আজকের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

কামরুন্নাহার রোজী | বৃহস্পতিবার , ২৮ জুলাই, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশ এখন অনেক কিছুতেই এগিয়ে আছে। তেল- চালের বাজারে আগুন লাগলেও বিজ্ঞানের সফলতায় প্রযুক্তি নির্ভর দেশ বলা যায়। এই নির্ভরশীলতা দেশের মানুষকেও প্রভাবিত করে আসছে। বিশেষ করে সর্বগ্রাসী করোনার কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই করোনা আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়েও নিয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোনো শিক্ষাঙ্গনে কিংবা বাড়ির কোনো পড়ার পরিবেশে মানুষ হবার প্রতিজ্ঞায় অথবা স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে নিজের মন থেকে অথবা নিজের ইচ্ছেতে অনেক শিক্ষার্থী যথাসময়ে পড়তে বসে না। যদিওবা পড়তে বসে তাও অভিভাবকদের পীড়াপীড়িতে। সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হচ্ছে বই পড়ার চেয়ে এই শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির ওপর বেশি নির্ভরশীল। পড়ার টেবিলে বসতে না বসতেই হয় মোবাইলফোন নয় ল্যাপটপ অথবা অন্য কোনো প্রযুক্তির মধ্যে পড়ার বিষয় খোঁজার চেষ্টা করে। কখনো দেখা যায়, পরিচিত কোনো কবির জন্মতারিখ কিংবা অতি সাধারণ কোনো কিছুর সংজ্ঞা কিংবা ভোকাবিউলারি জানার জন্য হাতড়ে বেড়ায় প্রযুক্তি। বইয়ের পাতা উল্টানোর মধ্যে রীতিমতো ওরা ক্লান্তি বোধ করে। পাঠ্যভুক্ত যে পড়া বই খুলে পড়া হতো সেটাও যেন প্রযুক্তির সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একসময় শব্দের অর্থ কিংবা শব্দ খোঁজার জন্য আমরা ডিকশনারি কিংবা অভিধানের শরণাপন্ন হয়েছি। একটা শব্দ খুঁজতে গিয়ে পাশাপাশি আরো পাঁচ /দশটা শব্দের অর্থ আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু এখন দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে সেই কষ্ট ওরা আর করতে চায় না। এরা নিতান্তই যান্ত্রিক। বইপড়ুয়া নয়, জ্ঞানপিপাসু নয়, নয় স্বপ্নচারী। এরা প্রযুক্তির কুপ্রভাবে ভেসে যাওয়া বোধহীন পোষা প্রাণীতে পরিণত হয়ে পড়ছে। এক সময় বড়রা আমাদের চোখ রাঙালে কিংবা কোনো কিছু ‘ভালো না’ বললে আমরা ভয়ে লজ্জায় গ্যাসীয় বেলুনের মতো চুপসে যেতাম। আর এখন ? এখনতো আর আগের মতো লজ্জায় শ্রদ্ধায় বড়দের প্রতি মস্তক অবনত করে না ওরা। ওরা ওভার স্মার্ট। জ্ঞান কম, বুঝে বেশি। বেশি বেশি বাড়াবাড়ি, যুক্তিতর্ক, সাহসিকতা কিংবা দুঃসাহসিকতা যেন ওদের ডিজিটাল স্টাইল।
সন্ধ্যা হলে আমরা পড়তে বসতাম। আমরা বুঝে যেতাম এটাই আমাদের পড়ার সময়। প্রতিদিন আমাদের এভাবে বসতে হবে। উঠোনের দুপাশে সারি সারি ঘর। প্রতিঘরেই দু-তিনজন শিক্ষার্থী। সবার পড়ার ঘর থেকে আবছা আলো এসে পড়তো উঠোনে। আর সবার পড়ার গুনগুন শব্দ আলো-আঁধারির চমৎকার এক পরিবেশ সৃষ্টি করে। সন্ধ্যার ফুরফুরে শীতল স্নিগ্ধ হাওয়া আর পড়ার গুনগুন শব্দ মনটা ভরিয়ে দিতো। সত্যি, সেই দিনগুলো এখন কেবলই স্মৃতি। আজকাল ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ালেখা করে নিঃশব্দে, চুপচাপ, যাতে আশপাশের শব্দগুলো মগজে হানা দিতে পারে। নিজের মুখনিঃসৃত পড়ার শব্দটা মিশে যায় হাজারো শব্দের ভীড়ে। এসব শিক্ষার্থীদের যখন বলা হয়, মুখের পড়াটা যত স্পষ্ট কানে পৌঁছায় ততই মগজে জায়গা দখল করে। দীর্ঘস্থায়ী হয়। উত্তরে বলে, ‘ওরা শব্দ করে পড়তে পারে না, এভাবেই ওদের পড়া হয়’। একটা পড়া শেখার পর ২/৩ ঘণ্টা পার হতে না হতেই পড়াটা ওরা ভুলে যায়। এমনকি বলা যায় সকালের পড়া বিকেলেই ভুলে যায়। পড়াগুলো বেশি দূর এগোয় না, রেখাপাত করে না মনে। জায়গা দখল করে না মগজে। কী হবে এই দুর্ভাগাদের? আবার কলেজের প্রথম বর্ষের কথাই ধরা যাক, স্কুলের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যখন ওরা প্রথম বর্ষে উন্নীত হয় তখন নিজেকে মনে করে একেকটা সুপারম্যান কিংবা সুপারউইমেন। পুরো পৃথিবীটাই ওদের কাছে রঙিন মনে হয়। মনে হয় ওরা দুনিয়ার কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না। ওদের কাছে মনে হয়, ফার্স্ট ইয়ার ড্যামকেয়ার।
ক্যাম্পাসে হাঁটাচলার সময় স্যারদের সাথে দেখা হলে সালাম দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না, একধরনের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মনে হয় কোনোরকম শ্রদ্ধা নিবেদনের বালাই নেই। এমন অনেককে দেখা যায় স্যারের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য দেখিয়ে দেখিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। শার্টের বোতাম খুলে যেন পৈতৃক সম্পত্তির উপর দিয়ে হেঁটে যায়।
সরকারি চাকরির বদলির কারণে অনেক প্রফেসর কলেজের হোস্টেলে থাকেন। বিশেষ করে এধরনের শিক্ষকদের প্রতি বিরূপ আচরণ করে থাকে বখে যাওয়া ছাত্ররা। বলা যায়, প্রযুক্তির অশুভ প্রভাবই এর মূল কারণ। এসব বিরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা হওয়া উচিত শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের এবং অভিভাবকদের। তাছাড়া মোবাইল কোম্পানিগুলো এর বাইরে নয়।
পানি যেমন একদিকে মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করে ঠিক তেমনি অন্যদিকে ডুবিয়েও মারে। প্রযুক্তির ভূমিকাও আজ পানির মতো বলা যায়। বর্তমানে আমরা ইন্টারনেটের যে ফল ভোগ করছি তার পুরোটাই কি আসলে সুফল? আর তাও যদি হয় সেটাই বা কতটুকু?
বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৯৫% অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজস্ব মোবাইল ব্যবহার করে। বাকি ৫% ছেলেমেয়ে মা-বাবার মোবাইল ব্যবহার করে। তাতে নামটা শুধু মা-বাবার বাকি সারাটা দিন ছেলেমেয়ের। এমনকি দেখা যায় জরুরি কোনো ফোনকল করার জন্য মা অথবা বাবাকে ছেলেমেয়ের কাছ থেকে মোবাইল নেওয়ার জন্য অনুমতি নিতে হয়। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, মায়েরা তার ছোট্ট শিশুটিকেও মোবাইল দিয়ে নানান ধরনের ছবি দেখতে ব্যস্ত রাখে। এরই ফাঁকে মা অন্তত ঘরের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারে। শিশুটি মাকে খুঁজছে না, কান্না করছে না। নিশ্চিন্তে মা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু ছোট্ট শিশুটি ধীরে ধীরে মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়ছে।
শিক্ষার্থীদের জীবনে মোবাইল নির্ভরতা ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরেও প্রসারিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে করোনার বড় ধরনের ধাক্কা থেকে মানুষ রেহাই পেলেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, কোচিং সেন্টার ইন্টারনেটের লব্ধ ও অধিকৃত সুবিধাগুলো হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক জুতসই পন্থা খুঁজে পেয়েছে এতদিনে। এতে ইন্টারনেটে তারা অনেক অফিসিয়াল কাজ সহজে সেরে নিচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক রুটিন, দৈনিক এবং সাপ্তাহিক রেজাল্ট, নোটিশসহ আরও প্রয়োজনীয় তথ্য এখন অনলাইনে দিয়ে থাকে। তাছাড়া কিছু কলেজ ক্লাস টিচারের সাথে শিক্ষার্থীদের গ্রুপ, নোটিশ, রুটিন ইত্যাদি অনলাইনে করে থাকে। বিকাশে বেতনও গ্রহণ করে। হ্যাঁ, এখন ডিজিটাল যুগ, বিজ্ঞানের ছোঁয়া পেয়ে মানুষ প্রযুক্তির সাহায্যে এসব সুবিধা তো ভোগ করবে স্বাভাবিক। এখানে সুবিধা আছে ঠিকই। কিন্তু এই অজুহাতে ছেলেমেয়েরা এখন মোবাইল জব্দ করে রাখতে চায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেদের যুক্ত রাখার নাম করে। যার নেপথ্যে এই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা গেম থেকে শুরু করে যে যার সুবিধামতো কাঙ্ক্ষিত ছবি কিংবা ভিডিও আরো কত কি সুবিধা লুফে নিচ্ছে। যার কারণে ভেতরে ভেতরে একটু একটু করে পড়া থেকে বিমুখ হতে চলেছে শিক্ষার্থীরা।
পড়ার নাম করে ফাঁকে ফাঁকে সুন্দর সুন্দর মজার মজার রঙিন ছবি দেখতে পাচ্ছে, বেশ মজা পাচ্ছে। ইউটিউব খুললেই আপত্তিকর ছবি, কাঙ্ক্ষিত বিষয় মিলে যাচ্ছে অনায়াসে। অজানার প্রতি অদেখার প্রতি অদম্য কৌতুহল দিন দিন এদের বেড়েই চলেছে। মাথার ভেতর কিলবিল করছে, পড়ার চেয়ে অনেক সহজতর কল্পনা, ছবি, নাচ, গান আরো কত কি।
কোনো কোনো মা-বাবাকে অতি উৎসাহের সাথে বলতে শোনা যায় আমার প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া বাচ্চাটা জানেন, মোবাইল অন করতে পারে, ছবি দেখতে পারে। আবার কোনো কোনো মা বাবাকে এও বলতে শোনা যায়, জানেন, আমার ছোট্ট ছেলেটা মোবাইলের অনেক ফাংশন পারে? অনেক মা বাবাকে বলতে শোনা যায় ‘আমার ছেলে না এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে শুধু মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে থাকে। এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যায় না। কোনো কোনো মা বাবাকে একেবারে খুশিতে টগবগ হয়ে বলতে শোনা যায়, আমার ছেলেমেয়ে দারুণ পাবজি খেলে, ফ্রি ফায়ার খেলে।
প্রতিদিন এভাবে একটু একটু করে ভালোলাগা আনন্দ একসময় আসক্তি হয়ে ভেতরে ভেতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে আমার আপনার আদরের সন্তানদের।
একটু খুঁজে দেখলে দেখবেন অনেক ছেলেমেয়ে পড়া থেকে একেবারে ছিটকে পড়েছে। অভিভাবক কিংবা শিক্ষকদের দেখানোর জন্য বই হাতে নেয় বটে কিন্তু পড়ার সামনে থেকেও যেন পড়ার ভেতর নেই। বাজে ভিডিও নোংরা ছবি দেখার আসক্তি খুব তাড়াতাড়ি অভ্যেসে পরিণত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে আজকের কিশোর তরুণ -সমাজ, আগামী প্রজন্ম, ধ্বংস হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ।
এই ইন্টারনেটের কু প্রভাব কিংবা কুফল আট বছরের শিশু থেকে শুরু করে কিশোর তরুণ সমাজকে ক্যান্সারের মতো ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছে সেদিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কিংবা নেই কোনো উত্তরণের পদক্ষেপ।
আসলে আমরা ইন্টারনেটের পজিটিভ দিকগুলোর প্রতি দুর্বল অসহায় বোবা। এ ব্যাপারে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের সচেতনতার পাশাপাশি জরুরি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। দেখা গেছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো করোনার শুরুর দিক থেকে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুবাদে বেশ ব্যবসা সফল হয়েছেন। সুতরাং মোবাইল কোম্পানিগুলোর এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা উচিত। তারাই পারে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে নতুন ধরনের কোনো মোবাইল শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করে দিতে। আজকের এই শিশু কিশোর তরুণ সমাজের বয়স, পরিস্থিতি এবং ক্লাস নির্ভর আলাদা সিস্টেম কিংবা প্রয়োজনীয় সীমিত বিনোদন সহ জ্ঞানমূলক কোনো কনসেপ্ট যদি মোবাইলে দিতে পারা যায় অর্থাৎ ওদের জন্য আলাদা মোবাইল আবিষ্কার করা যায় এবং একই সাথে তা বাস্তবায়নে সরকারি নজরদারি সৃষ্টি করা যায় তাহলে হয়তো জাতি এই অবক্ষয় থেকে অভিশাপ থেকে ধ্বংস থেকে মুক্তি পেতে পারে।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধআল শাবারের ৮৫ যোদ্ধাকে হত্যা