ডোপামিনের প্রভাব, সুবিন্যস্ত জীবন ও সাম্প্রতিক প্রবণতা

ববি বড়ুয়া | শুক্রবার , ৫ আগস্ট, ২০২২ at ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ

ক’দিন আগে ইউটিউবে খাদিজাতুল কোবরা সোনিয়ার Thibaut Meurisse-এর লেখা Dopamine Detox বই এর ওপর একটি ভিডিও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। ভিডিওটি দেখার পর সত্যিই বেশ চমৎকার লেগেছে। কারণ বর্তমানে প্রচলিত আমাদের সমাজে তরুণ প্রজন্ম হতে শুরু করে সকল বয়সী মানুষের মধ্যে এই উড়ঢ়ধসরহব এর অতিমাত্রার একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব দেখা দিচ্ছে যা আগামী দিনের জন্য বা প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত বলা চলে। প্রথমেই এই ডোপামিন কী তা একটু আলোচনা করা যায়।
ডোপামিন হল একটি হরমোন এবং ক্যাটেকোলামাইন ও ফেনাথ্যালামিন পরিবারের একটি নিউরোট্রান্সমিটার যা মানব মস্তিষ্ক ও শরীরে বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিকভাবেই এটি মানব শরীরে উৎপন্ন হয়। এটাকে মস্তিষ্কের পুরস্কারও বলা হয়।
কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায় নিজের জন্য উপকারী কাজগুলোও যেমন প্রতিদিন পড়াশোনা, গৃহস্থালি কাজ, অফিসের কাজ কিংবা শরীরচর্চা করতে আগ্রহী মানুষ খুব কমই আছে। তবে এই কাজগুলো ভালো না লাগার পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। যে কাজ করতে আমাদের ভালো লাগে না সেই কাজগুলো আমাদের মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমান ডোপামিন ক্ষরণ করে না ফলে মস্তিষ্ক এই কাজের প্রতি সেভাবে আগ্রহ দেখায় না।
অর্থাৎ পরিমাণ মত ডোপামিনের প্রভাবে মানুষ যেমন কাজে উদ্যমী হয়, ঠিক তেমনি এই ডোপামিনের মাত্রা বেড়ে গেলে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে ওঠে। এটা হতে পারে মাদকে আসক্তি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্ষমতা-প্রভাব- প্রতিপত্তি বৃদ্ধির আসক্তি কিংবা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার আসক্তি। যার ফলে মানুষ দৈনন্দিন কাজের প্রতি দিনদিন আগ্রহ হারায়। এবং নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো যথাসময়ে সমাপ্ত করতে না পারায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়। আর এর ফলে একটি সময় সে হতাশা বা ডিপ্রেশনে ভোগে। এখানে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয়েই আলোকপাত করা যায়।
যেমন বলা যায়, বর্তমানে সমাজের মাথা ব্যথার একটি চিত্র যা আতংকের আরেক নাম ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি’। তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত উত্থান এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ছবি, শব্দ, লেখার সাহায্যে সামাজিক মাধ্যমে যে কৃত্রিম জগৎ তৈরি হচ্ছে এটি গ্রাস করে নিচ্ছে বাস্তব জগৎকে। আজকের পৃথিবীতে নেট আসক্তিকে তুলনা করা হচ্ছে জীবনগ্রাসী মাদকাসক্তির সঙ্গে। বিশ্ব জুড়ে বাঘা বাঘা প্রযুক্তি বিশ্লেষকগণ প্রযুক্তি আসক্তির অশনিসঙ্কেত দিচ্ছেন জোরালোভাবে। দারুণ সুকৌশলে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো তরুণ-তরুণীদের মগজ ধোলাই করে তাদের সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিয়ে নিবদ্ধ করছে প্রতিদিনকার পোস্ট, লাইক, শেয়ার আর কমেন্টে। যেন জীবনের গণ্ডি আঙুলের ছাপের কিছু লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট সেকশনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। বাস্তবতা হারিয়ে গিয়ে বাস করছে স্বপ্ন জগতে। ঝরে পড়ছে সুশিক্ষিত হয়ে দেশের হাল ধরার স্বপ্ন।
আবার আরেকটি বিষয়ে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আমাদের শরীরের অন্যতম দু’টি হরমোন ডোপামিন এবং ভ্যাসোপ্রেসিন মানুষকে বা প্রিয়জনকে ঠকানোর প্রবণতার অন্যতম দুই কারণ। ডোপামিন মস্তিষ্কে যৌন তৃপ্তি তৈরি করে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যাদের শরীরে ডোপামিন রিসেপটর জিনের অ্যালিলের সংখ্যা যত বেশি, তাদের মধ্যে ব্যভিচারের প্রবণতাও তত বেশি হয়। অল্প বয়সে বিয়ে, শারীরিক সমস্যা, বিয়ের ক্ষেত্রে ভুল মানুষকে নির্বাচন করা, ক্যারিয়ার আডভান্সমেন্ট, পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিতে পরকীয়া প্রভাব রাখে, বৈবাহিক জীবনে অসুখী, অবজ্ঞা মূল কারণ হলেও এখন তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা মোবাইল ফোন, ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয়, তাই আজকাল পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলা অনেক সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরকীয়া যেন সেই বহমান নদীর মতো এ কূল ভাঙে ঐ কূল গড়ে। একজনের সুখের সংসার ভেঙে তছনছ করে আরেকটি চোরাবালিতে যেন পা দেওয়ার মতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরকীয়ার সম্পর্ক সুখের হয় না। এতো কিছু জানার পরেও সংক্রামক ব্যাধির মতো এটি বেড়েই চলেছে। জানা গেছে, গত ২০২০ চেয়ে ২০২১ সালে প্রতি মাসে ৯৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে। এক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ডিভোর্স দিচ্ছেন নারীরা, ৩০ শতাংশ দিচ্ছেন পুরুষরা। ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে ৪১৪৯টি। একই সময় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন হয়েছে অনেক বেশি। ২০১৯ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন ছিল ২৯১টি। অথচ ২০২০ সালে এ আবেদনের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার। ২০২১ সালেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা শহরে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন অন্য বছরের তুলনায় বেশি জমা পড়েছে। যা সামাজিক বন্ধনের বিচ্ছিন্নতাকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। যেমন আরেকটি আসক্তির নাম মাদক। মাদকের থাবায় নাস্তানাবুদ একটি প্রজন্ম। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল-সর্বত্রই নেশা এখন হাতের নাগালে। এক যুগে এর বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন সংস্থা অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। তবে এই পরিমাণ দেশে ছড়িয়ে পড়া মোটের তুলনায় কোনো ভাবেই ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয় বলে মনে করছেন এ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো।
তারা বলছেন, বর্তমানে সারা দেশে সেবনকারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকার নেশা গ্রহণ করছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২১ সালে হেরোইন আসক্তদের সংখ্যা ৩৪.৫৪ শতাংশ। ইয়াবাসেবীর সংখ্যা ৩০.১৮, গাজায় আসক্তির সংখ্যা ২৫.০৯ শতাংশ।

যদি আমরা শুধু এই ২০২২ সালের আটককৃত মাদক দ্রব্যের পরিসংখ্যান এর মধ্যে জুলাই মাসের হিসাব দেখি তাতে দেখতে পাই ফেন্সিডিল ২৯৯২৪ বোতল, গাঁজা ২৪০০.০৪ কেজি, বিদেশি মদ ১২১২৮ বোতল , দেশি মদ ২৯.৮ বোতল, হেরোইন ৮.৯৪০কেজি, ইয়াবা ১১৮০৫১০ কেজি আটক করা হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধের পেছনে মাদক একটি বড় বিষয় হিসেবে কাজ করে। মাদকাসক্তের কারণেই অনেক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। অর্থাৎ ভয়ংকর একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। এটা শুধু এরাই নয় সর্ব পর্যায়ে এমন নানা নেশায় ডুবে কুৎসিত সমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

ড. ক্যামেরন সেপাহ Dopamine detox ধারণার প্রবর্তক। তাঁর মতে ডোপামিন ডিটক্সএর সময়, একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার গুলিকে ট্রিগার করে এমন ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে ডোপামিনের সহনীয় মাত্রাকে কমিয়ে আনে। অর্থাৎ ডোপামিন ডিটক্স বিক্ষিপ্ত মনকে প্রশিক্ষিত করে কঠিন কাজকে বশে আনার সহজ কৌশল।

লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরক্তাক্ত আগস্ট
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা