বোয়ালখালীর বহুল আলোচিত মাদ্রাসা ছাত্র ইফতেখার মালেকুল মাশফি (৭) হত্যাকাণ্ডের রহস্য প্রায় সাড়ে ৩ মাস পর উদঘাটিত হয়েছে। একই মাদরাসার হেফজ বিভাগের দুই ছাত্র যথাক্রমে ইদু আলম সাকিব ও তৌসিফই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে পিবিআই। খুনের আগে তাকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে বলেও সন্দেহ পিবিআই কর্মকর্তাদের। খুন হওয়া মাশফি চরণদ্বীপ আল্লামা অছিউর রহমান হেফজখানা ও এতিমখানার নাজেরা বিভাগের ছাত্র ছিল। গতকাল রোববার সকালে পিবিআইয়ের একটি টিম বোয়ালখালী উপজেলায় পশ্চিম চরণদ্বীপ ইউনিয়নের আল্লামা হজরত শেখ অছিয়র রহমান ফারুকী (রহ.) এতিমখানা ও হেফজখানার দুই ছাত্রকে নিয়ে তল্লাশি চালায়। তাদের ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা ছুরি পাওয়া যায়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পিবিআই চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান আজাদীকে জানান, তদন্তভার পাওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তিগত কোনো ক্লু নেই, মাদরাসার সকল শিক্ষক ও ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গত ১৪ জুন পিবিআইয়ের একটি টিম মাদরাসায় গিয়ে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবার (১৭ জুন) পিবিআই টিমের কাছে তথ্য আসে যে, একজন ছাত্র খুনের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছে এবং সে বিষয়টি জানাতে রাজি হয়েছে। অভিভাবকের মাধ্যমে শুক্রবার রাতে ১০ বছর বয়সী হেফজ বিভাগের ওই ছাত্রকে পিবিআই কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই ছাত্র জানায়, তার সঙ্গে আরও একজন সহপাঠী ঘটনা দেখেছে। অভিভাবকের মাধ্যমে তাকেও এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই টিম। দু’জনের বর্ণনা অভিন্ন হওয়ার পর তাদের তথ্য অনুযায়ী ঘটনায় জড়িত দুই ছাত্রকে শনিবার আটক করে পিবিআই কার্যালয়ে আনা হয়। দু’জনের বয়স ১৫ বছর। তারা ওই মাদরাসার হেফজ শেষ করে রিভিশন বিভাগে ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে দু’জন হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে বলে জানান পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান। অভিযুক্ত দুই ছাত্র খুনের দায় স্বীকার করে বিকেলে চট্টগ্রামের একটি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।
এসময় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবেও দুই ছাত্রের জবানবন্দি নেওয়া হয়। তাদের জবানবন্দির আলোকে আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত এ দুই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করি। তিনি বলেন, ভিকটিমের বয়স ছিল ৭ বছর আর ঘটনায় জড়িতরা ছিল ১৪/১৫ বছরের। ভিকটিমের সঙ্গে ঘটনায় জড়িত দুইজনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল। বিশেষ করে খাবার পরিবেশন, খাবার গ্রহণ, অন্যান্য জীবন প্রণালী সংক্রান্ত ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল। আমরা ধারণা করছি হত্যাকাণ্ডের দিন অভিযুক্তরা মাদরাসার দ্বিতীয় তলায় মাশফিকে বলাৎকার করেছে। মাশফি বিষয়টি শিক্ষকদের জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথম জন তাকে দেয়ালে ধাক্কা দেয়। দেয়ালে ধাক্কায় আহত হওয়ার পর মাশফি মাটিতে পড়ে যায়। ওই সময় হাত পা চেপে ধরে তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে পিবিআই টিমের সদস্য পরিদর্শক মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন আজাদীকে বলেন, দুই ছাত্র জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, নিহত মাশফি এবং তাদের বাড়ি একই এলাকায়। মাশফির জন্য তার বাসা থেকে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার পাঠাত। এই দু’জন সেই খাবার জোরপূর্বক খেয়ে ফেলত। মাশফি তার বড় ভাইকে বিষয়টি জানায়। তখন বড় ভাই ক্ষুব্ধ হয়ে মাদরাসায় এসে দু’জনকে বকাঝকা করে এবং তিনি বিষয়টি শিক্ষক জাফরকেও জানিয়ে দেন। জাফরও তাদের ধমক দেন। এতে দু’জনের ক্ষোভ জমে মাশফির ওপর। সেই ক্ষোভ থেকেই হত্যাকাণ্ড।
উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ সকালে বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নে চরণদ্বীপ দরবার শরীফ পরিচালিত আল্লামা শাহসূফী অছিয়র রহমান মাদরাসার দোতলায় স্টোর রুম থেকে এক ছাত্রের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ইফতেখার মালিকুল মাশফি (৭) চরণদ্বীপ ইউনিয়নের ফকিরাখালী গ্রামের প্রবাসী আব্দুল মালেকের ছেলে। সে ওই মাদরাসার হেফজখানা বিভাগের কায়দা শাখার ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় মাশফির মামা মাসুদ খান বাদী হয়ে বোয়ালখালী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় বোয়ালখালী থানা পুলিশ তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছিল। এরা হলেন- হাফেজ জাফর আহমদ, হাফেজ মো. রুস্তম আলী ও শাহাদাত হোসেন। জাফরকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তবে খুনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এ অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই।