পোড়া লাশের আর্তনাদ আর কতদিন

অনুপ দাশ গুপ্ত | সোমবার , ১৩ জুন, ২০২২ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি, ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল এই ১২ বছরে বহু মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে নিরীহ মানুষের দেহ পুড়ে কয়লা হয়েছে। কিন্তু এসবের জন্য দায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এযাবৎ কালে ন্যূনতম শাস্তি হওয়ার কথা আমার জানা নেই। এক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি নামক বায়বীয় কাগুজে কমিটি হয়, রিপোর্ট হয়, সুপারিশ হয় কিন্তু শুধু হয় না তার বাস্তবায়ন। এও কি এক নিষ্ঠুর ও নির্মম পরিহাস নয় মৃত মানুষের পরিবারের সাথে! এটাও কি এক ধরনের অপরাধ নয়। তাহলে জবাবদিহিতাটা কোথায়? অবশ্য সুশাসনহীন নিখোঁজ গণতন্ত্রের এ দেশে রাষ্ট্রের সব জবাবদিহিতাও রাজা-মহারাজদের নিজেদের বুক পকেটে। জনগণ তো এখানে মূল্যহীন পরিযায়ী পাখি মাত্র। রাজনীতির দুষ্ট চক্র এবং মালিকদের লোভাতুর লেলিহান শিখার প্রবল উত্তাপে তদন্ত কমিটির সকল সুপারিশ জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হওয়াই তো স্বাভাবিক। সর্ব ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে নিম্নবিত্ত ও গরীব শ্রমজীবী মানুষকে। আগুনের ভয়াবহ তাপে তাদেরই ছাই ভস্ম হতে হয়। প্রতিকারহীন ব্যর্থ রোদনে এবং বাতাস ভারী করা আর্তনাদে তাদের পরিবারকে তিলে তিলে বরণ করে নিতে হয় মানবেতর জীবন। সীতাকুণ্ডের এই পোড়া লাশ গুলোর ছবি দেখতে দেখতে বিষণ্ন ও বেদনাহত হৃদয়ে শুধু মনে পড়ছে নোবেল বিজয়ী কবি ও গায়ক বব ডিলানের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন-‘হ্যাঁ, কত কত মানুষ মরে গেছে জানা পর্যন্ত/আর কত মৃত্যু পেরিয়ে যেতে হবে?/বন্ধু আমার, উত্তরটা উড়ছে বাতাসে/ উত্তরটা উড়ছে বাতাসে’।
আমাদের এই রাষ্ট্রে সকল পোড়া লাশের দায় কার তার উত্তরটাও উড়ছে বাতাসে। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার ৪৩ নবাব কাটরা ভবনটির নিচতলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। তখন ১২৪ জন মানুষ পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। বাড়ির নিচ তলায় রাসায়নিক দ্রব্য ছিল এবং সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭৭ জন মানুষ মারা যান। তারপরও কোনও রকম কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিমতলী ট্র্যাজেডীর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি ভবনের নীচে গুদামে রাখা রাসায়নিক সামগ্রী থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছিল। একই সঙ্গে তারা পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে ১৭ দফা সুপারিশও করেছিল (প্রথম আলো, ৪ জুন ২২), যার মধ্যে ছিল রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেওয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত, বেচাকেনা এবং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই -বাছাই, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা ইত্যাদি। কিন্তু গত ১২ বছরেও তার কিছুই হয়নি। যে কোনো অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা ঘটলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শ করেন এবং বিবৃতি দেন। এবারও সীতাকুণ্ড পরিদর্শন করেছেন এবং বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে, এটা আমার বিশ্বাস। না হলে এতগুলো প্রাণ যায় না’ (দেশ রূপান্তর,৮ জুন’২২)। কিন্তু কথা হলো, পুরান ঢাকার নিমতলীর রাসায়নিক গুদাম, লালবাগের প্লাস্টিক কারখানা, বনানীর বহুতল অফিস ভবন, রূপগঞ্জের হাসেম ফুডসের কারখানা-এগুলোতেও তো কিছু একটা ঘটেছিল। তার কারণ বা হোতারা কি চিহ্নিত হয়েছে? হাজার কোটি টাকার পণ্যের ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব যত দ্রুত পাওয়া গেল, মানুষ গুলো যে পুড়ে মরে গেলো তার হিসেব কি সেভাবে পাওয়া যাবে? শুধু দশ লক্ষ বা পনের লক্ষ টাকাই কি মানুষের জীবনের মূল্য হতে পারে? জীবনের মূল্য কি টাকা দিয়ে শোধ যোগ্য? রাসায়নিকের আগুন হয়তো নিভানো যাবে। কিন্তু উদগ্র লোভের আগুন কী দিয়ে নিভানো যায়? সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এই ডিপোতে রাখা কন্টেইনার গুলোতে ছিল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ, হাইড্রোজেন পার-অঙাইডের কারণে লাগা আগুন পানি দিয়ে নেভানো যায় না, বরং এর ফলে পানির তীব্র চাপের কারণে তাপীয় বিয়োজন আরো বাড়ে বিধায় আগুনের মাত্রা আরো বাড়ে। এজন্য এ ধরনের রাসায়নিকের কারণে লাগা আগুন নেভাতে হয় ফগ সিস্টেমে অথবা ফোম ব্যবহার করে কিংবা ড্রাই পাউডার জাতীয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দ্বারা। ডিপোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ কনটেইনার রাখার আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে চললে হয়তো ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হ্রাস করা সম্ভব হতো।
বাংলাদেশে এখন এ ধরনের ১৯টি কনটেইনার ডিপো রয়েছে। সম্মিলিতভাবে এ ডিপোগুলো দেশের ১০০ শতাংশ রপ্তানিমুখী কার্গো এবং ২৫ শতাংশ আমদানিমুখী কার্গোর চাপ সামল দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ডিপোগুলোয় একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। কনটেইনার ডিপোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক স্টান্ডার্ড (আইএসও ৪৫০০১:২০১৮) বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি। আমদানি-রপ্তানিতে কনটেইনার ব্যবহার শুরু হওয়ার পর দ্রুত বিকশিত হতে থাকে কনটেইনার ডিপো ব্যবসা। চট্টগ্রামে ১৬টি শিল্পগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের ১৯টি বেসরকারি ডিপো রয়েছে, এই ভয়াবহ আগুনের পর এখন প্রশ্ন এসেছে এগুলোর দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা আসলে কী করেছেন! মৃত্যুর সংখ্যা খুব কম না বেশি এটা ভাবার আগে ভাবুন একটি প্রাণের দামও কি আমরা পুরো ডিপো পুড়ে যাওয়ার খরচের বিনিময়েও দিতে পারবো! এই যে অর্ধশত মানুষের প্রাণ গেলো এবং দুই শতাধিক মানুষ আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, এর দায় কার? তরল রাসায়নিক হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে দাহ্য নয়। ঠাণ্ডা, কম আলোযুক্ত নিরাপদ স্থানে একে মজুত করা দরকার। এর কাছাকাছি কোনো ধরনের আগুনের উৎস, উচ্চতাপ ও আলো বিপজ্জনক। ভোগবাদী বিশ্বে ভোগের প্রবণতা বাড়ার সাথে সাথে, বিপজ্জনক রাসায়নিক হওয়া সত্ত্বেও হাইড্রোজেন পার-অঙাইডের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। কাগজের মণ্ড ও কাগজ ব্লিচিং করতে মূলত এর বহুল ব্যবহার হয়। এছাড়াও ময়দা ব্লিচ করা, ডিটারজেন্ট, গার্মেন্টশিল্পে ব্লিচ করা এবং লন্ড্রিতে এটি ব্যবহৃত হয়। চুল ব্লিচ করতে কিংবা হাতের কাজের জিনিস বানাতে প্লাস্টিক কিংবা কিছু মাটিবিহীন হাইড্রোফোনিক চাষেও এর ব্যবহার দেখা যায়। মার্কিন অক্সিক্লিন ব্যান্ড হলো দশাসই গৃহস্থালি পরিষ্কারক পণ্য। চার্চ ও ডুইট, অরেঞ্জ গ্লো ইন্টারন্যাশনাল ও বিল মায়েস কোম্পানি ঘরের মেঝেতে দাগ তুলতে, লন্ড্রির ব্লিচিং ও ডিটারজেন্ট হিসেবে এটি বিক্রি করে। মেগা কর্পোরেট কোম্পানী প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের বহুল বিক্রিত একটি লন্ড্রি ডিটারজেন্ট ব্র্যান্ড টাইড-এর ব্যবসা তো আরো রমরমা। এই কর্পোরেট লোভের হাতছানিতে স্মার্ট গ্রুপ চট্টগ্রামেই বসিয়েছেন বিপজ্জনক এই রাসায়নিকের কারখানা। লাভ ও লোভের পাহাড়সম চাপে জীবনের দাম বড়ই ঠুনকো। এই ধরনের আগুন ও বিস্ফোরণ এদেশে তথা চট্টগ্রামে এবারই প্রথম নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে এর আগেও রাসায়নিকের বিস্ফোরণ ঘটেছে।
২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টারমিনালে মিথানল ভর্তি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটে, চারজন শ্রমিক গুরুতর আহত হন ও দগ্ধ হন অনেকেই। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই রাতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। শুধু বন্দরে নয়, দেশের রাসায়নিক মজুদাগার কি কারখানা সর্বত্রই ঘটছে বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি। ২০১৬ সালের টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানার বিস্ফোরণে মৃত্যু, তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু, চুরিহাট্টা, নিমতলী, নারায়নগঞ্জের হাসেম ফুডসে মৃত্যু, কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায়’ প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে মৃত্যুসহ উল্লিখিত প্রতিটি নির্মম অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করেছে দাহ্য ও বিপজ্জনক রাসায়নিক ব্যবহার, মজুদকরণ, উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা দৃষ্টিভঙ্গিগত ও কাঠামো গত কত উদাসীন, দায়িত্বহীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে দায় এড়ানোর চেষ্টা, সুশাসন ও জবাবদিহিতার চরম অভাব।
প্রতিটি দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডে নাশকতা ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বলয়ে আবদ্ধ থেকে আর কতদিন? প্রকৃত সত্য ও অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ উৎঘাটনের জন্য নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জোড় দাবী কতৃপক্ষের কাছে জানাতেই পারি। প্রয়াত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কবি নূরজাহান মুরশিদের একটি মর্মস্পর্শী কবিতা ‘জীবনের দাম কত’-এর ভাষায় বলতে চাই- ‘মৃত্যু অবধারিত/ কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু আজ দুর্লভ/ সারি সারি লাশের ছবি/ কী? ক্ষতি পূরণ দেওয়া হবে?/ কাকে? জীবনের বদলে?/ জীবনের দাম কত’?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী এল. এ. চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষা ও শিক্ষার সংস্কার প্রসঙ্গে