সাবাস বাংলাদেশ- পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | শুক্রবার , ৮ জুলাই, ২০২২ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

শেখ হাসিনার পদ্মা জয়
…সাবাস বাংলাদেশ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’- কিশোর কবি সুকান্তের এই স্মরণীয় কবিতার পঙ্‌ক্তি আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কর্মকৃতিতে বাস্তব হিসেবে প্রতিফলিত। শেখ হাসিনার পদ্মা জয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। পদ্মা সেতু আজ বাংলাদেশের অগ্রগতি আত্মপ্রত্যয় ও ভাবমূর্তির প্রতীক। বাংলাদেশের গৌরবগাথা, শেখ হাসিনার অনন্য কৃতিত্ব। বাংলা-বাঙালি তথা শেখ হাসিনার বিজয়মাল্যের মতো দেদীপ্যমান আজ প্রমত্তা পদ্মার বুকে পদ্মা সেতু। এই স্থাপনা নিছক কোনো অবকাঠামো নয়, এ যেন বাঙালির বিজয়ের সারথী, গৌরবের স্মারক, সামর্থ্যের শীর্ষবিন্দু। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরে এতো বড়ো অর্জন, আনন্দ-উৎসব বাঙালির জীবনে আর আসেনি। হাজার বাধা, ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে পদ্মা সেতু যেন শেখ হাসিনার বিজয় ফলক।
মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর, যে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যায়িত করেছিলো, সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র।’ এছাড়া সারা বিশ্ব থেকে অভিনন্দনের বন্যায় অভিষিক্ত বাংলাদেশের এই অর্জন। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে দুর্নীতির মনগড়া-কাল্পনিক অভিযোগে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলো, সেই বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য নিয়োজিত বিশ্বব্যাংক প্রধান মার্সি মিয়াং এর মন্তব্য : ‘সেতুটি বাজার সম্প্রসারণ ও দারিদ্র্য হ্রাস করে দেশের মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করবে।’
স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির জন্য এক বিশাল অর্জন। এক মহাবিজয়। এই সেতু- যোগাযোগের কারণে দ্বিখণ্ডিত দেশকে একসূত্রে গেঁথেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই সত্যে উপনীত হওয়া যায় যে, দেশ আজ উন্নয়নের মহাযজ্ঞে সামিল হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।’
যেহেতু বিশ্বায়নের বাস্তবতায়ও ‘কানেকটিভিটি’ হলো উন্নয়নের অন্যতম মৌলিক সূচক, তাই পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ যোগাযোগের মহাসড়কে প্রবেশ করলো। এই সেতু বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। হবে শিল্পায়ন। বাড়বে ইকো-ট্যুরিজম। মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে। কর্মসংস্থান হবে প্রচুর। বেকারত্ব লাঘব হবে। দেশে দারিদ্রের হার কমাবে। পক্ষান্তরে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু মাল্টিপারপাস। সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, রেল সংযোগের সঙ্গে অত্যাধুনিক ওয়াইফাই সুবিধাও থাকবে। এক অর্থে বলা যায়, পদ্মা সেতু হলো বাংলাদেশের লাইফ লাইন। এই সেতু কেবল রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগ সৃষ্টি করবে তা নয়, বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। এই যোগাযোগের মহাসড়কে প্রবেশের ফলশ্রুতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান- সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের জিডিপিতে ২% অবদান রাখবে এই সেতু। অবহেলিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন-মান উন্নয়ন করবে।
বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশের মানুষের চলাচলের পথ সুগম হলো। সময় সাশ্রয় হবে তিন ঘণ্টার মতো। দূরত্ব কমলো ৭০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। সরাসরি উপকৃত হবে তিন কোটির বেশি মানুষ। দারিদ্র্য কমবে এক দশমিক নয় শতাংশ হারে। এই পদ্মা সেতুকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। প্রত্যক্ষভাবে ২১টি জেলা পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ সুবিধা পেলেও, কার্যত পুরো দেশেই এর প্রভাব পড়বে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতসহ যোগাযোগে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো সুবিধা পাবে।
শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের সোনালি ফসল পদ্মা সেতু। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা আজ উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে দিচ্ছেন তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর জীবন। তাই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।
২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তী আট বছর এই প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি হয়নি ক্ষমতার পালাবদলের কারণে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মূল সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। ২০২২ সালের ২৫ জুন ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান সম্বলিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন হলো। বাংলাদেশ প্রবেশ করলো উন্নয়নের মহাসড়কে।
এই দীর্ঘ পথযাত্রা কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। নানা রটনা, অপবাদ, ষড়যন্ত্র এই যাত্রাপথ রুদ্ধ করার অপচেষ্টা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থ যোগান থেকে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্বে, অনমনীয় মনোভাব দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এবং নিজস্ব সামর্থে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করলেন। তিনি বিশ্বের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিলেন যে, ‘আমরাও পারি।’ তার এই দৃঢ় মনোবল এবং অটুট আস্থার ফসল পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মর্যাদা এক অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। যা পুরো দেশ, পুরো জাতির জন্যেই গৌরবের সমাচার। আর এর একক কৃতিত্বের অংশীদার গণতন্ত্রের ও গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ হাসিনা।
বর্তমান সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যে কেবল অবকাঠামো নয়, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, জমি ও ঘর প্রদান, বিবিধ ভাতা ও পেনশন চালুসহ আরো কল্যাণমুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রবাহমান উন্নয়নে নিশ্চয়ই ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে সামিল হবে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু এক অর্থে বলা যায় আওয়ামী লীগেরই অর্জন। তাই আশা করা যায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য, দেশ ও জাতির কাণ্ডারী আওয়ামী লীগকেই বাংলার জনগণ বেছে নেবে। উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর জন্যে প্রয়োজন সুশাসন ও স্থিতিশীলতা। তাই উন্নয়নের অভিযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়ায় এখন এই মুহূর্তে এই দেশের জন্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অতিমারি কোভিড মোকাবেলায় বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা বিশ্বের আছে প্রশংসিত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সমগ্র বিশ্বে যে অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনীতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আগাম বন্যা যে ক্ষতি সাধন করেছে তা কৌশলী নেতৃত্বে কাটিয়ে ওঠে বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। তাই সামগ্রিক বিচারে কেবল ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, শেখ হাসিনার ভিশন-৪১ বা উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন, প্রত্যয় ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক; সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধমাইজভাণ্ডারী গাউছিয়া কমিটি কেন্দ্রীয় পরিষদের সভা