আমি নিজেকে এখন আর সমকালের মানুষ হিসাবে ভাবতে পারি না। আমাদের পরের আরও কয়েকটি প্রজন্ম সমানে দাবিয়ে বেড়াচ্ছে এখন। একদা আমরা যেমন ছুটে বেরিয়ে ছিলাম। আমাদের যেমন করে হৈ-হুল্লোড় করে গ্রাম-শহরকে মাথায় তুলে নাচিয়েছি। এমনটি কিন্তু এখন আর দেখি না। গ্রামের কথা নাইবা বললাম। অনেক আগেই কেউ একজন বলেছিলেন, ‘গ্রাম পতনের খবর শুনিতে কি পাও?’ তখন পাইনি। এখন পাই। এখন আর বর্তমানকে দেখার সাধ জাগে না মনে। ভবিষ্যতকেও না। মন বার বার ফিরে যেতে চাই অতীতে। ভিন্নমতের মানুষেরা ভিন্ন কথা বলবেন। মনের উপর কি আর জোর খাটানো যায়? গ্রহণ-বর্জনের বিচারেও যেতে চাই না। মহাকালের রথে চড়তেও মন চায় না। মন চায় শুধু দূর থেকে দেখতে। তাতে হিসাব মেলানোর দায় থাকে না। জানি, হিসাব মেলানো যায় না। সন্তানের মুখে প্রায়শ শোনার পরও নিজেকে সেকালে ভাবতে বড্ড আঁতে লাগে।
আমি না চড়লে কী হবে? রথের চাকা কি আর থেমে আছে? তা না হলে কি আর রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে লিখতেন-‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?/ তব রথ নিত্যই উধাও।’ কালের এই যাত্রার ধ্বনি শুনতে গিয়ে মনে হয়, কেউই আমরা ঠিক জায়গাটিতে নেই। আমরা যেন যে যার আপাত স্বস্থানে অত্যন্ত বেমানান। যার যেখানে থাকার কথা নয়, সে যেন ঠিক সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী বিষয়টি উপলব্ধিতে এনে লিখেছিলেন, ‘হেথাকে তুকে মানাইছে নাই গ’/ইক্কেবারেই মানাইছে নাই/অ-তুই লালপাহাড়ীর দেশে যা…’। কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী এই বেমানানের কথা লিখেছিলেন। তিনি একদিন দেখলেন একটি মহুয়া গাছ শ্রীরামপুর স্টেশনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। স্টেশনের মতো একটি ব্যস্ততম জায়গায় গাছটিকে তাঁর বেমানান লাগছিল। এর লালপাহাড়ির দেশে থাকা উচিত। এরকম একটা অবস্থায়ই তিনি লিখলেন ‘শ্রীরামপুর ইস্টিশনে মহুয়া গাছটা’ নামের কবিতাটি।
একটা সময় তো ছিল, যার যেখানে থাকার কথা সেখানেই ছিলেন। আমাদের সমকালেই ছিলেন। তখনও মারামারি-হাতাহাতি ছিল। দু-একটা খুনাখুনিও ছিল। দল ভাঙাভাঙি, মন ভাঙাভাঙিও হয়েছে। তারপরও যার যেখানে থাকার কথা নয়, সে যেন ঠিক সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল না। যোগ্যরা যোগ্যতম স্থানে ছিলেন। সে সব মানুষেরা অনেকেই আজ সাইড লাইনে বসে খেলা দেখছেন। মহাকালের খেলা।
স্যোসাল মিডিয়ায় কবি মিনার মনসুরেব ছবিসহ একটি স্ট্যাটাস দেখে আমাদের সমকালের পরিবর্তনের একটি ছবি আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন-‘সদ্য বিবাহিত কবি নির্মলেন্দু গুণ সস্ত্রীক চট্টগ্রাম সফরে গিয়েছিলেন আশির দশকের শুরুতে। ছিলেন বেশ কিছুদিন। চট্টগ্রামের তরুণ কবি ও সংস্কৃতি কর্মীদের জন্যে সেটা ছিল উৎসবের কাল। নির্মলদার সঙ্গসুধা বা সান্নিধ্যের সম্মোহন কী দুর্বার ছিল আমাদের কাছে তা আজ আর বলে বোঝানো যাবে না। জেলা আওয়ামী লীগের ডাকসাইটের নেতা ছালেহ ভাইয়ের মোমিন রোডের বাসায় সেরকমই এক আড্ডায় মধ্যমণি হয়ে আছেন নির্মলেন্দু গুণ। তাঁকে ঘিরে চট্টগ্রামের তরুণ তুর্কিদের ভিড়। কে নেই সেখানে–স্বপন দত্ত, শিশির দত্ত, কমল সেনগুপ্ত, আবসার হাবীব, খালিদ আহসান, মিনার মনসুর, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, দিলওয়ার চৌধুরী…’।
জননেতা আবু ছালেহ-এর জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলায়। অনেকে নিজের প্রাপ্য সম্মান, সম্মানি, পুরস্কার আদায় করে নিতে পেরেছেন। অভিমানী ছালেহ ভাই পারেননি। তিনি কিছুই পাননি, চানওনি। আজ আমাদের কালের গণনায়ক জননেতা আবু ছালেহ অনেকের মতো সাইড লাইনে বসে খেলা দেখছেন। মহাকালের খেলা।
আজকের দিনে ভাবা যায়, ডাকসাইটের কোনো জননেতার বাসাতেই একজন কবিকে ঘিরে চট্টগ্রামের তরুণ তুর্কি কবিরা আড্ডায় মেতে উঠেছেন! আবু ছালেহ ভাই খুবই রাশভারি ধরনের মানুষ হলেও শিক্ষিত সজ্জন ছিলেন। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। কিন্তু যা বলতেন, তা আমাদের কাছে অবশ্যই পালনীয় নির্দেশ মনে হতো। কারণ তাঁরা ছিলেন আমাদের কালের গণনায়ক।
আবু ছালেহ ভাই ছিলেন আপাদমস্তক মুজিব আর্দশের সৈনিক। দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী বিএলএফের কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে এই বর্ণাঢ্য জীবনের জন্য অহংকার ছিল না। তাঁকে দেখে মনে হতো না তিনি ছিলেন সেই ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে, তাঁর বক্তৃতা শুনলে তাঁর সেই প্রাজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যেত। অনলবর্ষী বক্তা বলতে যা বুঝায়, আবু ছালেহ ভাই তাই ছিলেন। সব সময় ভারী গলায় কথা বলতেন তিনি। বড্ড রাশভারি লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁর এই গাম্ভীর্যের ভেতরে একটা সরলতা লুকিয়ে ছিল। এটা তাঁর সঙ্গে গভীরভাবে না মিশলে বুঝা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে জেল খেটেছেন। মন্ত্রী, এম.পি. হবার লোভ তাঁর মধ্যে দেখিনি। কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ারও সাধ জাগেনি। এসব প্রতিযোগিতাকে তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তান পরিচয়ে গর্ববোধ করতেন।
একবার পটিয়া ক্লাবে (আজকের ভবনটি তখনও হয়নি) চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ (বাকশাল)-এর সম্মেলন অনু্ষ্িঠত হচ্ছে। সম্মেলনে আগত ডেলিগেটদের জন্য দুপুরে আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। নিয়ম ছিল প্রত্যেক থানা কমিটি থেকে সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক এসে কুপন ক্রয় করে নিজ নিজ থানার ডেলিগেটদের মধ্যে বিতরণ করবেন। সম্মেলন স্থল পটিয়া ক্লাবে একটি দপ্তর খোলা হয়। ছালেহ ভাইয়ের নির্দেশে আমাকে এ দপ্তরে কুপন বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার উপর তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল কাউকে বিনা টাকায় কুপন দেওয়া যাবে না। কুপনের দাম ছিল দশ টাকা। আমি বিনা টাকায় কুপন না দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। তারপরও দু’একজন যে বিনা টাকায় নেয়নি, এমনটি বলা যাবে না। সম্মেলন শেষ করে ছালেহ ভাই দপ্তরে আসেন। আমাকে বললেন, কত টাকা পেলে? আমি হেসে খামের ভেতর থেকে টাকাগুলো বের করে তাঁর দিকে এগিয়ে দিই। ছালেহ ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন মাহফুজুর রহমান মেরু ভাই। মেরু ভাই আমাদের সমকালের আরেকজন ত্যাগী ছাত্রনেতা। ভালো বক্তৃতা করতেন। সব সময় গলা ভাঙা থাকত। তাঁর ভাঙা গলার বক্তৃতা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তাঁকেও পরবর্তীকালে মহাকালের খেলায় সাইড লাইনে চলে যেতে হয়েছে। মেরু ভাই হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিয়ে বললেন, এ টাকায় ছালেহ ভাইয়ের কি হবে? টাকাগুলো গুণে খুচরা কিছু আমাকে দিয়ে ছালেহ ভাইকে বললেন, চলেন যায়। ছালেহ ভাই তখন বললেন, সে সারাদিন টাকা কালেকশন করল, পাহারা দিল। শেষ পর্যন্ত তুমিই নিয়ে যাবে সব। মেরু ভাই বললেন, ও পান-সিগারেট খায় না। গাড়ি ভাড়া হলে চলবে।
আমাদের সময়ে যেকোনো কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে লিফলেট ছাপাতো। এখন তেমন চোখে পড়ে না। ছালেহ ভাইকে না দেখিয়ে কোনো লিফলেট ছাপাতে পারিনি। তিনি লিফলেটের খসড়া পড়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী দিয়ে তারপর ছাপতে পাঠাতেন। অন্যদের কথা জানি না, আমাকে এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এজন্য অনেকবার যেতে হয়েছে, তাঁর মোমিন রোডের বাসায় এবং কর্মস্থলের সেই কাঁচঘেরা রুমে। ছালেহ ভাইয়ের নির্দেশনা নিয়ে আমরা চলে যেতাম মোমিন রোডের সুলেখা প্রেসে। দক্ষিণ জেলা বাকশালের সবকিছু সুলেখা প্রেসে থেকে ছাপা হতো। ওটাকে আমরা বলতাম, ছালেহ ভাইয়ের প্রেস। পরে শুনেছি ওটা তাঁর কোনো সুহৃদের প্রেস, তার মালিকের নামও একই। কোনোদিন এক টাকাও পরিশোধ করিনি। প্রেস মালিক দাবিও করেননি।
ছালেহ ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অপরিসীম ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছি। অনেকবার বলতে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়া। এজন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নেই আমরা যারা তাঁর আদর্শের সন্তান বলে দাবি করি, তাদের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কার্যক্রম বাস্তবায়িত করা। এ বলে তিনি শেষ করতেন না। এও আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, আমরা বঙ্গবন্ধুর কথা বললেও তাঁর প্রদর্শিত পথ সঠিকভাবে অনুসরণ করছি না।
ছালেহ ভাইয়ের কর্মস্থল ছিল ইউনাটেট কর্মাশিয়াল ব্যাংক। এখানে তিনি ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে চাকরি করতেন। এর আগে তিনি সিটি ব্যাংকে ছিলেন। ইউনাইটেট কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান অংশীদার ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সময়ের সভাপতি জননেতা আকতারুজ্জামান বাবু। ছালেহ ভাই সে কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আশির দশকে জননেতা আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বাংলাদেশ কৃষক, শ্রমিক আওয়ামীলীগ গঠন করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি হলেন। চাকরি ক্ষেত্রে ছালেহ ভাই কত বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিলেন আজ তা ভাবতেও বিস্ময় জাগে। তবে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন পাঠ করলে দেখব, ছালেহ ভাই ষাট কিংবা সত্তরের দশকে এর চাইতেও বেশি ঝুঁকি নিয়ে দেশের কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে বাবু ভাইয়ের উদারতাকেও ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। তিনি ছালেহ ভাইয়ের এই মতার্দশিক ভিন্নতাকে সম্মান দেখিয়েছেন, তাঁকে কর্মচ্যুত করেননি। এটা বাবু ভাইয়ের মহানুভবতা, যা কিনা আজকের দিনে বিরল।
একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে আবু ছালেহ রাজনীতি করেছেন। এ শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। ১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতিলগ্নে বঙ্গবন্ধু আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানির পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্ত মানুষের নাড়ি এক সুতোয় বাঁধা ছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি। আজকের দিনে এমন কাউকে কি আর পাওয়া যাবে? ড্রয়িং রুমের ছবি দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
ছালেহ ভাই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি প্রশ্নে কতটুকু আপোষহীন ছিলেন, তাঁর এই দৃঢ়তা কতটুকু সর্বজনবিদিত ছিল, তা সাম্প্রতিককালে কবি মিনার মনসুরের ‘বঙ্গবন্ধু কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্র পাঠ করলেই অনুধাবণ করা যাবে। কবি মিনার মনসুর তাঁর গ্রন্থটি আবু ছালেহ, বশির উদ্দিন মাহমুদ, খোরশেদ আলম সুজনকে উৎসর্গ করেছেন।
সময়ের পরিবর্তনে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আরও অনেকের মতো আবু ছালেহ ভাইও সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। এখন আর কেউ তাঁর খবরও রাখেন না। ভালো লাগল জেনে, ২০২১ সালের আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন চট্টগ্রামের সিটি মেয়র জনাব রেজাউল করিম চৌধুরী আদর্শ রাজনীতির বাতিঘর অসুস্থ আশিউর্ধ্ব বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবু ছালেহ ভাইয়ের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে এসেছেন। বোধ করি, মাননীয় মেয়র যথার্থ কাজটিই করেছেন। ছালেহ ভাই আপনি শতায়ু হোন।
লেখক : নাট্যজন, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক