বাড়ছে নারী অপরাধীর সংখ্যা

মেলা ও স্টেশনকেন্দ্রিক অপরাধই বেশি, সিএমপির তালিকায় চার গ্যাংয়ের ৭৩ নারী ছিনতাইকারী

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১১ জুন, ২০২২ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

১৪ দিন বয়সের শিশু পুত্রকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে গাড়ির জন্যে রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন মা জেনি আক্তার। এ সময় একটি সিএনজি টেক্সি এসে দাঁড়ায় তার সামনে। গাড়িটিতে উঠে দেখেন সেখানে এক নারী। সীতাকুণ্ডের জোড়আমতল থেকে ভাটিয়ারী যাওয়ার পথে ওই নারী জেনি আক্তারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, আপনার বাচ্চাটাতো সুন্দর, একথা শুনার পর আর কিছু মনে নেই জেনি আক্তারের। এরপর জেনি আক্তারকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে বাচ্চা নিয়ে চম্পট দেয় ওই নারী। ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৭ মে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় ভাটিয়ারী এলাকায়।
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। চট্টগ্রামে নারী অপরাধীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্যমতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোতে নারীর সংখ্যা নামমাত্র। তাছাড়া নারীদের অপরাধ জগতে প্রবেশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তেমন ধারণা নেই। কোনো টিমে একজন নারী থাকলে সাধারণ মানুষ যেমন সন্দেহ করে না, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল দলও রাস্তায় তল্লাশিকালে তেমন হেনস্থা করে না। গত এক বছরে গ্রেপ্তারকৃত ডাকাত, চোর, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, টানা পার্টি, জাল টাকা সরবরাহকারী, প্রতারক, অস্ত্র বাহক, মাদক ব্যবসায়ী, শিশু অপহরণ এমনকি জঙ্গি তৎপরতায়ও নারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে সিএমপির বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ আজাদীকে বলেন, পুরুষ অপরাধীর ক্ষেত্রে আমরা যতোটা এগ্রেসিভ হতে পারি, অপরাধী নারী হলে আমরা তা পারি না। তাছাড়া ধরেন, এক ব্যবসায়ীকে কিডন্যাপ করতে চায়। তাকে কোনো পুরুষ ডাকলে সে নাও আসতে পারে, কিন্তু নারী হলে তাকে নিয়ে আসাটা সহজ হয়। এসব কারণে অপরাধের ক্ষেত্রে নারীর সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহিদুল কবীর আজাদীকে বলেন, শুধু কোতয়ালী থানা এলাকায় নয়, নগরজুড়ে বোরকা পরা ছদ্মবেশী নারী পকেটমার ছড়িয়ে পড়েছে। ভিড়ের কারণে যখন মানুষের মধ্যে ঠেলাঠেলি চলছে তখনই এরা কাজের কাজটি করে ফেলছে। আর এদের প্রধান টার্গেটই হচ্ছে মানিব্যাগ। অনেক সময় এরা নিজেরাই মানুষের গা ঘেঁষার চেষ্টা করে। এতে করে একবার তাদের সংস্পর্শে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মানিব্যাগ খোয়া যাবে।
সম্প্রতি এক প্রতারক নারীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। তিনি কখনও মিনু, কখনও সুমি, কখনো ফাতেমা আবার কখনও রোমানা নামে পরিচিত। এসব নামের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে একাধিক নামে একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিক সনদপত্র। তিনজন বৈধ স্বামীর পরিচয় পাওয়া গেলেও রয়েছে আরও অনেক স্বামী। একাধিক প্রতিষ্ঠানে ছদ্মনাম এবং ভিন্ন ভিন্ন নামের সার্টিফিকেট ব্যবহার করে একাধিক চাকরিও করেছেন তিনি নির্বিঘ্নে। বিয়ের নামে বহু পুরুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ-সম্পদ লুট, জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে নানামুখী প্রতারণা-জালিয়াতি ও নিরীহ লোকদের হয়রানিসহ রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ।
গ্রেপ্তারকৃত একাধিক নারী অপরাধী জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, নিজেরা নারী হওয়ায় নারীরাই তাদের টার্গেট। নগরীর ব্যস্ততম সড়কগুলোর সুবিধামতো জায়গায় অবস্থান করে। এরপর একা চলা নারীদের অনুসরণ করেই সুযোগ বুঝে করে ছিনতাই। এক্ষেত্রে একের পর এক অভিনব কৌশলও অবলম্বন করে তারা। তাদের হাতে পড়ে এ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকেই। তবু যেন থামানো যাচ্ছে না তাদের দৌরাত্ম্য।
বিস্ময়করভাবে নগরীতে গত কয়েক বছর ধরে পুলিশের হাতে ধরা পড়া বেশিরভাগ নারী ছিনতাইকারীর বাড়িই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরে। তাদের প্রায় সবাই পরস্পরের আত্মীয়। অন্তত পেশাদার ৩২ নারী ছিনতাইকারী চট্টগ্রামে সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে ২৮ জনই নাসিরনগরের ধরমন্ডল গ্রামের দুই বাড়ির সদস্য। আবার এই দুটি বাড়ির এক বাড়ির নারী সদস্যই আছেন ২০ জন! অন্য বাড়ির আছে আটজন। তাদের কারও নামে পাঁচটি, কারও চারটি, কারও নামে তিনটি করে ছিনতাই মামলা ঝুলছে।
নগরীতে পুলিশের কাছে চারটি গ্যাংয়ের ৭৩ জন নারী ছিনতাইকারীর নাম রয়েছে। পুলিশের নথি বলছে, ছিনতাই ছাড়াও দুঃসাহসিক চুরিতেও তারা সিদ্ধহস্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া কিংবা কক্সবাজার গ্যাংয়ের মোট নারী অপরাধীর সংখ্যা প্রায় ৪০০!
পুলিশের ভাষ্য, চট্টগ্রামে অপরাধে জড়িত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারীদের মধ্যে চিহ্নিত মরিয়ম, রাহেলা, জোহানা, কহিনুর, রোজিনা, রহিমা, মর্জিনা, সোমা, সাবিনা, পম্পি, রোকসানা ও কোহিনুর। কুমিল্লা গ্যাংয়ে রয়েছে আয়েশা, কেয়া, স্বপ্না, মর্জিনা, রাশেদা, আয়েশা, রুমা, রেখা, হেনা, মেরি, রিংকি, ফাতেমা ও পারুল। কুষ্টিয়া গ্যাংয়ে আছে পাপিয়া, রহিদা, ববিতা, শান্তাসহ ৯ নারী। কক্সবাজার গ্যাংয়ের হয়ে নুর ফাতেমার নেতৃত্বে স্বপ্না, শাহনাজ, কুলসুমাসহ ১৩ নারী রয়েছে।
নারী ছিনতাইকারী ও চোরদের দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণে রাখা বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বলেন, চারটি নারী ছিনতাইকারী গ্যাং নগরে অপকর্ম করছে। তারা গণজমায়েত এলাকা, মেলা কিংবা স্টেশনকেন্দ্রিক অপরাধ করেন বেশি।
চট্টগ্রামে শীর্ষ নারী ছিনতাইকারী ফারজানা। স্বামীর হাত ধরেই শীর্ষ ছিনতাইকারীর তকমা। নগরীর আগ্রাবাদ এলাকা থেকে গত বছর তাকে গ্রেপ্তার করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। ফারজানা সবার কাছে নিজেকে টিকটক ও লাইকি মডেল হিসেবে জাহির করলেও আসলে তিনি একজন দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী। ধরা পড়ার আগেই তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা ছিল বলে জানিয়েছিল পুলিশ। জেল খেটেছেন সাতবার। কিশোরদের নিয়ে নিজস্ব একটি ছিনতাইকারী দলও রয়েছে ফারজানার। তার টার্গেট থাকতো নারী-পুরুষ উভয়ই। তবে দুই ক্ষেত্রে অবলম্বন করতেন আলাদা আলাদা কৌশল। সাধারণত একা চলাচল করা ছেলেদের টার্গেট করে ঠিকানা জিজ্ঞেস করার নামে থামাতেন। ফারজানার স্বামী রুবেলও ছিনতাইকারী দলের একজন সক্রিয় সদস্য। ফারজানাকে গ্রেপ্তারের কয়েকদিন আগেই অস্ত্র ও ছোরাসহ রুবেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলা রয়েছে বলে জানায় পুলিশ। মূলত স্বামী-স্ত্রী মিলেই সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দল গড়ে তোলেন। গত বছরের ১৯ জুলাই নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ে ঘটে যাওয়া একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে তাদের তথ্য।
শুধু নগরী নয়, বিভিন্ন উপজেলায়ও রয়েছে নারী ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। ফারজানা ছাড়াও ছিনতাইকারী পাপিয়া, মরিয়ম, সুহানা, মধুমালা ও হনুফা বেগমের নামে পাঁচটি, রুবিনা, শাহানা, জোহানা, শারমিন, কুশ নাহার ও রিপার বিরুদ্ধে চারটি, জোসনা ও রুমার নামে আছে তিনটি করে মামলা। অন্য ছিনতাইকারীদের নামেও রয়েছে একের অধিক মামলা। ছিনতাই করার সময় তারা কখনো আলাদাভাবে কাজ করে না। কোথাও গেলে ৫-৬ জন একসঙ্গে যায়। তারা যাকে টার্গেট করে তার পিছু নিয়ে সুনির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার পর ঘিরে ধরেন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে। বিশেষ করে টেরিবাজার, সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লাসহ কয়েকটি এলাকায় তারা সক্রিয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামগামী মেইল ট্রেনে ছিনতাইয়ের শিকার ৪ যাত্রী
পরবর্তী নিবন্ধসম্মেলনসহ সাংগঠনিক বিষয়ে হতে পারে সিদ্ধান্ত