পানিতে ডুবে মৃত্যুসংখ্যা মহামারির চেয়েও বেশি
২০২০ সালের শুরুতে কভিড-১৯ মহামারির কথা শোনা গেলেও বাংলাদেশে এই রোগে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৬ এপ্রিল ২০২০। তার আগে ২৬ মার্চ থেকে সরকার প্রথমে ১০ দিনের বন্ধ দিলেও তা পরে দীর্ঘ লকডাউনে পরিণত হয়। এ বছরের শুরু থেকে মহামারির প্রকোপ কমতে থাকলেও গত দু মাস থেকে আবার সংক্রমণ বেড়েছে। কয়েকমাস মৃত্যুশূন্য থাকার পর দুয়েকজন থেকে মৃত্যুসংখ্যা ক্রমেই বাড়তির দিকে।
দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছরে মহামারিতে মৃত্যু সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার পার হয়নি। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে অনেকের দ্বিমত আছে। কিছু সংবাদপত্রের দাবি প্রকৃত সংখ্যা পাঁচগুণ হবে। এর পক্ষে যেহেতু আমাদের হাতে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই সেহেতু সরকারি সে হিসাবকে গণ্য ধরে বলছি আড়াই বছরে মহামারিতে মৃত্যুর চেয়েও বেশি মানুষ মারা গেছে শুধু পানিতে ডুবে সে খবর আমরা কয়জন রাখছি বা তা প্রতিরোধে ভাবছি। এ পরিস্থিতি চলছে বছরের পর বছর। এটা মহামারির চেয়েও ভয়ঙ্কর। এই অপমৃত্যু ঠেকাতে হবে। বেশি মানুষের দেশ বলে হয়ত প্রতিবছর এত মানবসন্তান মৃত্যুর খবরে আমরা খুব বেশি বিচলিত হই না।
হাজার নদীর দেশে, হাওড়-বাওড়ের দেশে, বন্যাপ্রবণ দেশে এত মানুষ শুধু পানিতে ডুবে মারা যায় তা শুনে অবাক হওয়ার কথা।
গত ২৫ জুলাই ছিল ‘বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস’। দিবসটি বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হয়েছে। পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা বাংলাদেশ। দিবসটি উপলক্ষে গত রবিবার সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ও প্রথম আলো রাজধানীতে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সেখানে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে বলা হয়েছে, ‘দেশে পানিতে ডুবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩০টি শিশু মারা যায়। এসব মৃত্যুর ৮০ শতাংশই বাড়ি থেকে ২০ মিটারের মধ্যে ঘটে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পুকুর, ডোবা ও বালতির পানিতে। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে মায়েদের ব্যস্ততার সময় বেশির ভাগ শিশুর মৃত্যু হয়।’
বৈঠকে সিআইপিআরবির উপনির্বাহী পরিচালক আমিনুর রহমান বিভিন্ন জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, দেশে বছরে পানিতে ডুবে ১৯ হাজার মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে শিশু প্রায় ১৪ হাজার ৫০০। এদের মধ্যে আবার ১০ হাজারের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী মোট শিশুমৃত্যুর ৫৮ শতাংশই পানিতে ডুবে হয়। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত মায়েদের কাজের ব্যস্ততার সময় ৬০ শতাংশ মৃত্যু ঘটে।
বৈঠকে বলা হয়েছে, ‘শিশুদের একটু দেখভাল করে রাখাসহ তিন কৌশলে এসব মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।’ তারা বলেন, ‘সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুদের সাঁতার শেখানো, অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে এলাকাভিত্তিক দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং গ্রামে মায়েরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকার সময় শিশুদের নজরে রেখে পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দিতে হবে।’
বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে এলাকাবাসীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনে একবার যদি গেঁথে যায় প্রতিরোধের কাজটি তাঁরও দায়িত্ব, তাহলে এলাকার শিশুদের দেখভাল করে নিরাপদে রাখতে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন পরিচালক মো. রোবেদ আমিন বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যুর অনেক ঘটনা নথিভুক্ত হয় না।’
বৈঠকে ড্রাউনিং প্রিভেনশন পার্টনারশিপের প্রকল্প প্রধান এষা হোসেন বলেন, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুকে এখনো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোন মন্ত্রণালয় কী কাজ করবে, তা নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছে। সভাপতির বক্তব্যে সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, একটি শিশুর জীবনের জন্য একটি মুহূর্তও গুরুত্বপূর্ণ। পানিতে ডোবা নীরব মহামারিও একটি বড় সমস্যা।
পানিতে ডুবে প্রতিবছর যদি ১৯ হাজার হাজার মানুষ মারা যায় তাহলে তা মহামারির চেয়েও ভয়ঙ্কর বলতে হবে যে কোনো শর্তে। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা ১৪ হাজার পাঁচ শ। সাড়ে চৌদ্দ হাজার শিশু প্রতিবছর পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে এই খবরটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও আমাদের হয়ত জানাও নেই তা। আমরা লক্ষ্য করব বৈঠকে বলা হয়েছে, ‘এসব মৃত্যুর ৮০ শতাংশই বাড়ি থেকে ২০ মিটারের মধ্যে ঘটে। আরও বলা হয়েছে সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত মায়েদের কাজের ব্যস্ততার সময় ৬০ শতাংশ মৃত্যু ঘটে।’
আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি নদী-খাল-হাওড়-বাওড় ও বন্যাপ্রবণ দেশে এত মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাবে কেন? নদী-খাল-সাগরে ডুবেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তবে সে সংখ্যা ঘরের পাশের পুকুর বা ডোবায় ডুবে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে কম।
পুকুরে ডুবে এত শিশু মৃত্যুবরণ করবে কেন? পুকুর তো আমাদের সময়ে ছিল, তার আগেও ছিল, শত শত বছর ধরে ছিল। সে সময় এত মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও এখন কেন সে সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে?
গ্রামে একটি বাড়িতে অন্তত তিনটি পুকুর থাকতো। বাড়ির পেছনের পুকুর ছিল নারীদের জন্য। আর সামনের দুটো ছিল পুরুষদের ব্যবহারের। এ ছাড়া পাড়ায় বা সারা গ্রামজুড়ে আরও বড় পুকুর বা দীঘি তো থাকতোই। পুকুর ছাড়াও অসংখ্য ডোবা থাকতো পানিতে পরিপূর্ণ। শুধু গ্রামে নয় শহরে ছিল হাজার হাজার পুকুর। বরং আগের তুলনায় গ্রাম ও শহরে পুকুর-দীঘির সংখ্যা কমেছে। অনেক গ্রামে শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই প্রচুর পুকুর শুকিয়ে যায়। তারপরও পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে কেন?
উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে বলা হয়েছে, ‘মায়েদের ব্যস্ততার সময়..’। মায়েদের ব্যস্ততা তো আগেও ছিল, বরঞ্চ তা বর্তমানের তুলনায় বেশিই ছিল। তাছাড়া বর্তমানের চেয়ে আগে সন্তান-সন্ততির সংখ্যাও অনেক বেশি ছিল। তখন পুকুরে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম। এখন কেন বৃদ্ধি পেল? এসবকিছু আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমি যেহেতু বিশেষজ্ঞ নই সেহেতু আমার বক্তব্যকে বিশেষজ্ঞের মতামত ধরে নিলে ভুল হবে।
আমার মতে কারণগুলো হতে পারে, আগে মায়েদের সাংসারিক কাজ ছাড়া অন্যকিছু করার উপায় ছিল না। ফলে তার পূর্ণ মনোযোগ থাকতো সংসার ও সন্তান-সন্ততির ওপর। এখন সময়ের সঙ্গে জীবনযাপন পাল্টেছে। মানুষের জীবনে যুক্ত হয়েছে ২৪ ঘণ্টার টেলিভিশন চ্যানেল, মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নেট দুনিয়া। এসব শহর থেকে গ্রামে পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রায় মানুষ কোনো না কোনোভাবে এমন সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। গবেষণা করলে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে কত ঘণ্টা মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করে। মায়েদের ব্যস্ততার কথা বলা হয়েছে, প্রতিবেদনে সে সময় আসলে কী ধরনের কাজে ব্যস্ত ছিল সে তথ্যটিও যুক্ত করলে প্রকৃত চিত্রটি পেতে সুবিধা হতো। সে সঙ্গে ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবারপদ্ধতি। একটি শিশুর ওপর আগে যতগুলো চোখ থাকতো এখন তা থাকে না। পরিবারের সদস্যরা সময় পেলেই মোবাইল নিয়ে বসে যায় অন্যদিকে লক্ষ করার আগ্রহই থাকে না তাদের। ঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বে পানিতে ডোবার ঘটনা ঘটলেও বন্যায় যখন চারদিকে পানি থৈ থৈ করে সে সময় পানিতে ডুবে মৃত্যু বেশি হওয়ার কথা থাকলেও সেসময় মৃত্যু বেশি ঘটে না তার কারণ অধিক সতর্কতা। বন্যায় বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যরা যেভাবে একটি শিশুকে দেখভাল করে বা তার দিকে নজর রাখে স্বাভাবিক সময়ে সেরকম রাখে না।
একসময় গ্রামে প্রতিটি শিশুর কোমরে ঝুমঝুমি বেঁধে দেওয়া হত। এটি বিনাকারণে করা হতো না। শিশুটির গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্যই তা করা হতো। আগে অনেক পরিবারে মেয়েরা একটু বড় হলে তাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হতো। মায়ের সঙ্গে থাকা এই মেয়েরাই ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনার অনেক দায়িত্ব পালন করতো। এখন আগের চেয়ে মেয়েরা অধিকহারে স্কুল-কলেজে যায় ফলে অনেক পরিবারে মা ছাড়া শিশুদের দেখভালেরও কেউ থাকে না।
গোলটেবিলে বিশেষজ্ঞরা তিনটি উপায় বলেছেন তা উদ্ধৃত করেছি। পাঠকরা পড়েছেন নিশ্চয়ই। সাঁতার শিখিয়ে এক্ষেত্রে মৃত্যুর হার কমানো যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে দশ হাজারের বেশি শিশু মারা যাচ্ছে যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে তাদের তো আর সাঁতার শেখানোর উপায় নেই। তাদের রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটি নিশ্চয় মনে আছে? ঘরের পাশের পুকুর বা ডোবায় নিরাপত্তা বেষ্টনী দিন। তাতেই সমস্যা প্রায় মিটে যাবে। এত বড় বড় এনজিও করার দরকার নেই। গোটা পৃথিবীকে চামড়া দিয়ে ঢাকার নির্বুদ্ধিতা না করে চরণ দুখানি ঢেকে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
লেখক : কবি -সাংবাদিক












