রঞ্জনার ভ্রমণ ও গল্প

আবু মুসা চৌধুরী | শুক্রবার , ৮ জুলাই, ২০২২ at ৯:৩২ পূর্বাহ্ণ

চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে বৈপরীত্য-দূরত্ব দুস্তর। একটি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর, অন্যটির ভরকেন্দ্রে রয়েছে নান্দনিকবোধ ও বোধি এবং কল্পলোক। তবুও বিশ্বসাহিত্য বা বাংলা সাহিত্যে চিকিৎসাজীবীদের সাহিত্যসৃজন দৃষ্ট। মহান রুশ লেখক আন্তন চেখভ বা ইংরেজি সাহিত্যের সমারসেট মম, স্যার আর্থার ডয়েল এবং বাংলা সাহিত্যে বনফুল, ভূমেন্দ্র গুহ, শাহাদুজ্জামান, মামুন হুসাইন, জাকির তালুকদার প্রমুখের চিকিৎসক পদবী গৌণ হয়ে গেছে সাহিত্যকর্মের তুল্যমূল্য বিচার ও মানদণ্ডে।
অঞ্জনা দত্ত একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক। অ্যাকাডেমিক পাঠ নিয়েছেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। জীবনের পরিণত লগ্নে এসে, অবসর জীবনে লেখালেখি তার প্যাশন। দেশভ্রমণ তার ব্যসন বলা যায়। স্বামী প্রদীপ কুমার দত্তের সহযোগে ইতোমধ্যে তিনি পরিভ্রমণ করেছেন পেরু, মেক্সিকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পূর্ব আফ্রিকা, ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় বেশ কিছু দ্বীপরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, ভারত ইত্যাদি দেশ। এই ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি গ্রন্থিত করেছেন। ইতোমধ্যে তার ওই দেশ-দুনিয়া দেখার পাঁচালী নিয়ে বেরিয়েছে দুটি গ্রন্থ। একটি হলো ‘যাযাবরের কড়চা’- প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে কলকাতা থেকে। অন্যটি ‘নীলনদের উৎসমুখে।’ ডা. অঞ্জনা দত্তের ‘রঞ্জনার অসমাপ্ত গল্প’ শীর্ষক একটি উপন্যাস বেরিয়েছে এ বছরের গ্রন্থমেলায়। তাঁর শেষের দু’টো নিয়ে এই আলোকপাত।
নীলনদের উৎসমুখে
ভ্রমণকাহিনি বা ট্রাভেলগ সাহিত্যের আদি মাধ্যম। কেননা ইবনে বতুতা বা মার্কো পোলোর পৃথিবী পরিক্রমার বয়ান সাহিত্য-গুণান্বিত। ভ্রমণসাহিত্যেরও পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ কেবল জর্নাল নয়, দার্শনিক মূল্যমানেও সমৃদ্ধ। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’ বা ‘জাপানে’ও ক্লাসিক হিসেবে উত্তীর্ণ। আমাদের দেশে হাসনাত আবদুল হাই-এর ট্রাভেলগ, হালের মঈনুস সুলতান, ফারুক মঈনুদ্দীনের সরস রচনা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য। সেই নিরিখে অঞ্জনা দত্তের ‘নীল নদের দেশে’ ভ্রমণকাহিনিটিও বিশিষ্টতার দাবী রাখে। দেশবরেণ্য প্রাজ্ঞ চিন্তক ড. অনুপম সেন-এর এই গ্রন্থ সম্পর্কে আশীর্বাণী প্রণিধানযোগ্য। তাঁর অভিমত : ‘নানা অসাধারণ বর্ণনায় সমৃদ্ধ। পাঠক গ্রন্থটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারবেন। ঘরে বসে যারা বিভিন্ন দেশের বর্ণনা পড়ে মনের অপার কৌতূহল ও সন্ধিৎসা মেটাতে চান, তারা এই বই পড়ে তা পাবেন।’ কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ভ্রামাণিক রচনার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি সুবিখ্যাত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ এর রচয়িতা উল্লেখ করেছেন- শংকর। কিন্তু পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই- ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ লিখেছেন অবধূত। অসাবধানতার কারণেই বোধ হয় এই তথ্যবিভ্রাট।
নিতান্ত আটপৌরে ও সরস বর্ণনায় অঞ্জনা দত্ত পূর্ব আফ্রিকা ভ্রমণের প্রাঞ্জল ছবি উপস্থাপন করেছেন। এ যাত্রায় তিনি কেনিয়া, উগান্ডা এবং রুয়ান্ডা সফর করেছেন। এই পরিভ্রমণ তিনি গ্রথিত করেছেন সরস ও প্রাঞ্জল গদ্যে। শারীরিক ক্লেশ অগ্রাহ্য করে স্বামীর সহযোগিতায় জীবনরসিকের উপলব্ধিজাত পর্যবেক্ষণে তার এই দেশ দর্শন কেবল বিশেষ দর্শনীয় ল্যান্ডস্কেপ-এর সান্নিধ্য লাভ নয়। তিনি অন্ধকার মহাদেশ খ্যাত আফ্রিকার জন-জীবন, ইতিহাস, ভূ-পরিচিতি, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘাত ইত্যাকার বিষয়ও উপস্থাপন করেছেন অন্তর্বীক্ষণে।
আফ্রিকা মানে আমাদের কাছে এক গূঢ় বিস্ময়ের নাম। ছেলেবেলায় পড়া বিভূতিভূষণের অমর ক্লাসিক ‘চাঁদের পাহাড়’ এর সিংহের পিলে চমকানো গর্জন আমরা যেনো এখনো শুনতে পাই। সেই পশুরাজের সান্নিধ্য পাই ম্যাসাইমারা’র অভয়ারাণ্যে অঞ্জনা দত্তের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায়। আমাদের অনায়াস ভ্রমণ সম্পন্ন হয় নীল নদ এর উৎসমুখ পর্যবেক্ষণে। ড. অনুপম সেন এর ভাষ্য- ‘এখানে সিংহ, চিতাবাঘ, জেব্রা ইত্যাদির প্রকৃতির মধ্যে বিচরণ দেখে শিহরিত হয়েছেন। সেই শিহরণের বর্ণনা পড়ে, পাঠকও শিহরিত হবেন। তিনি এই গ্রন্থে বিষুবরেখা ঘোরার বর্ণনাও দিয়েছেন, একটি গ্লাসে জলে রাখা ফুল বিষুবরেখার উত্তরপ্রান্তে ঘূর্ণি তোলে একভাবে, দক্ষিণ গোলার্ধে ঘোরে উল্টোভাবে, বিষুবরেখায় ঘোরেই না।’
সুলেখক অঞ্জনা দত্ত দৃশ্যপট বর্ণনা করে ক্ষান্ত হননি, তিনি যাত্রার আয়োজন, পথ-পরিক্রমার বর্ণনা, ব্যক্তি অনুভূতি, সম্পর্কের রসায়ন ইত্যাকার প্রসঙ্গও অবতারণা করেছেন। এ-কারণে পাঠকের সঙ্গে রচয়িতার নৈকট্য-যোগাযোগ ও আন্তঃসম্পর্ক ঘনীভূত হয়। আর এ বিষয়টি একজন ট্রাভেলগ লিখিয়ের রচনাশৈলীর সদর্থক গুণাবলী। তার পরবর্তী গ্রন্থে নিশ্চয়ই আমরা অন্য ভূমণ্ডলের মুখোমুখি হবো।
রঞ্জনার অসমাপ্ত গল্প
‘রঞ্জনার অসমাপ্ত গল্প’ ডা. অঞ্জনা দত্তের উপন্যাস। এই গ্রন্থে তিনি একটি ব্যর্থ প্রেমের আখ্যান রচনা করেছেন। কাহিনি এরকম- রঞ্জনা নামক এক চিকিৎসক তারুণ্যের প্রেমের ব্যর্থতায় নিঃসঙ্গ একাকী জীবন বেছে নেন। পরবর্তীতে জীবনের পথ-পরিক্রমায় তার অতীতের প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারপর ঘটনার ঘনঘটা। নিতান্তই সাদামাটা ট্রাজিক এবং সিনেমাটিক। প্লট একরৈখিক। সুলেখক বাদল সৈয়দের মূল্যায়ন এরকম- ‘অঞ্জনা দত্তের গদ্য আমার সবসময় পছন্দের কারণ তাতে গতি আছে। স্রোতহীন নদী আমার পছন্দ নয়, তেমন গতিহীন নদীও নয়। লেখিকা ‘অঞ্জনার অসমাপ্ত গল্প’-এ তার গদ্য লেখার মুন্সিয়ানা আবার ফুটিয়ে তুলেছেন। এর পাশাপাশি আছে কাহিনি বিন্যাসে তার দক্ষতা।’
তপোধীর ভট্টাচার্যের অভিমত : ‘জীবনের বেদনাসিন্ধু মন্থন করে আমাদের কাছে অঞ্জনা নিয়ে এসেছেন ‘রঞ্জনার অসমাপ্ত গল্প’- যাতে চিকিৎসক ও কথাকারের মনিকাঞ্চন সংযোগ ব্যক্ত হয়েছে বিরল দক্ষতায়।’
মনস্বী লেখক মাহবুবুল হকের ব্যাখ্যা ‘এ উপন্যাসে জীবনে অবলোকন করেছেন বাস্তবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে। নাটকীয় ঘটনাধারায় কাহিনি নির্মাণ করে লেখিকা এই সত্য নিরূপণ করেছেন যে, মানুষের জীবন এগিয়ে চলে জটিল ঘটনাবর্তের ভেতর দিয়ে, সরলরেখায় নয়।’
ডা. অঞ্জনা দত্তের ভাষ্য কাব্যময়। অলঙ্কারশোভিত। একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যাক- ‘একটা শান্ত নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন অনেকখানি জল ছলকে ওঠে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে একটা বৃত্তের সৃষ্টি করে, রঞ্জনার জীবনেও রাহুল যেন তেমন একটা বৃত্ত তৈরি করে দিয়েছে।’
জমজমাট গল্প, গতিশীল গদ্য, মানব-মানবীয় হৃদয়বৃত্তির রহস্য, ক্লাইমেক্স সর্বোপরি চরিত্র-চিত্রণ এবং লেখিকার আন্তরিকতা এই উপন্যাস ‘রঞ্জনার অসমাপ্ত গল্প’র প্রাণসম্পদ। আশা করা যায় গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয় হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসীমালঙ্ঘন
পরবর্তী নিবন্ধলাল পিঁপড়া