সারা বিশ্বে এখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। এর প্রধান কারণ দুইটি ১। দুই বৎসরের করোনা মহামারি এবং ২। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়েই খাদ্য রপ্তানীকারক দেশ। এ দুইটি দেশ বিশ্বে প্রধান গম উৎপাদনকারী। বিশ্বের মোট গম রপ্তানীর ২৯ শতাংশ তারাই সরবরাহ করে। তারা আবার বিশ্বের প্রায় ১২ শতাংশ খাদ্য সরবরাহকারী দেশ। পৃথিবীর বেশির ভাগ দরিদ্র দেশগুলির প্রধান খাদ্য ময়দা-আটা থেকে প্রসু্তুত করা রুটি। সুতরাং বোঝার অপেক্ষা রাখে না যে দরিদ্র দেশগুলি বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বিশ্বে গম রপ্তানীর ৩০ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশগুলি রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম ও অন্যান্য ভোগ্য পণ্য রপ্তানী বন্ধ রয়েছে। এ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মান, ন্যাটোভুক্ত দেশ ও ইউরোপের বেশ কয়টি দেশ রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস না আনার জন্য বা আমদানী কমিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব এনেছে। এই যদি হয় ন্যাটোভুক্ত কিছু দেশ এবং ইউরোপিয় দেশগুলি দেশ পরিচালনায় সমস্যায় পড়বে। তারা মুখে বললেও অদ্যাবদি গোপনে রাশিয়া থেকে তেল গ্যাস আনা অব্যাহত রেখেছে।
অতি সম্প্রতি জার্মান বলছে রাশিয়া থেকে তেল গ্যাস আনা বন্ধ করা যাবে না। অন্যদিকে করোনা মহামারিতে আক্রান্ত দেশগুলির অনেক লোক চাকরি হারিয়েছে বা কম বেতনে চাকরি করতে বাধ্য হয়েছে। বহুদিন ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ থাকার কারণে ব্যবসায়িরাও অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মাসের পর মাস লকডাউন থাকায় সাধারণ জনসাধরণের জীবন-জীবিকা অচল হয়ে গিয়েছিল। মানুষ দিশেহারা ছিল। এই পরিস্থিতিতে জার্মান অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন মন্ত্রী সভেনজা শুলজে এক সতর্ক বার্তায় বলেছেন আগামিতে আসন্ন দুর্ভিক্ষ ভয়াবহতায় রূপ নিবে। আল্লাহর মেহের বানীতে আমাদের বাংলাদেশে তেমন নাও হতে পারে। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সজাগ দৃষ্টি রাখছেন এবং মনিটরিং করছেন। যেহেতু আমাদের দেশ আমদানি নির্ভর তাই মিতব্যয়ী হতে বলেছেন। মজুদদারদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন। ইতিমধ্যে অনেককে শাস্তির আওতায় এনেছে। দিন দিন ডলারের দাম বাড়ছে আর টাকার মান কমছে, আমদানি পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া।
আস্তে আস্তে সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাতহবিল যদিও সন্তোষজনক-যেহেতু আমাদের দেশ আমদানি নির্ভর তাই প্রত্যেক নাগরিকের উচিত বিশেষ করে খাদ্যপণ্য বুঝে সুজে ব্যবহার করা। এমনকি দরকার বশতঃ কৃচ্ছতাসাধনের জন্য তৈরি থাকতে হবে। আগেই বলা হয়েছে দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ ইউক্রেনযুদ্ধ ও করোনা মহামারি। এদিকে জাতিসংঘ খাদ্যসংস্থা জানিয়েছে এরি মধ্যে ৩০ কোটির বেশি মানুষ তীব্র অনাহারে ভুগছে এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্ব খাদ্যসংস্থা বলছে বিশ্বে আরো প্রায় ৪ কোটি ৫০ হাজার মানুষ ক্ষুধার দিকে ঝুঁকছে। খাবারের দাম সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। অনাহারে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারে বিশেষ করে দরিদ্র ও আমদানিকারক দেশগুলিতে। ইউক্রেন পৃথিবীর খাদ্যগুদাম নামে পরিচিত। সে দেশে আজ ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। তাই গোটা বিশ্ব আজ এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ। তাদের কৃষি জমিগুলিতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাদের সকল বন্দর বন্ধ রয়েছে। গত ৯ মে রাশিয়া বিজয় দিবস হিসাবে পালন করেছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের দিনটাকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়কে রাশিয়া বিজয় দিবস হিসাবে পালন করে। পশ্চিমারা মনে করেছিল বিজয় দিবসে প্রেসিডেন্ট পুতিন বড় ধরনের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। বরং বলছে তার সার্বভৌম রক্ষার্থে এ যুদ্ধ। তার সিদ্ধান্ত সঠিক। বিজয় দিবসের পরদিন রাশিয়া পুনরায় নতুন নতুন এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। অনেক লোক হতাহত হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলি ইউক্রেনকে সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যহত রেখেছে। তাতে মনে হয় যুদ্ধ আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং বিশ্ব দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে পতিত হবে।
এদিকে ইউক্রেনের উপর দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে রাশিয়া ইউরোপিয় দেশগুলিতে তেল সরবারাহ করত ইউক্রেন সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতে আমাদের ১৯৪৩ এর মন্নন্তরের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার জন্ম ১৯৪৩ সনে। তখন টাকা দিয়েও খাদ্য, চাউল, ভোগ্যপণ্য পাওয়া যায়নি। খাদ্যের অন্বেষণে মানুষ এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। কোথায়ও একমুঠো চাউল পাওয়া যায়নি। ভাতের মার খেয়ে দিন কাঠাতে হয়েছে, এদিকে সেদিকে নরকঙ্কালের ছড়াছড়ি। চট্টগ্রামের ক্ষুধার্ত মানুষ হেঁটে হেঁটে রংপুর চলে গেছে। ইউক্রেন হলো ইউরোপের ৪র্থ বৃহৎ খাদ্য সরবরাহকারী দেশ। ইউক্রেনকে ইউরোপের সবজি বাগান বলা হয়। যুদ্ধের কারণে এখন সব শেষ। অতিসম্প্রতি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। অবিলম্বে সরকারি, আধাসরকারি, কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো সেমিনার সিম্পোজিয়ামে যেতে পারবে না। গম রপ্তানীতে ভারত দ্বিতীয় বৃহৎ রাষ্ট্র। সে দেশে তাপদাহে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে ও গমের মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ভারত হঠাৎ গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা করল। ভারতের এ সিদ্ধান্তে এশিয়া ও আফ্রিকার গরীব দেশগুলি বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাক্কালে ভারত কথা দিয়েছিল বিশ্বকে শস্য যোগান দেবে। বিশ্বের গম রপ্তানিতে শীর্ষে দুটো দেশ ইউক্রেনও রাশিয়া। তারা এখন যুদ্ধে লিপ্ত। এ দিকে যুদ্ধ শুরুর পর কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে গম রপ্তানি কমে যাওয়াই ক্রেতারা ভারতের উপর নির্ভর করছিল। ভারত ২০২০-২০২১ বছরে গম রপ্তানি করেছে ৭০ লক্ষ টন সেখানে এ বছর প্রথম তিন মাসে রপ্তানি করেছে মাত্র ১৪ লক্ষ টন।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ২০২২ সালকে ‘সর্বনাশা এক ক্ষুধার বছর’ আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ খাদ্যসংকটে পড়বে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন ইউক্রেন যুদ্ধ কোটি কোটি মানুষকে খাদ্য নিরাপাত্তাহীনতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে যা অপুষ্টি, অনাহার ও দুর্ভিক্ষের কারণ হতে পারে। এ খাদ্য সংকট থেকে বিশ্বকে কেউই রক্ষা করতে পারবে না। অর্থনীতিবিদরা ও বলেছেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ি হলে এ সংকট দুর্ভিক্ষে রূপ নেবে। কারণ একটাই বিশ্বের খাদ্যশস্য, সার ও তৈলবীজ উৎপাদনে অন্যতম দুই দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া। যে সমস্ত দেশগুলি শস্য ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে তারা তাদের খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ২২টি দেশ খাদ্যরপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় বিশ্ব খাদ্য বাণিজ্য শতকরা ১০ভাগ হ্রাস পেয়েছে। ব্রিটেনে খাদ্য সরবরাহকারি ৪টি দেশ ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও জার্মানি খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বে খাদ্য শস্যের আগের চেহারা ফিরে পাবে না। দরিদ্র দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়বে। কয়েক মিলিয়ন খাদ্য উদ্বাসু্ত তৈরী হবে। মুদ্রাস্ফিতির বাড়ার কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। ওয়ার্লড ইকোনমিক ফোরাম আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ‘অঙফাম বলেছে মুদ্রাস্ফিতি বাড়ার কারণে চলতি বছর নতুন করে বিশ্বে ২৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ চরম দারিদ্র সীমার নিচে চলে যাবে। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে এখন ৪৪ কোটি থেকে ১৬০ কোটি মানুষ দুইবেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য হাহাকার করবে। আরও প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছে।
সুতরাং যেভাবে হোক বিশ্ব নেতৃবৃন্দের-বিশ্ব সংস্থার উচিত বিশ্বমানবতার খাতিরে কোটি কোটি অসহায় ভুখা মানুষদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই যুদ্ধ অতিসত্তর বন্ধ করার ব্যবস্থা করা।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট,
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।