিক ও ডেভেলপার এর চুক্তি, ফ্ল্যাট বণ্টননামা, বন্ধক থাকলে তা বন্ধক মুক্ত করা হয়েছে কিনা, ২৩) দালান হলে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্ল্যান ও অনুমোদন পত্র যাচাই করা, ২৪) দক্ষ অভিজ্ঞ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর সনদপ্রাপ্ত এডভোকেট বা আইন উপদেষ্টা দ্বারা অভিমত গ্রহণ ও দলিল মুসাবিদা করানো ২৫) দাতা গ্রহীতার ছবি, এনআইডি টিআইএন প্রবাসীর ক্ষেত্রে পাসপোর্ট কপি এবং সর্বোপরি ২৬) জাতীয় এবং স্থানীয় দৈনিকে আইনগত সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা। (হেবার ক্ষেত্রে টিআইএন প্রযোজ্য নয়)। উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে জমি জমা উন্নয়ন, ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধক, হস্তান্তর, ওয়াকফ, হেবা, দান, অছিয়ত, উইল সহ যাবতীয় হস্তান্তর দলিল সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সতর্কতা সম্পর্কে আলোচনা করা গেলো। আশাবাদী এসব বিষয়ের দিকে নজর দিলে রিয়েল এস্টেট প্রতারণা ও ভূমি জালিয়াত চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এবং মামলা মোকদ্দমার জটিলতা হতে রক্ষা পাবে। ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় আইনের সঠিক প্রয়োগে প্রশাসনকে আরো এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : আইনজীবী, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজয়তু আজাদী। জয়তু কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর সংগীত প্রেম