রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বিদায় হজ্বের ভাষণ
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আজ থেকে দেড় হাজার বৎসর পূর্বে পুন্যভূমি মক্কা নগরীর আরাফাতের ময়দানে লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে বিশ্বমানবতার অগ্রদূত কল্যাণের মূর্ত প্রতীক নির্যাতিত নিপীড়িত নিস্পেষিত অবহেলিত মানবতার আশ্রয়দাতা মানবতার কান্ডারী মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে বিশ্ব মানবাধিকারের এক অভ্রান্ত ও সার্বজনীন দলীল হিসেবে বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল ও দেদীপ্যমান।
বিদায় হজ্বের প্রেক্ষাপট : এ হজ্বকে বিদায় হজ্ব বলা হয় কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে হজ্ব ফরজ হওয়ার পর এটাই ছিল শেষ হজ্ব। নবম হিজরীতে হজ্ব ফরজ হওয়ার বিধান অবতীর্ণ হয়। এ বৎসর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে আমিরুল হুজ্জাজ নিযুক্ত করে মক্কা মুকাররমায় প্রেরণ করেন। মুসলমানগণ তাঁর নেতৃত্বে হজ্ব সম্পাদন করেন ১০ম হিজরির ২৫ জিলক্বদ শনিবার নবীজি স্বয়ং পবিত্র হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্য একলক্ষ চৌদ্দ হাজার বা আরো অধিক সাহাবার বিশাল কাফেলাসহ মদীনা মনোওয়ারা থেকে রওয়ানা হলেন, মুহাজির ও আনসার সৌভাগ্যবান সাহাবাগণের বিশাল কাফেলা নিয়ে জিলহজ্ব মাসের ৪ তারিখ রবিবার রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুন্যভূমি মক্কা মুয়াজ্জমায় প্রবেশ করেন। নবীজি হজ্বের বিধি বিধান আদায় করেন। এ হজ্বে নয়জন উম্মুল মু’মিনীন এবং নবীজির আদরের কন্যা হযরত ফাতেমাতুয যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা সাথে ছিলেন। তাফসীরকারদের মতে এ হজ্ব একাধিক নামে প্রসিদ্ধ হাজ্জাতুল বালাগ, হাজ্জাতুল ইসলাম, হাজ্জাতুল বিদা, কাসওয়া নামক উস্বীতে আরোহন করে নবীজি আরাফাতের ময়দানে পৌছেন এবং লক্ষাধিক সাহাবাদের উদ্দেশে এক দীর্ঘ ভাষণ প্রদান করেন যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বহুমাত্রিক তাৎপর্যমন্ডিত সর্বজনীন ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। খুতবার শুরুতে নবীজি আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপনের পর এরশাদ করেন। হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর, আমি জানিনা এবারের পর এ স্থানে তোমাদের সঙ্গে আর একত্র হতে পারব কিনা! “হে লোক সকল! তোমরা আজকের দিন এ মাস ও এ শহরকে যেমন পবিত্র গণ্য কর তেমনি প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত ও ধন-সম্পদকে পবিত্র আমানত হিসেবে গণ্য করবে। তোমরা অবশ্যই আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে। এবং তোমাদের সকল কর্মের জন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।” (শরহে মাওয়াহিব, খন্ড ৩য়, পৃ: ১০৫, সীরাতুল মুস্তফা, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৪১)
বিদায় হজ্বের ভাষণে মানব জাতির জান মালের নিরাপত্তা ঘোষণা : ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম, ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম অমুসলিম জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ সকলের জান মালের নিরাপত্তার অধিকার ইসলামে সুরক্ষিত। কারো উপর অন্যায় জুলম নির্যাতন অত্যাচার অনাচার হত্যা সন্ত্রাস রক্তপাত নৈরাজ্য ও মানব জীবন বিপন্ন করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। একটি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ইনসাফ ভিত্তিক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুষ্ট ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পরিস্থিতির অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। নবীজি এরশাদ করেছেন, “মনে রেখো! যদি কোনো মুসলমান কোন অমুসলিম নাগরিকের উপর নিপীড়ন চালায় তাঁর অধিকার খর্ব করে তার কোনো বস্তু জোর পূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামত দিবসে আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষ অবলম্বন করব। (আবু দাউদ ৩০৫২)
বর্ণবাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী সংকেত : নবীজি তাঁর প্রদত্ত ভাষণে জাতি বর্ণ ও গোত্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি এরশাদ করেছেন, হে মানবমন্ডলী নিশ্চয় তোমাদের প্রভূ এক তোমাদের পিতা হক সাবধান! অনারবের উপর আরবের কিংবা আরবের উপর অনারবের কৃষ্ণাঙ্গের কোন শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমাদের মধ্যে যিনি তাকওয়াবান তিনিই শ্রেষ্ঠ।
সততা ও আমানত দারিতা সম্পর্কে: যে ব্যক্তি অন্যের ধন-সম্পদের অভিভাবক বা আমানতদার তাঁর উচিৎ মালিককে তার নিকট সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া।
সর্বপ্রকার সুদ প্রথ বাতিল করা হলো: সূদের যাবতীয় লেন-দেন হারাম ও বাতিল ঘোষণা করা হলো। তাবে তোমাদের সূলধন তোমাদেরই। তোমরা কারো প্রতি অত্যাচার করোনা ও অত্যাচারিত হয়োনা। আল্লাহর বিধানে সুদ বাতিল এবং আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিবের জন্য যে সমস্ত সুদ পাওনা আছে সবই বাতিল করা হল। জাহেলী যুগের রক্তপাত, খুনের ক্ষতিপূরণ বাতিল করা হলো।
ব্যক্তিগত কর্মের জবাবদিহিতা অপরিহার্য : একজনের অন্যায় ও অপরাধ কর্মের জন্য অন্যজনকে দন্ডিত করা যাবেনা। পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা যাবেনা। যোগ্যতার বিচারে আনুগত্য করবে। নবীজি এরশাদ করেছেন, যদি কোনো নাক কাটা হাবশী ক্রীতদাসকেও তার যোগ্যতার নিরিখে তোমাদের আমীর নিযুক্ত করা হয়, তোমরা সর্বোতভাবে তার আনুগত্য করবে এবং তার আদেশ মান্য করবে।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ়করণ : সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এক অবিচ্ছেদ্য ভাতৃসমাজ। এরশাদ হয়েছে, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। একে অপরকে না অত্যাচার করবে না অপদস্ত করবে না তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তাকওয়া, খোদাভীতি এখানেই (এই বলে রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় বক্ষ মোবারকের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করেন) কোন মুসলমানের অনিষ্টতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার কোন মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের রক্ত সম্পদ ও সম্ভ্রম সম্মান বিনষ্ট করা হারাম। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং: ২৫৬০)
হে লোক সকল! তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার আছে আর তাদের উপর তোমাদের অধিকার আছে। তাদের সঙ্গে সদাচরণ করবে, তাদের প্রতি দয়াদ্র থাকবে, কারণ তারা তোমাদের সকল কাজে সাহায্যকারিনী।
কুরআন সুন্নাহ আকড়িয়ে ধরো : হে মানব মন্ডলী! গভীর ভাবে আমার বাণী অনুধাবণ কর, আমি তোমাদের জন্য দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ যদি তোমরা তা আঁকড়িয়ে ধর তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবেনা। হে মানবজাতি! আমি সর্বশেষনবী। আমার পর কোন নবী বা রাসূল আগমন করবে না। আমার পর নতুন কোন ধর্মমতও নেই। (সংক্ষেপিত)
তোমরা আমার বাণীগুলো অন্যদের নিকট পৌছাবে, তিনি সাহাবাদের জনসমূদ্রে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি কি আল্লাহর বাণী তোমাদের নিকট পৌছে দিতে পেরেছি? সকলে সম্মিলিত কান্ঠে বললেন নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর বাণী পৌছিয়েছেন। নবীজি আল্লাহর আরশের দিকে দেখে বললেন হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। তুমি সাক্ষী থাক। নবীজির ভাষণ শেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামের পূর্ণতা ও দ্বীনের উপর আল্লাহর সন্তুষ্ঠির স্বীকৃতির বার্তা বিঘোষিত হলো। ওহী নাযিল হলো “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করলাম, আর তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করে দিলাম। এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা: মায়িদা, ৫:৩)
মহানবীর বিদায় হজ্বের ভাষনের গুরুত্ব অসামান্য অভাবনীয়। জীবন চলার পথে এ ভাষণ মুসলিম উম্মাহর জন্য অনবদ্য আলোকবর্তিকা। (আস-সিরাতুন নাববিয়্যাহ লি ইবনি হিশাম ৪/৪৬৬-৪৬৭, সহিহ মুসলিম, সুনানু আবি দাউদ, ইবনি মাজাহ, কিতাবুল হজ্ব)। হে আল্লাহ বিদায় হজ্বের ভাষণের আলোকে আমাদের জীবন আলোকিত করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন
রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি, পার্বত্যজেলা।
প্রশ্ন: জুম’আর দু’রাকা‘আত ফরজ নামাযের আগে ও পরে সুন্নাত নামায পড়ার প্রমাণ হাদীস শরীফে আছে কিনা? জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: জুম’আর নামাযের দু’রাকাত ফরজের পূর্বে ও পরে সুন্নাত নামায পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে ফিক্হ শাস্ত্রের কিতাব সমূহেও এ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (র.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম’আর নামায আদায় করতেন। (তাবরানী মু’জামুল আওসাত হাদীস: ৩৯৫৯)
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত আবদুর রহমান সুলামী (র.) বলেন, সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) জুম’আর পূর্বে ও পরে চার রাকাত পড়ার জন্য আমাদেরকে আদেশ করতেন। (ইমাম আবদুর রাজ্জাক, আল মুসান্নাফ, হাদীস : ৫৫২৫, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার ১ম খন্ড, পৃ: ৩০২)
জুম’আর পূর্বে চার রাকা’আত সুন্নাত মুআক্কাদাহ, জুম’আর সালাতের পর চার কারা’আত পড়বে অত:পর দু-রাকা’আত যেন উভয় হাদীসের উপর আমল করা হয়। (গুনীয়া, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড)
হযরত আলী (রা.) বলেন, যদি কেউ জুম’আর পর সালাত আদায় করে তবে সে যেন ছয় রাকাআত সুন্নাত আদায় করে। (তাহাবী শরীফ)। স্পষ্ট অভিমত হচ্ছে জুমআর পর চার রাকা’আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ, সতর্কতা মূলক মত হচ্ছে ছয় রাকাআত। (দুররে মুখতার, ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ, ৩য় খণ্ড, পৃ: ৬৯৩)