বাংলা সংগীত জগতের স্বর্ণযুগের আরও একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান হলো নির্মলা মিশ্রের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে। বাকি রইলেন আরতি মুখোপাধ্যায়।
১৯৬০-৭০-৮০ এই তিনটি দশক যাদের কন্ঠসুধায় বাঙালি শ্রোতাকূল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বিমোহিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম নির্মলা মিশ্র। সে সময়ের প্রভাবশালী সব কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে গায়কী, সংগীত পরিবেশনের রীতি এবং ব্যক্তিত্বের গুণে নির্মলা মিশ্র ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। গান নির্বাচনে অত্যন্ত আপোষহীন ছিলেন। গানের বাণী ও সুর পছন্দ না হলে সে গান গাইতেন না। ফলে তাঁর গাওয়া গানের সংখ্যা খুব বেশি নয়। পাঁচশোরও কম। কিন্তু সবকটিই গান শ্রোতানন্দিত। ‘হিট সং পারফর্মার’ হিসেবে তাই সমাদৃত ছিলেন।
প্লে ব্যাকও করেছেন অত্যন্ত নির্বাচিতভাবে। তাঁর করা প্লেব্যাকের বিশেষত্ব ছিল বিভিন্ন বয়সের চরিত্রের জন্যে, শিশু থেকে বয়স্ক, সাবলীলভাবে তিনি কন্ঠ দিতে পারঙ্গম ছিলেন। বিশেষ করে করুণ রসের গানে।
একই চিত্র দেখা গেছে বেসিক আধুনিক গানেও। করুণ রসের গানে তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। করুণ রসের গানে কথার মোলায়েম প্রক্ষেপন এবং সুরের প্রাণস্পর্শী চলনে তিনি চূড়ান্তভাবে সফল ছিলেন। ‘ও তোতাপাখি রে’, ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, ‘আমার বেদন মাঝে সে যে অশ্রু হয়ে ঝরে,’ ‘কাগজের ফুল বলে আজো ঝরেনি,’ ‘যায় রে একী বিরহে,’ ‘সুখ যে আমার সয়না,’ ‘ভুল বুঝে ব্যথা পেয়ো না,’ নির্মলা মিশ্রের গাওয়া করুণ রসের গানের অসাধারণ কয়েকটি নিদর্শন।
ঠিক বিপরীতভাবে রোমান্টিক গানেও তাঁর কন্ঠের চলাচল ছিল অসাধারণ। তাঁর গাওয়া ‘তোমার আকাশ দুটি চোখে’, ‘ছোট্ট সে কথা ভালোবাসা’, ‘সেই একজন দিও না তারে মন,’ ‘আমি তো তোমার চিরদিনের হাসি কান্নার সাথী’, ‘দূরে আকাশ কাছে তুমি’, ‘নয়নে কাজল নেই,’ ‘যেওনা কো বধূ,’ ‘নির্মলা মিশ্রের গাওয়া প্রচুর রোমান্টিক বা প্রেমরসের গানের কয়েকটি চিরস্মরণীয় উদাহরণ। এ ধরনের গানে তাঁর সহজ-সরল প্রাণবন্ত গায়কী, যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো সহজ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল চলনের।
তেমনই রাগাশ্রয়ী গানেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। ঠাকুরদা পন্ডিত মুরারিমোহন মিশ্র এবং পিতা পন্ডিত মোহিনীমোহন মিশ্রণ ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পী। শৈশব থেকেই তাঁদের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছেন নির্মলা। যদিও পরবর্তীকালে হৃদরোগের কারণে এই ধারার সংগীতের তালিম ও চর্চা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই হৃদরোগ তাঁকে কৈশোর থেকে কষ্ট দিয়ে গেছে আমৃত্যু। উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চায় ব্যত্যয় ঘটায় নির্মলা আধুনিক গানের চর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং দুর্দান্তরূপে সফল হন। আসলে সংগীত তাঁর রক্তেই ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। সঙ্গে ছিল সহজাত প্রতিভা। তারপরও রাগাশ্রয়ী অনেক গান গেয়েছেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আমার বেদন মাঝে’, ‘আমায় বাঁশের বাঁশি দাও বাজাতে’, ‘উন্মনা মন স্বপ্ন মগন’, ‘এই মন মোর জানি না’, ‘তারাদের কানে কানে’।
আধুনিকের পাশাপাশি তিনি গেয়েছেন ‘লোকগীতি, শ্যামাসংগীত, নজরুল সংগীত, দেশাত্ববোধক এবং ভজন। তবে ভজনে ছিল তাঁর অনায়াস পারদর্শিতা। বিশেষ করে বাংলা ভজন। আমাদের শৈশবে কৈশোরে শুনতাম, আকাশবানী কলকাতার প্রভাতী অধিবেশন প্রায়ই দিন শুরু হতো নির্মলা মিশ্রের গাওয়া ভজন ‘বেদ পুরান বাইবেল কোরআন’ প্রচারের মাধ্যমে। যাঁরা এই অসামান্য ভজনটি শুনেছেন তাঁদের সুখকর এক অভিজ্ঞতা নিশ্চয় রয়েছে।
বাংলা সংগীতের পরে নির্মলা মিশ্র সমাদৃত ছিলেন ওড়িশী সংগীত জগতে। ক্যারিয়ারের প্রায় প্রথমদিকেই ওড়িশি চলচ্চিত্র ‘শ্রী লোকনাথে’ প্লে ব্যাকের সুযোগ পান ওড়িশি সংগীত জগতের কিংবদন্তী সুরকার শ্রী বালকৃষ্ণ দাসের পরিচালনায়। একই বছরে তাঁর প্রথম প্লে ব্যাকটি ছিল বাংলা চলচ্চিত্র বিশু চক্রবর্তী পরিচালিত ‘ক্ষুধায়’। নির্মলা মিশ্রের গাওয়া ওড়িশি গান ‘নিদো ভরা রাতি’ কে সর্বকালের সেরা ওড়িশি গানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ওড়িশি সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্যে তাঁকে ‘সংগীত সুধাকর বালকৃষ্ণ দাশ’ সম্মানে সম্মানিত করা হয়।
নির্মলা মিশ্রের গায়কীর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শুদ্ধ স্বর, সুস্পষ্ট উচ্চারণ এবং স্বরমাধুর্য। এই গায়নশৈলীর গুণে তিনি স্বতন্ত্র মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর এই অনন্য কন্ঠসুধা বিমোহিত করে রাখতো সকল প্রজন্মের শ্রোতাদের। তিনি বর্তমান প্রজন্মের (উভয় বঙ্গের) কাছেও কতটা সমাদৃত ছিলেন তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন দেখা যায় এই প্রজন্মের শিল্পীরা তাঁর গানগুলো পরম যত্নে ইন্টাবলিউড প্রিলিউড অবিকল রেখে রিমেক করেন।
নির্মলা মিশ্রের স্বামী প্রবীর দাশগুপ্ত একজন প্রতিথযশা গীতিকার সুরকার। নির্মলার অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টা প্রবীর দাশগুপ্ত। নির্মলার জন্ম ১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। মধুকন্ঠী শিল্পী তাঁর আকৈশোরের হৃদরোগে প্রয়াত হলেন ৩০ জুলাই রাত ১২ টা ৫ মিনিটে কলকাতায়। রেখে গেলেন কালজয়ী বাংলা গানের এক বড় সম্ভার।