জাতিসংঘের মতে মানব পাচার হল: ‘ভয় দেখিয়ে বা জোর করে অথবা কোনোভাবে জুলুম করে, হরণ করে, প্রতারণা করে, ছলনা করে, মিথ্যাচার করে, ভুল বুঝিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, অথবা যার উপরে কর্তৃত্ব আছে পয়সা বা সুযোগ-সুবিধার লেনদেনের মাধ্যমে তার সম্মতি আদায় করে শোষণ করার উদ্দেশ্যে কাউকে সংগ্রহ করা, স্থানান্তরিত করা, হাতবদল করা, আটকে রাখা বা নেওয়া।’ সংজ্ঞাটির ব্যাখা যা-ই হোক না কেন, এ কথা সত্যি যে নানাবিধ কারণে মানুষ নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছে। চাকরির প্রলোভন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন, নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা বা বসবাসের ভালো পরিবেশ দেওয়ার কথা বলে একশ্রেণির মানুষ এই ছলচাতুরি করে পাচারের সুযোগ নেয়।
মানব পাচার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা এবং একটি ঘৃণ্য অপরাধও বটে। পাচারের শিকার মানুষদের মানবাধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রতিবছর পাচারের শিকার হয়ে সারা বিশ্বে অনেক মানুষের জীবনে সর্বনাশ ঘটছে। জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) মানব পাচারের তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পাচারের শিকার প্রতি তিনজনের একজন শিশু। তারা অনেকেই যৌন নিপীড়ন ও জোরপূর্বক কায়িক শ্রম দিতে বাধ্য হয়। তাই এটাকে কেউ কেউ ‘আধুনিক দাসত্ব’ বলছেন। ইউএনওডিসির মতে, সারা বিশ্বের কোথাও না কোথাও মানুষ নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছে, অর্থাৎ পৃথিবীর কোনোস্থানেই মানুষ পাচারকারীর খপ্পর থেকে নিরাপদ নয়। জাতিসংঘের এই সংস্থাটির মতে, পাচারের শিকারের অধিকাংশ অর্থাৎ ৭০ ভাগ নারী ও শিশু।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবপাচারের কারণসমূহের মধ্যে অতি দ্রুত পরিবারে সচ্ছলতা নিয়ে আসার চিন্তা অন্যতম। সাধারণত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনবলের এরূপ স্বপ্ন দেখা-পাচারের ক্ষেত্রে বড়ই সহায়ক। তবে পাচারের কারণসমূহের মধ্যে বেকারত্ব সমস্যা অন্যতম। বর্তমানে সরকারি চাকরি পাওয়া যেন বিরাট ব্যাপার। দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা হতে শিক্ষা শেষে অধিকাংশ তরুণ-যুবক চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না পাওয়ায়, তাদের উন্নত দেশের প্রতি বিশেষ ঝোঁক দেখা যায়।
বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। যার মাঝে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চাকরির প্রলোভন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন, সুযোগ-সুবিধা প্রদান, ভালো পরিবেশের নিশ্চয়তা পাচারকারীদের মুখের বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ হতে সাধারণত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ সৌদি আরবে পাচারের ঘটনা দেখা যায়। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে অভিবাসীদের গণকবর ও ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশিদের সলিলসমাধি-মানবপাচার সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। পাচার শিকার কেউ হয়ত ফিরে আসে, কেউ হয়ত কখনো ফিরে আসে না। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে তাদের স্বজনরা।
মানবপাচার নির্মূল করা সম্ভব না হলেও, একে সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য আমাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। মানবপাচার রোধে সর্বপ্রথম প্রয়োজন আত্মসচেতনতা। আত্মসচেতনতায় মানবপাচারকে রুখে দিতে পারে। বিদেশে গমনেচ্ছু কর্মীদের আত্মসচেতন হতে হবে। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাপ্ত অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া আবশ্যক। অজ্ঞতাকে ছুড়ে ফেলে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর সামাজিক সচেতনতা মানবপাচার বন্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
মানবপাচার রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যম নিতে পারে বড় ধরনের ভূমিকা। ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি ও দেশের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে গণমাধ্যম নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
দেশ ও জনগণের প্রতি গণমাধ্যমের দায়িত্ব রয়েছে। গণমাধ্যম যদি দেশের অর্ধেকেরও বেশী জনগোষ্ঠী এর সুরক্ষায় দায়িত্ব পালন করে তবে সেটা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একটি মহান কাজ করা হয়েছে বলে মনে করা হবে। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এই জনগোষ্ঠী অর্থাৎ নারী ও শিশুর কল্যাণে গণমাধ্যমের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন অধিকার কর্মীরা। গণমাধ্যমগুলো জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও ফিচার নিয়মিতভাবে প্রচার করতে পারে। যদিও গণমাধ্যমে গত কয়েক বছরে এ বিষয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলো নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে নিয়মিতভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, ফিচার, অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে। আমরা মনে করি, মানবপাচারের সতর্কতা সংক্রান্ত বিষয়ে নানা সচেতনমূলক অনুষ্ঠান পরিবেশনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব। এসবের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও রয়েছে কতগুলো দায়িত্ব। সরকারি তদারকি মানবপাচার রোধে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।