আপনার সঙ্গে বাজি ধরতে রাজি আছি- অ্যামেরিকাতে নিজের বাগানে যেই শাকসব্জি ফলাই, টাকা-পয়সার খরচ অনুপাতে দোকানের একই শাকসব্জি অনেক সস্তা। বিশ্বাস করুন, যেই শ্রম-সময় ব্যয় করি, সেইসঙ্গে বাগানের উপকরণ ও আনুষাঙ্গিক সব যোগ হয়, তাহলে প্রতিটা টমেটো-বেগুনের দাম, দোকানের দামের তিন-চারগুণ বেশী হলেও আশ্চর্য হবো না। কিন্তু! সবকিছুর শেষেই একটা ‘কিন্তু’ রয়ে যায়। খরচ-কষ্ট যতই বেশী হোক না কেন, দিনশেষে যেই পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তিটা পাই, সেটা কি দোকানেরগুলোতে পাবো?
সকলেই না হলেও, আমরা অধিকাংশই বাগানপ্রেমী। এক চিলতে জায়গা পেলেই একটা টবে বা মাটিতে গাছ লাগিয়ে দেই- ফুলফল-শাকসব্জি। দেশে আজকাল কি সুন্দর ছাদবাগানের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ফলফুল শাকসব্জিভরা ছাদের ছবি দেখে মনটা ভরে ওঠে। আর আমাদের প্রবাসী মন তো দেশী যেকোন কিছুর জন্যই আঁকুপাঁকু করে। এককালে এখানে বড়বড় শহরগুলো ছাড়া দেশীয় জিনিস পাওয়াই যেতো না। এখন অনেককিছুই সহজলভ্য হলেও তাজা শাকসব্জি তো পাওয়া কষ্টের; পেলেও ফ্রোজেন-বাসী। বেলাবিস্কুট চানাচুর চলে; কিন্তু পুঁইশাক লালশাক? তাইতো আমরা সুযোগ পেলেই বাগান করি, বেশী চেষ্টা থাকে অ্যামেরিকার মাটিতে দেশী জিনিস ফলাতে।
অ্যামেরিকা-কানাডা এত্তবড়ো দুইটা দেশ, এবং একেক অঞ্চলের আবহাওয়া একেক রকম। আমরা যারা শীতপ্রধান অঞ্চলে থাকি, আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। ফ্লোরিডা-ক্যালিফোর্নিয়া-অ্যারিজোনা-টেক্সাসে গরম। ফ্লোরিডার আবহাওয়ায় তো দেশী আম-জাম-কাঁঠাল পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে, ওহাইহোতে বছরে সময়ই পাই মাত্র কয়েকমাসের জন্যে। কৃষিকাজের সুবিধার জন্যে অ্যামেরিকার কৃষি মন্ত্রণালয় (USDAN US Dept. of Agriculture ) দেশটাকে অনেকগুলো জোনে ভাগ করেছে। সেটা দেখে বুঝবেন আপনার অঞ্চলে কোন গাছপালা, ফলমূল ভালো হবে। অ্যামেরিকানদের তৈরি সেই জোনে, আপনি নিশ্চয়ই দেশী পটল-করলা-কাঁকরোল, লালশাক-হেলেঞ্চাশাক, পটল-কচুরলতি-ঝিঙা দেখবার আশা করছেন না। তারা আলু-টমেটো-গাজর-লেটুস-ব্রোকোলি-আপেল-কমলা ইত্যাদির উল্লেখ করেছে। আমরা কী তাতেও দমে যাবো? অবশ্যই না।
এদেশের ফার্মার্স এলমানাকে দুইটা উল্লেখযোগ্য টাইমলাইন দেওয়া থাকে- ফার্স্টডে এবং লাস্টডে অফ ফ্রস্ট। ফ্রস্ট ঠিক বরফ নয়। তাপমাত্রা যখন শূন্যের কাছাকাছি উঠানামা করে এবং বাতাসও থাকে আর্দ্র, তখন বাতাসের পানি জমে হাল্কা স্বচ্ছ-বরফের লেয়ার হয়ে গাছের পাতায় লেগে থাকে। সেটা গাছের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। অঞ্চলভেদে এই ফ্রস্টের শুরু ও শেষ হওয়ার দিন ভিন্ন হয়। অ্যারিজোনার একজন বলছিলো, তাদের তো বরফ হয়ই না, আর বছরে মাত্র দুই-তিনদিন ফ্রস্ট হয়। অথচ ওহাইহোতে তিন-চার মাস বরফের তলায়ই থাকি। শীতকাল শুরুর আগে ফল-সিজনে বেশ অনেকদিন ফ্রস্ট হয়- অক্টোবরে বা নভেম্বরে। সারা গ্রীষ্মকালের বাগান দু-তিনবার ফ্রস্ট পড়ার পরেই মারা যায়; আর আমাদের বাৎসরিক বাগানের কার্যক্রমের সেখানেই ইতি। আবার পরের বছর মে মাসের শেষদিকে আসে ফ্রস্টের লাস্টডে। এপ্রিলে হয়তোবা একটু গরম পড়েছে, তাই আপনি চারাগাছ বাইরে লাগালেন। আর হুট করে হঠাৎ একদিন ফ্রস্ট পড়ে সেই নাজুক চারাগাছের অকালমৃত্যু। তাই আমরা বাইরের বাগান করার জন্য মে মাসের শেষসপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তার আগে বাসার ভিতরেই অনেক কষ্ট করে করে গাছের ছানাপোনাকে নিজেদের ছানাপোনার মত বড় করে তুলি।
এদেশে তো আর মালী নাই, বিশেষ করে বাংলাদেশী গাছের মালী নাই। লনকেয়ার-ল্যান্ডস্কেইপের জন্যে আপনি পয়সা দিয়ে মানুষ পাবেন। কিন্তু, ঐযে লালশাক-কলমীশাক, লাউ-চিচিংগার জন্যে মালী কই পাবেন? সবই আমরা নিজেরাই করি। দোকান থেকে সার-মাটি কিনে এনে নিজেরাই মাটিতে বসে পড়ে কাজ করে যাই। অনেক কষ্টের কাজ, অনেক কঠিন; কিন্তু মনে একটা আশা থাকে- এবারে লাউটা-সীমটা-শশাটা হলে কী যে খুশী হবো। রোদে পুড়ে, ভাঙ্গাপা-কোমরের ব্যথা নিয়ে বাগান করতে করতে মনে কত রঙিন স্বপ্ন দেখি।
আগের বছরের সব মরাগাছ তুলে ফেলে নতুন করে বাগান তৈরি করতে হয়, আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। আগাছা যে কত প্যারা দিতে পারে বিশ্বাস করবেন না। লকলক করে বেড়ে উঠে; আর অন্যদিকে আমার লাগানো সীম-লাউগাছগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত, ক্ষরায় আক্রান্ত দেশের বুভুক্ষু হাড্ডিসার শিশুর মত। অথচ কত আদরযত্ন করি তাদের। আগাছাগুলিও বদমাস- কোনোটায় কাঁটা থাকে, কোনোটা আসল গাছের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, টান দিলে আমার দেশি মরিচের গাছসহ উপড়ে আসে। কোনোটার শিকড় এতই শক্ত যে, হাত দিয়ে উপড়ানোই যায় না, আবার কোনোটা আছে টুস্ করে ভেঙ্গে যায়, কিন্তু শিকড়টা মাটিতেই রয়ে যায়, কয়েকদিন পরে নতুন করে ওঠে। একবন্ধু একবার ক্ষেপে গিয়ে বললো- ‘পরের বছর থেকে আগাছার চাষই করবো। কোনো যত্ন লাগে না, সার-রোদ-পানি, কিছুই না’। এটা অনেকটা আমরা কষ্ট করে উপার্জন করে নিজের ছেলেমেয়েদের জন্যে অন্ন যোগাই; কিন্তু তারা খায় না (বা খেতে পারে না); অন্যের ছেলেপিলেরা এসে খেয়েদেয়ে মোটাতাজা হয়ে ফূর্তি করে। কেমন লাগে বলুন দেখি?
গত তিরিশ বছর ধরে এদেশে বাংলাদেশী গাছের বাগানের চেষ্টা চালিয়েই গেছি। ছিলাম বোকা-অনভিজ্ঞ। না জেনেই করতাম- ফলাফল হতো শূন্যের কোঠায়। অন্যদের বাগান দেখে হতাশ হতাম। করোনাকালে North American Bangladeshi Gardeners Club ফেইসবুক-গ্রুপ খুঁজে পেলাম। এখানের সব অভিজ্ঞ মেম্বারদের থেকে কতকিছু শিখলাম। কখন কোন গাছ, কীভাবে লাগাবো, কী যত্ন নিতে হবে, কী সার দিবো; পোকামাকড়ের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করতে হবে- কতকিছু। সেখানের সকলের কাছে আমি ঋণী। এখন বুঝি, সস্তার টপসয়েল মাটি দিয়ে বাগান হয় না। সার ও কম্পোস্টযুক্ত বিশেষভাবে তৈরি গার্ডেনসয়েল দিয়ে মাটিতে; আর পটিং সয়েল দিয়ে টবে গাছ লাগালে, সেগুলো গাছের সঠিক পুষ্টি যোগাবে। কীভাবে কখন এবং কোথায় পানি দিতে হবে। পাতায় পানি দিলে ফাঙ্গাস হয়, গোড়ায় দিতে হয়; শেষ বিকালে বা সন্ধ্যায় দিলেও ফাঙ্গাস; সকালে দিলে সারাদিনের সূর্যের আলোর সহায়তায় গাছ সেই পানি ও পুষ্টিকে কাজে লাগাতে পারবে। সারের গায়ে লেখা ঘ-চ-ক (নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম)-এর গুরুত্ব। নাইট্রোজেনে সবুজপাতা বাড়ে, ফসফরাসে ও পটাশে ফলফলারি বাড়বে ও গাছের সর্বোপরি স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। পাতা কুঁকড়ে যায় কেনো? পাতার উল্টাদিকে কোথায় পোকামাকড় থাকে? ছাই, নিম-অয়েল, কীটনাশক সবকিছুর সুন্দর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন অনেক অভিজ্ঞ মেম্বাররা আমাদের মত গবেটদের জন্যে।
এরপরে আছে ঘটক বনে যাওয়ার কাহিনী। আগের বছরগুলোতে কোনমতে গাছ হয়তো হতো, কিন্তু সারা সিজনে কোন ফল ছাড়াই, শীতের শুরুতে মারা যেত। আমার টোটাল প্রাপ্তি দাঁড়াতো গিয়ে সেই শূন্যই। পরে শিখলাম লাউ ও আন্যান্য গাছের ১এ, ২এ, ৩এ কাটিং পদ্ধতি। যার ফলে গাছ স্ত্রী-পুরুষ দুই ধরনেরই ফুল দিবে। তা না হলে শুধু একধরনের ফুল হবে, এবং সে-গাছে ফল হবে না। আচ্ছা না হয় বাবাজী-মা’জি বলে ১এ, ২এ করলাম; কিন‘ সেখানেই কী শেষ? ঘটকালি করাতে হবে না? এজন্যে প্রকৃতি দিয়েছে প্রজাপতি, মৌমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ। তাদের পায়ে, পাখায় শরীরে লেগে পুরুষফুলের রেণু স্ত্রীফুলে লাগলে, তাহলেই পরাগায়ন হয়। তাই সব্জি বাগানের কাছেই রঙিন গন্ধযুক্ত ফুলগাছ লাগিয়ে সেগুলোকে আকর্ষণ করতে হয়। তারপরেও, ঘটক হিসাবে আমি নিজ হাতে পুরুষফুল নিয়ে ডাইরেক্ট গিয়ে মিসেস ফুলের উপরে লাগিয়ে লাগিয়ে রেণু ট্রান্সফার করার চেষ্টা করি। দিনশেষে নান্টু ঘটক হিসাবে পাই ফলটা-মূলাটা- সেটাই আমার লাভ। জীবনে কখনই ভাবিনি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কিনা অবশেষে বোটানিক্যাল-ঘটক হবো! মাঝেমাঝে অতি উৎসাহের চোটে স্ত্রীফুলকে দ্রৌপদির মত বানিয়ে দেই বেশ কয়েকটা পুরুষফুল লাগিয়ে; অথবা তাদেরকে পরকীয়ায় উদ্বুদ্ধ করি, তর সইতে না পেরে বাল্যবিবাহ দিয়ে দেই!
আমার বাগানের মাটিতে প্লাস্টিকের অনেকগুলো কাঁটাচামচ পুঁতে রেখেছি আমার বন্ধুদের জন্যে- খরগোশ, কাঠবিড়ালী, চিপ্মাঙ্ক, ব্যাজ্জার, গ্রাউন্ডহগ ইত্যাদি। কৌতুক করে বলি, ব্যাটারা অ্যামেরিকান তো, তাই কাঁটাচামচ ব্যবহারেই অভ্যস্ত। আসলে, সেগুলো দেওয়ার ফলে তাদের নরম শরীরে খোঁচা লাগে বলে উৎপাত কম। তা না হলে, আপনার সাধের কচি লাউটা, কুমড়াটা, বেগুনটা আধখাওয়া করে চলে যাবে। দুঃখে কান্নায় বুক ভেসে যায়, এত্তো এত্তো কষ্টের ফসল এইভাবে কেউ খেয়ে গেলে। শামুক বা স্লাগও কম নয়, পাতাও খায়, ফলও খায়। সেজন্য দেই ডিমের খোসা। সেগুলোর খোঁচায় শামুক-স্লাগ আসে না, আবার মাটিতে সেই খোসা মিশে ধীরে ধীরে গাছের জন্যে ক্যালশিয়াম দেয়- blossom end rot থামানোর জন্যে।
আমার জন্যে বাগান করা বেশ কষ্টের- সপ্তাহের পাঁচ দিনই বাইরে বাইরে ঘুরি; শনি-রবিবারে বাসায় এসে, অন্যান্য অনেক কাজের মধ্যেও বাগানের চেষ্টা চালিয়ে যাই। আর সেই দুইদিন যদি ঝড়বৃষ্টি বরফ হয়, তাহলে তো দিনটাই পন্ড। অবশ্য বাইরে বাগানে কাজ না করতে পারলে, আমার অন্য দুইটা হবি নিয়ে বসি- লেখালেখি আর কাঠের কাজ। তবে ঐযে বললাম, ঘন্টার পর ঘন্টা অমানুষিক কায়িক পরিশ্রম করার পরে যদি একটা বেগুন-শসা-টমেটো, লাউ, এক মুঠো তাজা শাক, একটা কুমড়া খেতে পারি। আর নিজের হাতের ফুলগুলো দেখতে পারি, তাতে যেই আনন্দ পাই, সেটা খুব কম জিনিসেই পাই। ডলার দিয়ে সেটা দোকান থেকে কিনতে পারবেন না। অন্তরের ভিতর থেকে অটোম্যাটিক্যালি চলে আসে একটাই কথা- আলহামদুলিল্লাহ্।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২