জাপানে বন্দুক সহিংসতা যেখানে খুবই বিরল, সেই দেশেই গুলিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নিহত হওয়ার ঘটনায় শোকাহত গোটা জাতি। এই হত্যার প্রেক্ষাপটে জাপানের অস্ত্র আইন কিংবা অস্ত্র রাখার নিয়মবিধি কেমন, আর আবেকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটিই বা কী ধরনের- তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে বিবিসি।
আবেকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি কি ছিল : জাপানের সমপ্রচারমাধ্যম এনএইচকে এবং স্যোশাল মিডিয়ায় এই অস্ত্রের ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, তারা এক ব্যক্তিকে বড় একটি বন্দুক বহন করতে দেখেছে। আবের সরাসরি পেছনে তাকে লক্ষ্য করে প্রায় ১০ ফুট দূর থেকে ওই ব্যক্তি দু’বার গুলি ছুড়েছে। ছবিতে অস্ত্রটি কালো টেপ দিয়ে মোড়ানো দেখা গেছে। দুটো ব্যারেল খুব সম্ভবত অ্যালুমিনিয়ামের এবং কাঠের ভিত দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। কাঠের বোর্ডে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ধাতব ব্যারেলগুলো। বাড়িতে তৈরি মৌলিক কিছু ডিভাইস দিয়ে বানানো এ অস্ত্রে কোনও লোডিং ব্যবস্থা নেই কিংবা প্রচলিত অস্ত্রের মতো হাতলও নেই বলে মনে হয়েছে। যে গুলি ছোড়া হয়েছে তা সম্ভবত আগে থেকেই ভরা ছিল এবং পরপর খুব দ্রুত প্রায় তিন সেকেন্ডের ব্যবধানে গুলি ছোড়া হয়। খবর বিডিনিউজের।
তাই ছবিতে যেমনটি দেখা গেছে সে সবকিছু বিবেচনায় এমনটিই বোঝা যাচ্ছে যে, ওই অস্ত্র এবং গুলি সবই বাড়িতে বানানো। পুলিশও বলেছে, হামলাকারী তাদেরকে বলেছেন যে, তিনিই অস্ত্রটি বানিয়েছেন। আবেকে হত্যায় যে অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, সেরকমই আরও কিছু অস্ত্র সন্দেহভাজন হামলাকারীর বাড়ি তল্লাশি করে পেয়েছে পুলিশ।
বন্দুকের মালিকানা পেতে জাপানের নিয়মকানুন কি : জাপানের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন খুবই কঠোর। আগ্নেয়াস্ত্র খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কঠোর সব আইন দশকের পর দশক ধরেই আছে দেশটিতে। ১৯৫৮ সাল থেকে চলে আসা জাপানের আদি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র এবং তলোয়ার রাখা নিষিদ্ধ। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭ ভুক্ত জাপানে জনসংখ্যার মাথাপিছু হিসাবে ব্যক্তিগত বন্দুক মালিকের সংখ্যা খুবই কম। প্রতি ১০০ জনে মাত্র ০ দশমিক ৩ জন। জাপানে হাতবন্দুক রাখা একেবারেই নিষিদ্ধ। তবে শিকারের জন্য অস্ত্র পাওয়া সম্ভব। দেশটিতে অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়। অস্ত্রের লাইসেন্স কেউ পেতে চাইলে তাকে মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা এবং মাদকের পরীক্ষা দিতে হয়। সেইসঙ্গে ব্যাপকভাবে খতিয়ে দেখা হয় তার অতীত কর্মকাণ্ড। ক্রেতা আগে কোনও অপরাধে জড়িত ছিলেন কিনা বা সংঘববদ্ধ কোনও অপরাধে জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়। উপরন্তু ক্রেতাকে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং লিখিত পরীক্ষাতেও পাস করতে হয়। পাস নম্বর কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ। অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার পর এর মালিককে অস্ত্র ও গুলি কোথায় রাখা হবে তা পুলিশকে জানাতে হয়। আলাদাভাবে তালাবদ্ধ স্থানে রাখতে হয় এ অস্ত্র। প্রতিবছর অন্তত একবার পুলিশ এই অস্ত্র পরিদর্শন করে। প্রতি তিন বছর পর অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। আর এর জন্য অস্ত্র মালিককে আবারও প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং পরীক্ষায় বসতে হয়।
অন্য দেশ এবং জাপানে বন্দুক সহিংসতার তুলনামূলক চিত্র : অস্ত্র মালিকানা নিয়ে কঠোর নিয়মনীতির কারণে জাপানে বন্দুক সহিংসতা খুবই কম। জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জাপানেই বন্দুক সহিংসতায় মত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে কম। এই সংখ্যা মাথাপিছু হিসাবে প্রতি এক লাখ মানুষে মাত্র ০.০৩ শতাংশ। যুক্তরাজ্য এবং জার্মানিতে বন্দুক সহিংসতায় মৃত্যুর তুলনায় এ সংখ্যা কম এবং যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় আরও অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখে ৭ জন বন্দুক সহিংসতায় মারা যায়। বছরের পর বছর দেশটিতে অস্ত্র আইন আরও কঠোর করতে আইন সংশোধন করা হয়ে আসছে। জাপানে বন্দুক সহিংসতা বিরল হলেও রাজনীতিবিদদের ওপর হামলার ঘটনা দেশটিতে এর আগেও ঘটেছে। ২০০৭ সালে নাগাসাকির মেয়র গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। সংঘবদ্ধ একটি অপরাধ চক্র তাকে হত্যা করেছে বলে দোষারোপ করা হয়। গুলি করে হত্যা ছাড়াও রাজনীতিবিদদের ছুরি মারার ঘটনাও জাপানে অতীতে ঘটেছে।