পটিয়ায় শিক্ষা বিস্তার ও আহমদ হোসেন খানের সাধনা

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২৩ জুলাই, ২০২২ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

মুসলমানরা যখন ইংরেজি শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তাদেরকে এই আত্মঘাতী পথ থেকে সরে এসে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ। হাজি মহসিন আর্থিক তহবিল প্রদান করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের পথ সুগম করেছিলেন। তাঁর দানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো। অনেক গরীব ছাত্র বৃত্তি পেয়ে লেখাপড়া করতে পেরেছিলো। চট্টগ্রামে খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বিএ, বাদশা মিয়া চৌধুরী, সীতাকুণ্ডে মওলানা ওবায়দুল হক, চট্টগ্রাম শহরে কাজেম আলি মাস্টার, এবাদুল্লাহ পণ্ডিত, কলিমউল্লাহ মাস্টার, নাজিরহাট-ফটিকছড়িতে মওলানা আফজল আলী, হাটহাজারীতে আবদুল ওয়াদুদ সেরেস্তাদার, রাউজানে নুরুল আবছার চৌধুরী ও নুরুল হুদা চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়, পটিয়ায় রাহাত আলী, আবদুস সোবহান, হামিদুর রহমান, আবদুুল আউয়াল চৌধুরী, আহমদ হোসেন খান শিক্ষা বিস্তারের জন্য যে অসামান্য অবদান রাখেন, তা’ আজ ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে। আবুল কাশেম, খান সাহেব ওমরা মিয়া চৌধুরী, আবদুল জলিল চৌধুরী, ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও নুর মোহাম্মদ চৌধুরী শিক্ষা প্রসারের লক্ষে স্কুল-কলেজ স্থাপনের জন্য তাঁদের আর্থিক তহবিল উন্মুক্ত করে দেন। পটিয়ায় আবদুল আউয়াল চৌধুরী দৌলতপুর হাইস্কুল, আবদুুল জলিল চৌধুরী এজে চৌধুরী কলেজ এবং ছালেহ চৌধুরী ও নুর মাহাম্মদ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেছেন হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজ। চরকানাই’র বড় হাফেজ সাহেব সায়ীদ আহমদ সাহেবের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, যাঁর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে চরকানাই হাইস্কুল।ছালেহ আহমদ চৌধুরী শুধু কলেজ নয়, হুলাইনে তাঁর দানে আরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাইমারি স্কুল, মাদ্রাসা, হেফজখানা, মসজিদ ইত্যাদি। সে জন্য তিনি অবশ্যই মান্য ও স্মরণীয় পুরুষ। কিন্তু আরো একটি নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি হচ্ছেন শিক্ষাব্রতী আহমদ হোসেন খান। তিনিও হুলাইনের মানুষ, যিনি প্রথমদিকে ছিলেন সমাজকর্মী কিন্তু হুলাইনবাসীর সৌভাগ্য পরে তিনি শিক্ষা বিস্তারের গ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে উল্লেখিত কলেজ ও স্কুলসমূহ একে একে গড়ে উঠেছিলো। হুলাইনের দুই সহোদর ভ্রাতা ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও নুর মোহাম্মদ চৌধুরী ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হন। স্বগ্রাম নিবাসী সমাজকর্মী আহমদ হোসেন খান শিক্ষা বিস্তারের পথে তাদের অর্থ কাজে লাগানোর জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তাঁরাও ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তাঁদের স্বোপার্জিত অর্থ কিভাবে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহার করা হয়, তারা যখন সেকথা ভাবছিলেন এবং শিক্ষার উন্নয়নেই যে তার সদ্ব্যবহার করা যায়, সেকথা যখন তাঁরা মনের অনুকূলে সাড়া পেলেন, তখন আহমদ হোসেন খানের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ঘটলো। তিনজনের চিন্তার মিলনের শুভ যোগে সৃষ্টি হলো হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজ।৬৮-৬৯ সালের দিকে ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও নূর মোহাম্মদ চৌধুরী চট্টগ্রামের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী ছিলেন। ওই সময় স্ব গ্রামের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব আহমদ হোসেন খান একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে দুই ভাইয়ের দ্বারস্থ হলে, যেহেতু তাঁরাও শিক্ষানুরাগী ছিলেন, তাঁরা সাগ্রহে উক্ত প্রস্তাবকে স্বাগত জানান এবং প্রয়োজনীয় তহবিল জোগান দিতে সম্মত হলে কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এখানে দু’ভাইয়ের যে মহত্ত্বের পরিচয় আমরা পাই, তা’হলো তাঁদের মত বিত্তবান ব্যবসায়ী সেসময় চট্টগ্রামে আরো বেশ কয়েকজন ছিলেন। কিন্তু কেউ একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসেন নি। হুলাইনে পরে ছালেহ আহমদ চৌধুরী আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছালেহ-নূর কলেজের জন্য শুধু বিপুল অর্থ ব্যয় নয়, দু’ভাই অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগও স্বীকার করেছেন। আহমদ হোসেন খান একজন ঁহংঁহম যবৎড় ু কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি টাকা দেন নি সত্য, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, একাগ্রতা, অপরিসীম আগ্রহ ও আন্তরিক উদ্যম না হলে কলেজ প্রতিষ্ঠা দুরূহ হয়ে পড়তো।
কলেজের জন্য আহমদ হোসেন খান অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তিনি উদয়াস্ত খেটেছেন, সমস্ত ঝামেলা একাই সামাল দিয়েছেন এবং হাসিমুখে সব কষ্ট সয়ে গেছেন। পরিবার, ছেলেমেয়েদের প্রতিও ফিরে তাকাবার ফুরসৎ পাননি, ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে দিন নেই রাত নেই শুধু কলেজ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। তাঁর চাকরি ছিলো শহরে, সে চাকরিও ঠিকমতো করতে পারেন নি, অফিসে শুধু হাজিরাটা দিয়ে শহরের অলিগলি-রাজপথে ঘুরে ঘুরে নানাজনকে খুঁজে বেড়ানো, কলেজের জন্য তাদের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া; আবার গ্রামে গ্রামে ঘুরে কলেজে ছেলেমেয়ে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা-এই ছিলো আহমদ হোসেন খানের প্রাত্যহিক রুটিন। এভাবে আহমদ হোসেন খান তাঁর বন্ধু মুকুটনাইটের আরেকজন শিক্ষাব্রতী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তিত্ব খলিলুর রহমান চৌধুরী, হুলাইনের মাস্টার মোহাম্মদ নাছির বিএবিএড ও মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী, জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এয়াকুবদণ্ডী নিবাসী এ কে এম নুরুল ইসলাম, ওকন্যারা গ্রামের সাংবাদিক হাবিবুর রহমান খান এবং জিরির মওলানা আমজাদ হোসেন প্রমুখের সহায়তায় তাঁর কলেজ প্রতিষ্ঠার চিন্তা বাস্তবে রূপদান করে ফেললেন।
তাঁদের সৌভাগ্য এ সময় মনসা গ্রাম নিবাসী নুরুচ্ছাফা সাহেব কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এমন অনুকূল পরিস্থিতিতেই তো বড় বড় পরিকল্পনা বাস্তবাযনের পথ সুগম হয়। অতএব ছালেহ-নূর কলেজও একদিন স্থাপিত হলো হুলাইন গ্রামে সুজা রোড বা আরাকান রোড বা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডের পাশে নয়নাভিরাম এক নিসর্গ-খণ্ডে।
ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও নূর মোহাম্মদ চৌধুরী যদি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বা স্থাপয়িতা হন, তাহলে আহমদ হোসেন খানকে তার স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার বলতে হবে। তিনি একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবী। কলেজের নামকরণের প্রশ্ন উঠলে তিনিই দু’ভাইয়ের নাম কলেজের নামকরণের প্রস্তাব দেন।
কলেজ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ১৯৬৯ সালের ২ মার্চ কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ পটিয়া থানার নাইখাইন গ্রামনিবাসী ড. আতাউল হাকিম। এ উপলক্ষে সেদিন যে অনুষ্ঠান হয়েছিলো, তাতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অধ্যক্ষ এ এ রেজাউল করিম চৌধুরী। পূর্ব পাকিস্তান সমবায় বিভাগের জয়েন্ট রেজিস্ট্রার এ জেড এম নাসির উদ্দিন, চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক প্রমোদ রঞ্জন বড়ুয়া, সিটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক সাদেকুর রহমান চৌধুরী, কাসেম জুট মিলস্‌ লি.-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও পটিয়া কলেজের প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেম, আনোয়ারা জুট মিলস লি.-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাক্তন এমএনএ জামালুস ছত্তার, সিটি কলেজের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ, অধ্যাপক শামসুল হক, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক আলতাফ হোসাইন, আগরতলা মামলার আসামী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হাবিলাসদ্বীপ গ্রাম নিবাসী ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, সদ্য কারামুক্ত তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনসা গ্রাম নিবাসী এসএম ইউসুফ, আবু জাফর সিদ্দিকী, মওলানা আমজাদ আলী খানসহ অনেকেই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
বক্তারা কলেজ প্রতিষ্ঠাকল্পে আলহাজ ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও তাঁর ভাই নুর মোহাম্মদ চৌধুরীর দেড় লক্ষ টাকা দানের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং জনসাধারণের প্রতি কলেজের সার্বিক কল্যাণে সাহায্যের হাত প্রসারিত করার আহবান জানান।
পূর্বাহ্নে সংবর্ধনা কমিটির সেক্রেটারি আহমদ হোসেন খান সে পর্যন্ত সম্পাদিত কাজের বিবরণ পেশ করেন এবং সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু টানেল ও বাবু ভাই’র দক্ষিণ চট্টগ্রাম