কমিটি নিয়ে কী অভিযোগ কী বলছেন নেতারা

কমিটির আকার বেড়ে হলো ৪২৫, সহসভাপতি ১১৯ জন

চবি প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ২ আগস্ট, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জেলা শাখা সমমানের। এর মেয়াদকাল ১বছর। কমিটিতে সদস্য হবে ১৫১জন। সহ-সভাপতি হবে ২১জন। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ৯জন। অভিযোগ উঠেছে, এর কোনোটাই মানা হয়নি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের ঘোষিত কমিটিতে। এছাড়া প্রায় অর্ধ শতাধিক বিতর্কিত স্থান পেয়েছে কমিটিতে ৷ রয়েছে অছাত্র, বিবাহিত, বহিষ্কৃত ও বিভিন্ন মামলার আসামি। একই নাম রয়েছে একাধিক পদে। আবার একই পদ নিয়ে রয়েছেন দুইজন দাবিদার। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। শাখা ছাত্রলীগের সাবেকদের অনেকেই এই কমিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ এটাকে ‘নজিরবিহীন’ ও ‘হাস্যকর’ বলেও মন্তব্য করেছেন। এ কমিটিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ গঠনতন্ত্রের কোনো শর্তই মানেনি বলে মন্তব্য করেছেন শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজন। তিনি আজাদীকে বলেন, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গঠনতন্ত্রের কোনো শর্তই মানা হয়নি এই কমিটিতে। কমিটির আকারসহ কোনো ক্ষেত্রেই শর্ত মানা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা ৪২৫ জনকে পদ দেওয়ার পরও ক্যাম্পাসে কোনো আনন্দ মিছিল হচ্ছে না। হচ্ছে আন্দোলন। এর মানে হলো, যারা হলে থেকে রাজনীতি করছে, নিয়মিত শিক্ষার্থী, তারা পদ পায়নি। তিনি প্রশ্ন রাখেন, তাহলে যারা পদ পেয়েছে তারা কারা?
৩ বছর পর কমিটি : দীর্ঘ ৩ বছর ১৬ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৪২৫ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সহ-সভাপতি আছে ১১৯জন। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আছেন ১১জন। এরকম প্রায় প্রতি পদেই নির্দিষ্ট সংখ্যার অধিক। এর মধ্যে রাতে ছাত্রলীগের অফিসিয়াল পেজে দেখা যায় ৩৭৬ জনকে পদে রাখা হয়েছে। সকালে আরো ৪৯ জনকে পদে রাখার দুইটি বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পেজে পাওয়া যায় যায়নি। এত বেশি সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা যায় কিনা- এমন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক ও চবিতে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত হায়দার মোহাম্মদ জিতু আজাদীকে বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩০১ সদস্য কমিটি হতে পারে। কিন্তু এখনে সকলকে সমন্বয় করার জন্য এমন করা হয়েছে। এরপরও সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি। নিয়মিত কমিটি হলে এ রকমটা হতো না।

যত অভিযোগ: অভিযোগ রয়েছে, কমিটিতে পদপ্রাপ্তদের মাঝে রয়েছে অছাত্র, বিবাহিত, অস্ত্র মামলার আসামি, বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী, সাংবাদিক মারধরকারী, হুমকি প্রদানকারী, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধরকারী, মাদক ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবীসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠনের নিয়ম শৃঙ্খলা বহির্ভূত বিষয়ে জড়িত অনেকেই। এমনকি প্রথম, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও পদ পেয়েছে বলেও জানা গেছে।

জানা যায়, বিবাহিতদের মধ্যে রয়েছেন, আরিফুল বারী তানভীর তপু, মাহদুল হাসান রুপক, সবুজ মিয়া, এনামুল হক, শামসুজ্জামান চৌধুরী সম্রাট, সাজ্জাদ হোসেন জুয়েলসহ অনেকেই। ৪২৫ জনের কমিটিতে প্রায় ৩০ জনের অধিক আছে যাদের ছাত্রত্ব নেই। এছাড়া তৈমুর হোসেন মাহিম, আবির হাসান সিয়াম, সিরাজুল কবির সাহিল, শরীফ উদ্দিনসহ কয়েকটি নাম একাধিক বার এসেছে। আবার উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদ মিজানুর রহমান নামে দুইজন দাবি করেছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্যাডে নাম এডিট করে বসিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর খবরও পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, দুইটা পাতা সাইন করেছে, কিন্তু যুক্ত হয়নি। পরে যুক্ত হয়েছে।

পদবঞ্চিত-পদধারীদের ক্ষোভ, আন্দোলন: মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর পর চবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেয়ে পদধারীরা উচ্ছ্বসিত হলেও কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি কমিটিতে ক্রম মানা হয়নি ও প্রত্যাশিত পদ দেওয়া হয়নি। আবার সিনিয়রকে পদ না দিয়ে জুনিয়রদের পদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঘোষিত কমিটিতে অছাত্র, জামাত-শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত এমনদেরও রাখার অভিযোগ এনে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা ডাক দিয়েছে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ।

গত রবিবার দিবাগত রাত ২টা থেকে মূল ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করা হয়। পাঁচ দফা দাবিতে অব্যহত রয়েছে অবরোধ।

পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদ প্রাপ্ত নজরুল ইসলাম সবুজ আজাদীকে বলেন, যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে শুরু থেকে জড়িত ছিলেন, ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতা তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে এ কমিটিতে বাহিরের অনেকেই পদ পেয়েছেন। এমনকি যারা করোনার সময় ক্যাম্পাসে ঢুকেছে তাদেরও কমিটিতে রাখা হয়েছে।

আন্দোলনকারী ও পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ কমিটিতে জ্যেষ্ঠতা রক্ষা হয়নি। রাজপথের নিবেদিত কর্মীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে আছে অছাত্র ও বিবাহিতরা। অনেকে টাকার বিনিময়ে পদ পেয়েছেন। এসব কারণে আমরা বঙ্গবন্ধু আদর্শের কর্মীরা শান্তিপূর্ণ অবরোধের ডাক দিয়েছি। কমিটিতে অনেকের পারিবারিকভাবে বিএনপি-জামাগের সাথে সম্পৃক্ত। কমিটিতে মাঠের প্রকৃত কর্মীদের অন্তর্ভুক্তের আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরোধ থাকবে।
আন্দোলনকারী আরেক নেতা ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, অছাত্র ও বহিষ্কৃতদের কমিটিতে এনে আমাদের ধন্য করেছেন। যারা আপনাদের নেতা বানিয়েছেন, তাদের সম্মান কতটুকু রাখতে পারলেন, বিবেককে প্রশ্ন করে দেখেন।

এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক হায়দার মোহাম্মদ জিতু বলেন, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে সেটা কেন্দ্রের কাছে আসলে যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। অভিযোগের যথাযথ প্রমাণ মিললে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে৷

আন্দোলনকারীদের বর্ধিত কমিটির ব্যাপারে তিনি বলেন, যারা পদবঞ্চিত হয়েছেন তারা যদি যথাযথ উপায়ে আমাদের কাছে পৌঁছান, আমরা সেটা কেন্দ্রে পাঠাবো। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেটা মানার মতো হলে মানা হবে।

রুবেলের বক্তব্য: শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল আজাদীকে বলেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিয়েছি। এরপর কেন্দ্রের অনেকগুলো কাজ থাকে। এটা আমার জানার বাহিরে। এখন যারা পদবঞ্চিত হয়েছে তারা যোগাযোগ করুক, যোগাযোগ করে সমাধান করুক। কোনো না কোনো সমাধান হবে বলে আশা করি। সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুকে কল দিলে তিনি কেটে দেন।

এর আগে ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই সর্বশেষ চবি শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর দুই দফায় শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সবশেষ ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯ মাস পর ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কমিটিতে রেজাউল হক রুবেলকে সভাপতি ও ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই সদস্যের কমিটি দেওয়ার ৩ বছর ১৬ দিন পর অবশেষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেয়েছে চবি ছাত্রলীগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশাল কমিটি নিয়ে দিনভর আলোচনা
পরবর্তী নিবন্ধউল্টো পথে গাড়ি চলাচল, ৪১টি মামলা