জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৫ আগস্ট, ২০২২ at ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে আহ্‌লে বায়তের মর্যাদা

পবিত্র কুরআনের আলোকে আহলে বায়তে রাসূল’র প্রতি ভালবাসা :

মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআন মাজীদে আহ্‌লে বায়তে রাসূলের সুমহান মর্যাদা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, “আপনি বলুন! আমি সেটার জন্য তোমাদের নিকট থেকে কোন প্রতিদান চাইনা কিন্তু চাই নিকটাত্মীয়তার ভালোবাসা। (সূরা: ৪২ আশ্‌-শূরা, পারা-২৫, আয়াত-২৩)
আহলে বায়তের আলোচনা ও তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান এতো অধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বয়ং আল্লাহ্‌ তা‘আলা মহাগ্রন্থ আল কুরআন আহলে বায়তের শান-মান মর্যাদা ও তাঁদের পবিত্রতার কথা উল্লেখ করেছেন, এরশাদ হয়েছে, “হে আহলে বায়ত! আল্লাহ্‌ তা‘আলা তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে সকল প্রকার কলুষতা দূর করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পূত:পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে দেবেন।” (সূরা আহযাব: আয়াত-৩৩)

হাদীস শরীফের আলোকে আহলে বায়তে রাসূল’র : হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় (হে প্রিয় রসূল! আপনি বলুন, আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাইনা কেবলমাত্র আমার নিকটাত্মীয়তার প্রতি ভালবাসা চাই) তখন সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! আপনার নিকটাত্মীয় কারা? যাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা আমাদের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আলী, ফাতেমা এবং তাদের পুত্রদ্বয় (হাসান ও হোসাইন)। (তাবরানী, আল মু’জামুল কবীর, হাদীস: ৩৪৫৬)
আহলে বায়ত দ্বারা কারা উদ্দেশ্য: পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আয়াতে আহ্‌লে বায়ত বলতে কারা উদ্দেশ্য এ প্রসঙ্গে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং তাফসীরকারকদের এক জামাতের মতানুসারে আহলে বায়ত দ্বারা হযরত মাওলা আলী, হযরত ফাতেমা, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম উদ্দেশ্য।তাফসীরকারকদের দ্বিতীয় একদলের মতানুসারে আহলে বায়ত দ্বারা নবীজির পবিত্র স্ত্রীগণ উদ্দেশ্য। (বরকাতে আহলে রসূল, পৃ. ৩২)

হযরত আল্লামা ইউসুফ বিন ইসমাঈল নিবহানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতানুসারে আহলে বায়ত দ্বারা উম্মুহাতুল মু’মিনীন ও পবিত্র আওলাদগণ উদ্দেশ্য। উভয় শ্রেণি এতে অন্তর্ভুক্ত যেন সর্বপ্রকার দলীরের উপর আমল হয়ে যায়। (বরকাতে আলে রসূল, পৃ. ৩৫, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড-১ম, পৃ. ৩১)

আহলে বায়তের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী জাহান্নামী: হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যদি কোন ব্যক্তি রুকনে ইয়ামানী ও মক্বামে ইবরাহীমির মাঝখানে অবস্থান করে, তাতে নামায আদায় করে এবং রোজা রাখে অতঃপর নবীজির পরিবার বর্গের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী অবস্থায় মারা গেল সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। (তাবরানী, আল মুজামুল কবীর, হাদীস: ১১৪১২, আশশারফুল মুত্তয়্যাদ: পৃ. ৯২)

হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার আহলে বায়তের প্রতি একদিনের ভালোবাসা, পূর্ণ বৎসর ইবাদতের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ ভালোবাসার উপর মৃত্যু বরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসনাদুল ফেরদৌস, খন্ড-২য়, খৃ.১৯২)

আহলে বায়তের প্রতি হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ভালবাসা: হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এরশাদ করেছেন, আল্লাহর শপথ যার কুদরতী হস্তে আমার প্রাণ। আমার নিকট আমার নিকটাত্মীয় থেকে রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটাত্মীয় অধিক প্রিয়। (বোখারী শরীফ)

আহলে বায়তের প্রতি হযরত ফারূকে আজম ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ভালবাসা হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণনা করেন, হযরত ফারুকে আজম ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাসনামলে মাদায়েন বিজয় হলো। মসজিদে নববী শরীফে গণীমতের মাল আনা হলো, হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাশরীফ আনলেন, বললেন, হে আমিরুল মু’মিনীন, আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত আমার হক আমাকে প্রদান করুন, ফারুকে আজম তাঁকে এক হাজার দিরহাম প্রদান করলেন, এরপর হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাশরীফ আনলেন, তাঁকেও এক হাজার দিরহাম দিলেন, অতঃপর স্বীয় পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ্‌ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাশরীফ আনলেন, তাঁকে পাঁচশত দিরহাম দিলেন এতে হযরত আবদুল্লাহ আরজ করলেন আমিরুল মু’মিনীন! আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মুবারক যুগে যুবক ছিলাম। আপনার সাথে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছি, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা তখন বয়সে ছোট ছিলেন, মদীনা মনোয়ার গলিতে খেলাধুলা করতেছিলেন, আপনি তাদেরকে এক হাজার, এক হাজার করে দিলেন, আমাকে দিলেন পাঁচশত দিরহাম। তখন হযরত ফারুকে আজম স্বীয় পুত্রকে বললেন, ওহে আমার ছেলে! প্রথমে ওই মর্যাদা অর্জন করো, যেটা ইমাম হাসান ও হোসাইনের মর্যাদা। তারপর এক হাজার দিরহাম দাবী করো।

জেনে রেখো! তাঁদের নানা হলেন রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, তাঁদের পিতা হযরত আলী শেরে খোদা, তাঁদের মাতা, ফাতেমাতুজ্‌ যাহরা, তাঁদের নানী, হযরত খাদীজাতুল ক্বোবরা, তাঁদের চাচা হযরত জাফর তায়্যার, তাঁদের ফুফী, হযরত উম্মে হানী, তাদের মামা ইব্রাহীম ইবনে রাসূলিল্লাহ্‌, তাঁদের খালা, হযরত রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আলাইহিম আজমাঈন। (আনোরুল বয়ান, খন্ড-১ম, পৃ. ৩৫)

আলে রসূলের প্রতি ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সম্মান: একদিনের ঘটনা ইমাম আজম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মজলিশে উপবিষ্ট, কারো সম্মানার্থে কয়েকবার দাঁড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বিরতির পর আবারো বসে গেলেন, মজলিসের কয়েকজন এভাবে কয়েকবার ইহতিরামের সাথে দাঁড়িয়ে যাওয়া, অতঃপর পুনরায় বসে পড়ার রহস্য জানতে চাইলে ইমাম আযম উত্তর দিলেন, দেখুন সামনে যে শিশুরা খেলাধুলা করছে সেখানে একজন শিশু সৈয়্যদজাদা আওলাদে রসূল আছেন, যখনি আমি এই সৈয়্যদযাদা শিশুকে দেখতে পাই তখনি তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাই। (তোহফায়ে ইসনা আশরিয়া, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড-১ম, পৃ. ৪৬)

আলে রসূলের প্রতি আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি’র সম্মান: আলে রসুলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ফরজ। তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসম্মান হারাম। কাদিয়ানী, ওহাবী, লা মাযহাবী বদদ্বীন গোমরাহ্‌ বদ আক্বিদা পোষণকারী সৈয়্যদ হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও তিনি সৈয়্যদ নন, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন হালাল নহে। বরং কুফরী আক্বিদার কারণে তার প্রতি অসম্মান ও কুফরী আরোপ করা ফরজ। (ফাতওয়ায়ে রজভীয়্যাহ্‌, নবম খন্ড)

সৈয়দজাদা যদি সুন্নী মাযহাব অনুসারী হয় তার আমল যা-ই হোক। তাঁর প্রতি সম্মান করা অপরিহার্য। (ফাতাওয়ায়ে রজভীয়্যাহ্‌, ৯ম খন্ড)
আহলে বায়তে রাসূলের শানে মহান ইমাম হযরত ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়াহি কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত কাব্যের দু’টি পংক্তি উল্লেখ করা হলো, ওহে রাসুলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার বংশধরগণ! আপনাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করাকে ফরজ স্বরূপ ঘোষণা করে আল্লাহ তা’আলা কোরআন করীমের আয়াত নাযিল করেছেন। আপনাদের সুমহান মর্যাদার জন্য এতটুকু যথেষ্ট, যে ব্যক্তি আপনাদের প্রতি দুরূদ শরীফ পাঠ করবে না তার নামাযই হবে না। হে আল্লাহ্‌ আমাদের আমাদেরকে তোমার প্রিয় মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূরানী বংশধরগণের প্রতি অকৃত্রিম মুহব্বত প্রদর্শন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ আজিজুর রহমান
চাগাচর, দোহাজারী, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম
প্রশ্ন: হিজরি সনের সূচনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাবে জানালে কৃতার্থ হব
উত্তর: হিজরি সন ইসলামী সন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনা হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় রাখার জন্যই হিজরি সনের সূচনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের সতের বছর পর হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাষনামলে ইসলামী তারিখ গণনার সূচনা হয়। হযরত ফারুকে আজম (রা.)’র খিলাফতকালে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হিজরি সন প্রচলনের প্রস্তাব করেন। সর্ব সম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। হযরত ওসমান জিন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রস্তাব মতে মহররম মাস কে ইসলামী বর্ষ হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারণ করার প্রস্তাব সর্বান্তকরনে গৃহীত হয়। মুসলিম উম্মাহর দৈনন্দিন জীবনে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের সাথে হিজরি সন ও তারিখ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পবিত্র হজ্বব্রত পালন, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা উদযাপন, ১২ রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন, পবিত্র শবে বরাত, শবে কদর, শবে মিরাজ, আশুরা, ইসলামের অসংখ্য ইবাদত বন্দেগী হিজরি সন ও তারিখের সাথে সম্পর্কিত। (বাবুত তারিখ, ফাতহুল বারী, ৭খ, পৃ: ২০৯, তারিখে তাবারী ২খ, পৃ: ২৫২, যুরকানী ১খ, পৃ: ৩৫২, উমদাতুলকারী, ৮খ, পৃ: ১২৮, সীরাতুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, পৃ: ৩৪০-৩৪১)

পূর্ববর্তী নিবন্ধডোপামিনের প্রভাব, সুবিন্যস্ত জীবন ও সাম্প্রতিক প্রবণতা
পরবর্তী নিবন্ধবাদশাহ মিয়া চৌধুরী : চট্টগ্রামের স্যার সৈয়দ আহমদ