চট্টগ্রাম বন্দরে টানা তিন দিনে আটক হয়েছে পাঁচটি মদের চালান। এ ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এত এত পরিমাণ মদ কোত্থেকে আসে, কীভাবে আসে, আবার বন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে খালাস হয় সেটি নিয়েও জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এরমধ্যেই সর্বশেষ গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালের (এনসিটি) সিএফএস শেড থেকে মদ ও সিগারেটের দুটি চালান আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখার কর্মকর্তারা। পণ্য চালান দুটি মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানির মাধ্যমে ২০ কোটি ৬৮ লাখ রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে।
চালান দু’টির মধ্যে একটি এসেছে নীলফামারির উত্তরা ইপিজেডের ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) লিমিটেডের নামে। ওই চালানে সিনথেটিক প্লাস্টিকজাত পণ্য তৈরির কাঁচামাল পলিপ্রপিলিন রেজিন আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। গত ১২ জুলাই জাহাজে কন্টেনারটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এছাড়া টেঙটাইল সুতা আমদানির ঘোষণা দিয়ে বাগেরহাটের মোংলা ইপিজেডের ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে আসা চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে গত ২ জুলাই।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হওয়ার পর গত শনিবার ভোরে নারায়নগঞ্জের সোনাগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে মদভর্তি দুটি কন্টেনার আটক করে র্যাব। আইপি জালিয়াতির মাধ্যমে কুমিল্লা ও পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডের হেশি টাইগার কোম্পানি ও বিএইচকে টেঙটাইলের নাম ব্যবহার করে কন্টেনার দুটি খালাস করা হয়। চীন থেকে আসা ১৯ হাজার ৬৫০ কেজি ও ২০ হাজার ৭৫০ কেজি ওজনের কন্টেনার দুটির বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে চট্টগ্রামের ডবলমুরিংয়ের কেবি দোভাষ লেনের জাফর আহমেদ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় চালান দুটিতে ১ হাজার ৩৩০টি কার্টনে পাসপোর্ট স্কচ হুইস্কি, ভ্যালান্টাইনস স্কচ হুইস্কি, ম্যাটেউস দ্য অরিজিনাল ওয়াইন, চিভাস রিগাল স্কচ হুইস্কি, জনি ওয়াকার রেড লেবেল/ব্ল্যাক লেবেল স্কচ হুইস্কি, টিচার্স হাইল্যান্ড স্কচ হুইস্কি, স্মারনফ ভদকা ও রেড রোজ ব্র্যান্ডের মদ পাওয়া যায়। এর মোট পরিমাণ ৩১ হাজার ৬২৫ লিটার। এসব মদের আনুমানিক শুল্কায়নযোগ্য মূল্য চার কোটি ৪৬ লাখ টাকা। উচ্চশুল্কের পণ্য হওয়ায় এই চালানের মাধ্যমে ২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানায় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে গত রোববার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আরো একটি মদভর্তি কন্টেনার আটক করে কাস্টমসের এআইআর শাখা। নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেডের নামে আসা চালানটির শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় ১৫ হাজার ২০৪ লিটার মদ পাওয়া যায়। মিথ্যা ঘোষণায় মদ এনে ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমদানিকারক।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের এআইআর শাখার উপ-কমিশনার সাইফুল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, আজ (গতকাল) চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আরো দুটি মদভর্তি কন্টেনার আটক করা হয়েছে। পণ্য চালান দুটির ২৮৫৮ কার্টনে মোট ৩১ হাজার ৪৯২.৫ লিটার মদ পাওয়া যায়। যার আনুমানিক শুল্কায়ন যোগ্য মূল্য ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। চালান দুটিতে রাজস্বের পরিমাণ ২০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এছাড়া অপর একটি চালানে ৫৩ হাজার পেকেটে মোট ১০ লাখ ৬০ হাজার শলাকা আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি সিগারেট রয়েছে। পণ্য চালান দুটি মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানির মাধ্যমে ২০ কোটি ৬৮ লাখ রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে। এর আগে গত শনিবার ও রোবববার কুমিল্লা ইপিজেড, পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেড এবং নীলফামারির উত্তরা ইপিজেডের নামে আসা তিনটি চালান আটক করা হয়। এরমধ্যে শনিবার দুটি চালান বন্দর থেকে খালাস হওয়ার পর নারায়নগঞ্জ থেকে আটক করা হয়। এছাড়া রোববার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আরো একটি মদভর্তি কন্টেনার আটক হয়েছে।
উল্লেখ্য, নারায়নগঞ্জ থেকে আটক হওয়া মদভর্তি দুই কন্টেনারের বিষয়ে র্যাব গত রোববার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানায়, সুতা ও মেশিনারিজ ঘোষণায় আনা যে দুই কন্টেনার থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ জব্দ করা হয়েছে, সেই কন্টেনার দুটি স্ক্যানিং ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছিল। কন্টেনার দুটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পথে শনিবার ভোরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে আটক করা হয়। সেখান থেকে মোট ৩৬ হাজার ৮১৬ বোতল মদ উদ্ধার করে র্যাব বলছে, ঢাকার কিছু হোটেল, বার ও ক্লাব এসব মদের ক্রেতা। গার্মেন্টস পণ্যের মিথ্যা ঘোষণায় এই মদ আমদানির পেছনে রয়েছে মুন্সীগঞ্জ কেন্দ্রিক একটি চক্র, যাদের নেটওয়ার্ক দুবাই পর্যন্ত বিস্তৃত। চলতি বছরেই তারা আরও তিনটি চালানে মিথ্যা ঘোষণায় প্রায় ৪৮ হাজার বোতল বিদেশি মদ এনেছে। এই মদ আমদানির হোতা আজিজুল ইসলাম ও তার বড় ছেলে মিজানুর রহমান আশিক শনিবারই দুবাই পালিয়েছেন। আজিজুলের ছোট ছেলে আহাদকে গত রোববার সকালে বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর দুবাই বসে চক্রের কলকাঠি নাড়ছেন নাসির উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি। তার বাড়িও মুন্সীগঞ্জে। দুবাই থেকেই এই মদগুলো আনা হচ্ছিল।