এবার অচল সাড়ে ১০ কোটি টাকার রেডিওথেরাপি মেশিন

চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ড অসহায় রোগীরা

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২২ আগস্ট, ২০২২ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

গত ৬ জুন থেকেই অচল হয়ে আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি (ক্যান্সার) ওয়ার্ডে থাকা একমাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন।
চিকিৎসকরা বলছেন, জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ৯০ শতাংশেরই একটা সময়ে ব্র্যাকিথেরাপি নিতে হয়। অর্থাৎ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তদের জন্য এই থেরাপি অনেকটা অপরিহার্য। কিন্তু কয়েকটি পার্টস নষ্ট হওয়ায় গত আড়াই মাস ধরে ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটির সেবা বন্ধ রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে খবর দেয়া হয়েছে। তারা (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) জানিয়েছে ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটির পার্টস (যন্ত্রাংশ) আনাতে হচ্ছে জার্মান থেকে। পার্টস এখনো না পৌঁছায় মেশিনটি সচল করা যায়নি। এদিকে, ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনের পর যান্ত্রিক ত্রুটিতে এবার অচল হয়ে পড়েছে সাড়ে দশ কোটি টাকার রেডিওথেরাপি মেশিনও। মেশিনের সাথে সংযুক্ত টেবিলের একটি পার্টস নষ্ট হওয়ায় টেবিলটি কাজ করছে না। মেশিন অচল হয়ে পড়ায় গত ১৭ আগস্ট (বুধবার) থেকে বন্ধ রয়েছে রেডিওথেরাপি সেবাও। এতে করে অসহায় হয়ে পড়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিশাল সংখ্যক ক্যান্সার রোগী।
চিকিৎসকরা বলছেন, একমাত্র চমেক হাসপাতাল ছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামের আর কোনো প্রতিষ্ঠানে এই (রেডিওথেরাপি ও ব্র্যাকিথেরাপি) সেবা চালু নেই। এতে জরুরি ভিত্তিতে রেডিওথেরাপি ও ব্র্যাকিথেরাপি সেবা দরকার, এমন রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন বেশি। এই সেবা নিতে হলে তাদের ঢাকা যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ফলে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীরা।
বাঁশখালীর কালীপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান। পেশায় একজন কৃষক। ৬ মাস আগে ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে তার। চার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে টানাটানির সংসার। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেই হিমশিম অবস্থা। এর মাঝে নিজের এই অসুখ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েই দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে গত দেড় মাস ধরে চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে রেডিওথেরাপি সেবা নিচ্ছেন আব্দুর রহমান। গত শনিবারও তার রেডিওথেরাপি গ্রহণের সিরিয়াল ছিল। অনেক চেষ্টার পর ২০ দিন আগে এই সিরিয়াল জুটেছিল আব্দুর রহমানের। কিন্তু নির্ধারিত দিনে (শনিবার) এসে রেডিওথেরাপি নিতে পারেননি তিনি। ওয়ার্ডে এসে জানতে পারেন, মেশিন নষ্ট। থেরাপি বন্ধ। অগত্যা থেরাপি ছাড়াই ফিরে যেতে হয় তাকে। আক্ষেপের সুরে আব্দুর রহমান বলেন, আমরা গরীব মানুষ। এখানে (শহরে) একবার আসতেও অনেক টাকা খরচ হয়। কিন্তু এবার এসেও থেরাপি নিতে পারিনি। বলেছে, মেশিন নষ্ট। আমার পক্ষে তো ঢাকা গিয়ে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। মেশিন চালু হলে আবার আসতে হবে। কি আর করা!
কেবল আব্দুর রহমান নয়, এই রোগীর মতো দিনে অন্তত শতাধিক রোগীকে থেরাপি নিতে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে। দূর-দুরান্ত থেকে আসা এসব রোগীর বেশির ভাগই দরিদ্র-অসহায় পরিবারের।
ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে দৈনিক কম হলেও শতাধিক রোগী রেডিওথেরাপি সেবা পান। তবে মেশিন অচল হয়ে পড়ায় ৪ দিন ধরে রোগীরা এ সেবা পাচ্ছেন না। আর ব্র্যাকিথেরাপি সেবা মিলছে না গত আড়াই মাস ধরে।
মেশিনের সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রেডিওথেরাপি সেবা বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করেছেন ক্যান্সার (রেডিওথেরাপি) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ। আর বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলছেন, মেশিনের সাথে সংযুক্ত টেবিলের একটি পার্টস নষ্ট হওয়ায় টেবিলটি কাজ করছে না। অবশ্য, যান্ত্রিক ত্রুটি সারাতে মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে খবর দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগের এই দুই চিকিৎসক। জানতে চাইলে দ্রুততর সময়ে মেশিনটি সচলকরণে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।
ক্যান্সার ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি হয়তো খুব সামান্য একটি যান্ত্রিক ত্রুটি। এ ত্রুটি সারাতে সংশ্লিষ্ট বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারের বড় জোর হয়তো দশ মিনিট লাগতে পারে। কিন্তু চিকিৎসকরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। যার কারণে সামান্য ত্রুটির কারণে মেশিনটি অচল হয়ে আছে। হাসপাতালের নিজস্ব বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার থাকলে এ ধরণের টুকটাক সমস্যা নিমিষেই নিরসন করা সম্ভবপর হতো। মানুষের ভোগান্তিও কমতো।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে সিএমএসডি বা নিমিইউ থেকে সংশ্লিষ্ট কোনো ইঞ্জিনিয়ার পাঠানো হলেও মেশিনটির ত্রুটি সারানো যেত বলে মনে করেন হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে ক্যান্সার ওয়ার্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, চিকিৎসকরা মেশিনের যান্ত্রিক খুঁটিনাটি বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। সংশ্লিষ্ট কোনো ইঞ্জিনিয়ার বিষয়টি সহজে ধরতে পারবেন। তাই সিএমএসডি বা নিমিইউ থেকে একজন ইঞ্জিনিয়ার পাঠানো হলে মেশিনটির ত্রুটি শনাক্ত করে তা সারানো যেত।
এর আগে একই জটিলতায় গত বছরের (২০২১ সালের) ২৬ জুলাই থেকে রেডিওথেরাপি সেবা বন্ধ থাকে ওয়ার্ডে। পরে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে যান্ত্রিক ত্রুটি সারালে এক মাস দশদিন পর (৬ সেপ্টেম্বর) মেশিনটি সচল হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসকরা বলছেন, বিশেষ করে জরায়ু, স্তন, মুখ গহ্বর, গলা-শ্বাসনালী, ফুসফুস, ব্রেইন টিউমার ও মলদ্বারের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি অপরিহার্য। তাছাড়া শরীরের নির্দিষ্ট কয়েকটি অংশে ব্যথা নিরাময়েও রেডিওথেরাপি দেয়া হয়ে থাকে। বলতে গেলে অধিকাংশ ক্যান্সার রোগীকেই একটি সময়ে রেডিওথেরাপি নিতে হয়। যার ফলে ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই রেডিওথেরাপি সেবা অপরিহার্য বলছেন চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী।
গোটা দক্ষিণাঞ্চলে (নোয়াখালী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত) প্রায় ৪ কোটি মানুষের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে রেডিওথেরাপি সেবা নেই জানিয়ে ক্যান্সার ওয়ার্ডের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, এই রেডিওথেরাপি সেবা পেতে আমাদের ওয়ার্ডে রোগীদের প্রচন্ড চাপ রয়েছে। অতিরিক্ত চাপের কারণে রোগীদের রেডিওথেরাপি সিরিয়াল দিতে হচ্ছে ২০-২৫ দিন পর। তবে মেশিন সচল থাকলে দেরিতে হলেও রোগীরা এ সেবা পায়। ক্যান্সার ভেদে একজন রোগীকে ১৫ থেকে ৩৫ দিন রেডিওথেরাপি দিতে হয় জানিয়ে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, গলায় বা মুখ গহ্বরে ক্যান্সারের একজন রোগীকে প্রায় ৩৫ দিন রেডিওথেরাপি নিতে হয়। ফুসফুস ক্যান্সারের রোগীকে ২০-৩০ দিন। আর স্তন ক্যান্সারের রোগীদের ১৫-৩০ দিন করে এ রেডিওথেরাপি দিতে হয়। বলা যায়, ক্যান্সার ভেদে একজন রোগীকে ন্যূনতম ১৫ দিন থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত রেডিওথেরাপি দিতে হয়। এ জন্য ক্যান্সার রোগীদের জন্য এই রেডিওথেরাপি সেবা খুবই জরুরি ও অপরিহার্য।
সংশ্ল্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জার্মান প্রতিষ্ঠান বিআইবিআইজি’র কাছ থেকে একই সাথে চারটি রেডিওথেরাপি মেশিন ক্রয় করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিটি মেশিনের মূল্য প্রায় সাড়ে দশকোটি টাকা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রায় একই সময়ে (২০১৭ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে) চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় উন্নত প্রযুক্তির নতুন চারটি রেডিওথেরাপি মেশিন। ক্যান্সারের চিকিৎসায় অপরিহার্য এ মেশিন দেশের চারটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট) জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। চমেক হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত মেশিনটি বন্দর থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হাসপাতালে আনা হয়। ওই বছরের (২০১৮ সালের) ১৩ নভেম্বর হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ মেশিনের সেবা চালু হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভবিষ্যতেও হামলা হবে, তারা বসে থাকবে না : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধছোট হয়ে আসছে গুমাই বিল