আমাদের হোস্ট সুপাকরন খুব উৎসাহ নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় সব তথ্য জানাতো। আমরা ঠিক করলাম সান কাম্ফাং হট স্প্রিং– এ যাব। সেটাও সুপাকরনের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। সুপাকরন প্রস্তাব দিল, আমরা যদি সকাল–সকাল বের হতে পারি, তাহলে উনি আমাদের নামিয়ে দিয়ে আসবেন, কিন্তু ফেরার ব্যবস্থা আমাদের নিজেদের করতে হবে। নিনা, এলিনা এবং আমি ওনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। এই হট স্প্রিং মানে উষ্ণ প্রস্রবণ হলো মাটির নিচ থেকে উঠে আসা গরম জলের ধারা। যেসব দেশে হট স্প্রিং আছে, তাদের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে, এই উষ্ণ জলের ধারায় স্নান করলে বা পর্যাপ্ত সময় পা ভেজালে শরীরের ব্যথা–বেদনার সাথে সাথে আরও অনেক রোগ কমে যায়। তাই তারা সময়সুযোগ পেলেই চলে আসে। হট স্প্রিং–য়ের জল বয়ে যাওয়ার জন্য কংক্রিটের নালার মতো করে দেয়া আছে। পুরো জায়গাটিকে ঘিরে পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। অনেকেই পা ঝুলিয়ে বসে আছে নালার ধারে। বেশিরভাগই মধ্যবয়স্ক বা বয়স্ক নারী এবং প্রায় সবাই সাদা কাপড় পরে এসেছে। পরে জেনেছিলাম সাদা কাপড় যেহেতু শুদ্ধতার প্রতীক ভাবা হয়, তাই সাদা কাপড় পরে মানুষ হট স্প্রিংয়ে যায়। আমরাও পা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম। জল হালকা গরম। কিছু সময় জলে ভেজানো অংশে একটা পরিবর্তন অনুভূত হল, মনে হল যেন শরীরের বিষাক্ত সব জিনিস হাঁটুর নিচের অংশে এসে জমা হলো। আমাদের তো এমনিতেও প্রচলন আছে পায়ে ব্যাথা হলে গরম জলে ভিজিয়ে রাখার। হট স্প্রিংয়ের বিষয়টাও কাছাকাছিই মনে হল। পার্থক্য কেবল এই জল প্রাকৃতিকভাবে গরম আর এতে সত্যিকারের খনিজ উপাদান আছে, আমাদের মিনারেল পানির মতো ভেজালওয়ালা না।
হট স্প্রিংয়ে ভেতরে ছোট ছোট বাঁশের ঝুড়িতে করে ডিম বিক্রি করছে, আমরা সেখান থেকে ডিম কিনে নিলাম। যেখানে জল বেশি গরম সেখানে ডিম সিদ্ধের জন্য ব্যবস্থা কর ডুবিয়ে পা ডুবিয়ে শরীরকে বিষমুক্ত করার পর্ব শেষ করে, আমরা গেলাম ডিম সিদ্ধ করতে। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গান করছিলেন কোনও একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবার জন্য। কিছুক্ষণ ওদের সাথে সময় কাটিয়ে সেদ্ধ ডিম খেয়ে, এবার সাঁতারের সময়। কিন্তু, সাঁতারের আলাদা পোশাক সাথে ছিল না বলে, আমি আর গেলাম না। ঘুরে বেড়ালাম পার্কের ভেতরে। এখানে রিসোর্ট করা হয়েছে, কেউ চাইলে রাতেও থাকতে পারে।
সারাদিন কাটিয়ে এবার ফেরার পালা। বিদেশের মাটিতে প্রথম হিচহাইকিং করবো। এতেই খুব ভালো লাগছিল। হিচহাইকিং হল অন্যের গাড়িতে ফ্রি লিফট নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া। পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে হিচহাইকিং তাদের জীবনের অংশ। ভুটানের প্রত্যন্ত কিংবা মঙ্গোলিয়ায় এমন আরও অনেক দেশে এর প্রচলন আছে। আবার এর কারণে বিপদ হয়েছে বলে অস্ট্রেলিয়া এবং এমন আরও কিছু পশ্চিমা দেশে হিচহাইকিং এখন নিষিদ্ধ। পৃথিবীব্যাপী এখন খুব পরিচিত ‘উবার’, আমাদের দেশে উবারের পাশাপাশি আছে ‘পাঠাও’। এই গাড়ি শেয়ারের বুদ্ধি কিন্তু হিচহাইকিং থেকেই এসেছে। পার্থক্য হল, উবার বা পাঠাও ব্যবহার করলে টাকা দিতে হয়। বিদেশের মাটিতে প্রথম বললাম, তার মানে কি দেশে হিচহাইকিং করেছি? না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুড়ো আঙ্গুল উঠিয়ে গাড়ি থামিয়ে ফ্রি লিফট নিয়ে হিচহাইকিং করা হয়নি। তবে, কখনও ঝামেলায় পড়ে গেলে লিফট পেয়েছি।
আমরা তিনজন হওয়াতে কোনও গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। এই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল চ্যাংমাই শহরেও। একজন/দুইজনের জন্য গাড়িতে জায়গা হয়ে যায়, কিন্তু তিনজন হলে একটু মুশকিল। গাড়ি মানে তো কেবল সেডান গাড়ি না, যে–কোনো গাড়ি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজন পিকআপ চালক আমাদের লিফট দিতে এগিয়ে এলো। কিন্তু, আমাদের বসতে হবে পেছনের খোলা অংশে। এদিকে আকাশ মেঘলা। আর কোন উপায় নেই বলে আমরা সানন্দে গাড়ির পেছনে উঠে বসলাম। নিনা আর এলিনা কয়েকশ চালকের সাথে সেই জার্মানি থেকে হিচহাইকিং করেছে প্রায় এক/দেড় বছর ধরে ওদের ভ্রমণের পুরো সময় ধরে। আর আমার জন্য এটি ছিল প্রথম হিচহাইকিং। ওদের কাছ থেকে জানলাম কীভাবে অপরিচিত চালককে অনুরোধ করতে হয়, কীভাবে নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন হতে হয়। আকাশের কালো মেঘের সাথে সাথে প্রবল বাতাস। গাড়ির পেছনে বসে এলোমেলো বাতাসে চুল উড়িয়ে আমরা ফিরে চললাম শহরের পথে।
নোট: ২০১৭ সালের ভ্রমণ গল্প